অক্টোবর বিপ্লব
মানবেতিহাসের সবচেয়ে যুগান্তকারী সামাজিক বিপ্লব ‘মহান অক্টোবর বিপ্লব’-এর শতবর্ষ পূর্ণ হলো। জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর এবং গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৭ নভেম্বর তৎকালীন রাশিয়ার রাজধানী পেত্রোগ্রাদের উইন্টার প্যালেস দখল এবং ভøাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘সর্বহারা শ্রেণির’ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠানের ঘোষণাকে বলা হয়ে থাকে ‘মহান অক্টোবর বিপ্লব’। এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছে রুশ সোস্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি (বলশেভিক)। রুশরা বিপ্লবের আগে তাদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জি (জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি) অনুসরণ করত। পরে অবশ্য বিশ্বব্যাপী প্রচলিত গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করায় ৭ নভেম্বরকেই ‘বিপ্লব দিবস’ হিসেবে উদ্যাপিত করা হতো। তবে বিপ্লবের বিশ্বজনীন পরিচিতি হয়ে দাঁড়ায় ‘অক্টোবর বিপ্লব’।
১৯১৭ সাল ছিল রাশিয়ার এক ঘটনাবহুল রাজনৈতিক উত্থান-পতনের বছর। ইউরোপের তথা ভৌগোলিক দিক থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশ রাশিয়ায় ছিল সুদীর্ঘ রাজতন্ত্র। অষ্টাদশ শতকে পিটার দি গ্রেট রাশিয়ায় খ- খ- রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে এক বিশাল রুশ সা¤্রাজ্য গড়ে তোলেন। তার নামেই সেন্ট পিটার্সবুর্গে স্থাপিত হয় দেশের রাজধানী। রাশিয়ার এই শাসক বংশকে বলা হয় জার। জার শাসকরা ছিল অত্যাচারী এবং সর্বপ্রকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী। ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব এবং ঊনবিংশ শতকের সাম্য মৈত্রী ভ্রাতৃত্বের আহ্বান সম্বলিত ফরাসি বিপ্লব অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ইউরোপের দেশে দেশে বুর্জোয়া বহুদলীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। দল বা সংগঠন করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ভোটাধিকার এমনকি নির্বাচন প্রথারও প্রচলন ঘটে। কিন্তু রাশিয়ার জার শাসকরা সে দেশে কোনো গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্ব থেকেই রাশিয়ায় নানা বিপ্লবী সংগঠন গড়ে ওঠে।
১৮৯৮ সালে ভøাদিমির ইলিচ সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত থাকার সময় রাশিয়ার মাকর্সবাদী বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। গড়ে ওঠে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি। ১৯০৩ সালে এই পার্টির মধ্যে নানা রাজনৈতিক ও তাত্ত্বিক বিতর্ক দলটিকে কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক ভাগে ছিলেন রাশিয়ায় মার্কসবাদী দর্শনের পথিকৃত প্লেখানভ এবং অন্যদিকে ভøাদিমির ইলিচ লেনিন। পরবর্তীকালে এই মতবিরোধকে কেন্দ্র করে পার্টিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ (বেলশেভিক) ও সংখ্যালঘিষ্ট (মেনশেভিক) দুটি উপদল গড়ে ওঠে। এমনকি পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে বিভক্ত হয়ে যায়। লেনিনের নেতৃত্বাধীন পার্টি বলশেভিক পার্টি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে।
প্রথম মহাযুদ্ধের পটভূমিতে রাশিয়ার অর্থনীতিতে চূড়ান্ত বিপর্যয় নেমে আসে। শ্রমিক, কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার বুর্জোয়া ও লিবারেল গণতন্ত্রীদের নেতৃত্বে এবং জারবিরোধী সকল শক্তির সম্মিলিত প্রয়াসে সশস্ত্র গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। স¤্রাট জার দ্বিতীয় নিকোলাস ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন। রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। ‘স্টেট ডুমা’ (জাতীয় সংসদ) কেরেনেস্কির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে। রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পেত্রোগ্রাদ। কিন্তু কেরেনেস্কি সরকার জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকে। সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ ‘সোভিয়েত’ নামে এক ধরনের সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। শ্রমিক সোভিয়েত, কৃষক সোভিয়েত, সৈনিক সোভিয়েতÑ প্রভৃতি সমিতিগুলোকে বলশেভিক পার্টি যুদ্ধ বন্ধ ও কেরেনেস্কি সরকারকে উৎখাত ও শ্রমিক-কৃষকের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বৈপ্লবিক সংগ্রাম গড়ে তোলে। ফিনল্যান্ডে নির্বাসিত লেনিন তখন রাশিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন। পেত্রোগ্রাদের (বিপ্লবের পর নাম রাখা হয়েছিল লেনিনগ্রাদ) রাজকীয় স্মলনি প্রাসাদকে হেডকোয়ার্টার করে চলতে থাকে বিপ্লবের প্রস্তুতি। এই পর্যায়ে লেনিন ও শ্রমিক সোভিয়েতগুলোকে সুসংগঠিত করা এবং অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সাহসী ভূমিকা রাখেন রুশ বিপ্লবের অন্যতম নায়ক লেভ ট্রটস্কি। ২৫ অক্টোবর (৭ নভেম্বর) লেনিন শীত প্রাসাদ আক্রমণ ও প্রভিশনাল কেরেনেস্কি সরকারকে উৎখাতের তারিখ নির্ধারণ করেন।
লেনিনের নির্দেশে যুদ্ধজাহাজ ক্রুজার অরোরা থেকে ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় তিনবার তোপধ্বনি করার ইশারা পেয়ে সশস্ত্র বাহিনী, বলশেভিকদের তৈরি রেডগার্ড (শ্রমিক, কৃষকদের নিয়ে) শীত প্রাসাদ আক্রমণ করে। কার্যত বড় ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই কেরেনেস্কি সরকার আত্মসমর্পণ করে। স্মলনিতে লেনিন পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক শ্রেণির রাজত্ব ‘সমাজতান্ত্রিক রুশ প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এভাবেই আজ থেকে শতবর্ষ আগে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়।
বিপ্লবের পর অবশ্য বিপ্লব বিরোধিরাও সংগঠিত হয়ে প্রতি আক্রমণ করতে থাকে। বস্তুত, ১৯১৯ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত রাশিয়ায় এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা কঠোর হস্তে প্রতিবিপ্লব দমনে সক্ষম হয়। ১৯২২ সালে রুশ সা¤্রাজ্যের অধীনস্ত অন্যান্য প্রদেশ বা দেশগুলোও বলশেভিকদের অধিকারে চলে আসে। ফলে ১৯২২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউএসএসআর বা ‘ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রিপাবলিকস’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বলশেভিক পার্টিও নতুন নামে ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
অক্টোবর বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যুদয়ের ফলে পৃথিবীর রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন অপরাজেয় পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। অন্যদিকে চীন, পূর্ব ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনেকগুলো দেশে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতাসীন হয়। গড়ে ওঠে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের সাথে সমাজতন্ত্র এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদ পুঁজিবাদী শোষণমূলক ব্যবস্থার একমাত্র বিকল্প হিসেবে প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি করে। কিন্তু ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও সমাজতন্ত্রের অবসান হয়। অক্টোবর বিপ্লবের ৭৪ বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়ার মধ্য দিয়ে মানবেতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অবসান ঘটে।
নূহ-উল-আলম লেনিন