প্রতিবেদন

অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর

বহুল আলোচিত ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসম (উলফা)-এর সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া ওরফে গোলাপ বড়–য়াকে তার দুই সহযোগীসহ ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ভারতের সাথে বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় তাদের হস্তান্তর করা হয়। ভারতের এই বড়মাপের বিচ্ছিন্নতাবাদীকে ফেরত দেওয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফোন করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি আঞ্চলিক সন্ত্রাস দমনে শেখ হাসিনার এই কাজে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ও অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে জেলের মেয়াদ শেষ হয় তিনজনের। এরপর ২০১৩ সালের ১৩ মে অনুপ চেটিয়া কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য আবেদন করেন। কর্তৃপক্ষ আবেদন আমলে নিয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগ শুরু করে। এরপরই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যোগাযোগ চলতে থাকে। সেই যোগাযোগের প্রেক্ষিতেই হস্তান্তরিত হলো অনুপ চেটিয়া ও তার দুই সহযোগী।
উলফার জন্ম : ভারতের অসম রাজ্যকে একটি স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক দেশ করার লক্ষ্যে সংগঠিত হয় সেই রাজ্যেরই কতিপয় বিপ্লবী বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। বাস্তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পরাজয়ের পর পাকিস্তান ও আমেরিকা ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নাগা ও মিজো বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের পাশাপাশি অসমের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের জন্ম দেয়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমানের সহায়তায় আইএসআই ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে উলফা গঠন করে। নেপথ্য কারিগর হিসেবে রয়েছেন উলফার চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়া, প্রদীপ ওরফে সমীরণ ও সামরিক বিভাগের প্রধান পরেশ বড়–য়া এবং সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া ওরফে গোলাপ বড়–য়া।
ভারতে উলফার বিরুদ্ধে সেদেশের সেনাবাহিনীর অভিযান : এরপর থেকে আইএসআই’র সহযোগিতা শুরু তাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র জোগান। ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত উলফার বিরুদ্ধে ১৯৯০ সালে ভারতের সেনাবাহিনী অসমে ‘অপারেশন বজরং’ নামে একটি অভিযান চালায়। সেই অপারেশনে উলফার বেশ কিছু নেতাকর্মী অস্ত্র-গোলাবারুদসহ গ্রেফতার হয়। ওই সময় ভারত সরকার উলফাকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করে সংগঠনটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। নিষিদ্ধ হওয়ার পর ভারত সরকার ধারাবাহিকভাবে উলফা সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রাখে। অনুপ চেটিয়া প্রথমবারের মতো ১৯৯১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চালানো অভিযানে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ওই সময় ভারত সরকারের সাধারণ ক্ষমায় তিনি মুক্তি পান। তিনি মুক্তি পেলেও উলফার অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত ছিল। এমন অভিযানের মুখে সংগঠনের অনেক শীর্ষনেতা আত্মগোপনে চলে যেতে থাকেন। ওই সময় অনেকেই পালিয়ে বাংলাদেশে ছদ্মবেশে আত্মগোপন করেন। তাদেরই একজন অনুপ চেটিয়া। তিনি পুরো পরিবারসহ বাংলাদেশে আত্মগোপন করেন।
ঢাকায় অনুপ চেটিয়ার আত্মগোপন : রাজধানীর তৎকালীন মোহাম্মদপুর বর্তমানে আদাবর থানাধীন এলাকার একটি বাড়িতে মাসিক ৬ হাজার টাকা ভাড়ায় দুই বছর থাকার চুক্তিতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। ভাড়া নেওয়ার সময় তিনি বাড়ির মালিকের কাছে ভুয়া নাম ঠিকানা দেন। আদাবরে বসবাসকালে তিনি নিজেকে বিভিন্ন সময় জন ডেভিড, আহম্মেদ, ডার্ক উইলিয়াম ও আবদুল আজিজ নামে পরিচয় দিতেন। দীর্ঘদিন এভাবেই প্রকৃত নাম পরিচয় গোপন রেখে আত্মগোপনে ছিলেন। ঢাকায় অনুপ চেটিয়া ও তার দুই সহযোগী গ্রেফতার : ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভ করে। ক্ষমতা লাভের পর দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থে দেশব্যাপী সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের গ্রেফতারে ঝটিকা অভিযান চালানোর নির্দেশ দেয় সরকার। এমনই এক অভিযানে ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর তৎকালীন মোহাম্মদপুর থানাধীন বর্তমানে আদাবর থানা এলাকার ঢাকা হাউজিংয়ের ২০ নম্বর ছয়তলা বাড়ির পঞ্চমতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে গ্রেফতার হয় অনুপ চেটিয়া ও তার দুই সহযোগী উলফা নেতা লক্ষ্মী প্রদীপ গোস্বামী ও বাবুল শর্মা। তাদের কাছ থেকে বিদেশি মুদ্রা, অবৈধভাবে বাংলাদেশ প্রবেশের নানা আলামত উদ্ধার হয়। জব্দ করা হয় পাসপোর্টসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র। গ্রেফতারের পর সরকারের নির্দেশে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়। তাদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ চলে।
ঢাকায় মামলা দায়ের ও সাজা : অনুপ চেটিয়া দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মজিবুল হক বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ, পাসপোর্ট আইন, বিদেশি মুদ্রা রাখা ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে পৃথক ৪টি মামলা দায়ের করেন। মামলায় অনুপ চেটিয়ার ১৮ বছরের জেল হয়। বিচারিক কার্যক্রম শেষে ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি আদালত তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠায়। এখান থেকে ২০০৩ সালের ১৭ জুন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে তার সাজার মেয়াদ শেষ হয়। এরপর কাশিমপুর কারাগার থেকে ২০০৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহী, সেখান থেকে ২০০৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ জেলা কারাগারে স্থানান্তর করা হয় তাকে। ২০০৯ সালের ৪ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলা কারাগার থেকে তাকে পাঠানো হয় রাজশাহী জেলা কারাগারে। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ২৮ জুন তাকে রাজশাহী জেলা কারাগার থেকে গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জেলে রাখা হয়। সেখানে তাকে আরপি সেল (মুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ বন্দী) সেলে রাখা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *