অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু
দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেতা নেলসন মেন্ডেলা সম্পর্কে কোনো এক কবি লিখেছিলেন, তাঁর নাম ও পরিচয়ের কোনো দরকার নেই তিনি মানেই আফ্রিকা আর আফ্রিকা মানেই মেন্ডেলা। এই একই কথাটি প্রযোজ্য আমাদের মহান নেতা, মুক্তিযুদ্ধের পথপ্রদর্শক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে। কেননা তাঁর নাম ও পরিচয়ের আসলেই কোনো দরকার নেই কারণ তিনি মানেই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। এ প্রসঙ্গে কিউবার প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রের কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডিভিড ফ্রস্ট (১৯৭২ সালের এক সাক্ষাৎকারে) বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার শক্তি কোথায়? তিনি অপকটে সে প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি’। সাংবাদিক আবারো জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার দুর্বল দিকটা কী? বঙ্গবন্ধু সে প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি’।
শেক্সপিয়রের ভাষায় বলতে হয়, এ জগতে কেউ কেউ জন্মগতভাবে মহান, কেউ মহত্ত্বের লক্ষণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন আবার কেউ স্বীয় প্রচেষ্টায় মহানুভবতা অর্জন করেন। আমার মতে বঙ্গবন্ধু এর সবগুলো গুণাবলী নিয়েই আপন মহিমায় গুণান্বিত। দেশের জনগণের অন্তর্নিহিত শক্তির ওপর অপার আস্থা ও বিশ্বাস, মানুষের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা মমত্ববোধ, সহমর্মিতার বিরল এক দৃষ্টান্ত শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর বজ্রকণ্ঠে জেগে ওঠে পুরো জাতি। সংগ্রামে, বিপ্লবে বাঙালি জাতির যে উত্থান তা তিনি ঘটিয়েছিলেন। তিনি শিখিয়েছিলেন বাঙালি বীরের জাতি আর বীর কখনো হারতে শেখেনি। তারই পথ ধরে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল ১৯৭১-এ পৃথিবীর মানচিত্রে।
প্রত্যেক দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন বড় মাপের নেতা থাকেন। পৃথিবীতে যাদের হাত ধরে একটি জাতি পোষণ, বঞ্চনা আর পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেয়েছে তাদের সেই জাতির পিতা উপাধিতে সম্মানিত করা হয়েছে, যেমন আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, রাশিয়ার লেনিন, চীনের মাও সেতুং, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, ভিয়েতনামের হে চি মিন, পাকিস্তানের জিন্নাহ বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের নয় সারা বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা, বাঙালি জাতির মহাবিদ্রোহের মহানায়ক, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা, গণতন্ত্রের মানসপুত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার সুদীর্ঘ দিনের সংগ্রাম, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের ফলে বাঙালি জাতি একটি নিজস্ব আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েছে।
একটি জাতির উত্থান ও প্রতিষ্ঠায় যিনি অসাধারণ ভূমিকা রেখে নেতৃত্ব দেন তিনিই জাতির জনক হয়ে ওঠেন। বাঙালি আর বাংলাদেশ আমাদের এই জাতিসত্তাকে প্রতিষ্ঠা করে সার্বভৌমত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু বিশ্বের কাছেও একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। তাঁর দৃঢ় মনোবল, সৎ সাহস, ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞা শুধু বাংলাদেশকে নয় মুগ্ধ করেছে বিশ্ববাসীকেও। তাইতো তিনি স্থান করে নিয়েছেন বিশ্ব দরবারেও।
তৎকালীন বৈশ্বিক ব্যক্তিত্ব তাঁর নেতৃত্ব ও প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করে গেছেন। তাদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে ‘প্রতিষ্ঠান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, কেউ তাকে বিপ্লব আন্দোলন বলে বর্ণনা করেছেন, কেউবা তুখোড় বাগ্মীতার প্রশংসা করেছেন। তার ৭ মার্চের ভাষণ ছিল যেন জাতিকে সম্মোহিত করার এক হাতিয়ার। যার মাধ্যমে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনের শেষ ধাপে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছিলেন। এই ভাষণ স্থান করে নিয়েছে বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রেরণাদানকারী ভাষণের একটি। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সেরা ভাষণ হিসেবে ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্যা বিচেস- দ্যা স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টোরি’ নামে ২২৩ পৃষ্ঠার এই বইটির সংকলন করেছে জ্যাকব এন্ড ফিল্ড। বইটির ২০১ পৃষ্ঠায় ‘দ্যা স্ট্রাগল দিস টাইম ইজ দ্যা স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স’ শিরোনামে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের পথিকৃৎ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির এক অবিসংবাদিত নেতা। এ দেশের মানুষের অধিকার, আকাক্সক্ষা পূরণের সংগ্রামে তিনি জাতিকে নেতৃত্ব দেন এজন্য বারবার তাকে কারাবরণ ও অমানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। তিনি ছিলেন উদার নৈতিকতায় বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক, সাম্য ও মৈত্রীর চিরন্তন আদর্শে উদ্ভাসিত।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এ দুটি নাম যেন একে অপরের পরিপূরক, যা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। ব্রিটিশ মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা প্রয়াত লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে একবার মন্তব্য করেছিলেন, এক অর্থে শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী ও ডি ভ্যালেরার চেয়ে বড় নেতা। এছাড়াও অনেক বড় বড় ব্যক্তি ও নেতা বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক সম্পর্কে এমন ধরনের অনেক বক্তব্য করেছেন। এর মধ্যে একজন হলেন, ভারতের মণিপুর ও ঝড়ত্থ রাজ্যের সাবেক গভর্নর বেদ মারওয়া। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছিলেন, আমি আমার কর্মজীবনে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজিব গান্ধীসহ অনেক ক্যারিশমেটিক বিশ্বনেতার সঙ্গে মিশেছি কিন্তু আমি অবশ্যই বলব যে, তার মধ্যে তিনি (শেখ মুজিবুর রহমান) ছিলেন সবচেয়ে ক্যারিশমেটিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। তার দীর্ঘদিনের নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি অনুপ্রাণিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ তথা পাকিস্তানি আধিপত্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার নাগপাশ থেকে মুক্তি করেছে আমাদের স্বদেশভূমিকে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্যোক্তা বঙ্গবন্ধু মুজিব ছিলেন আদর্শে জাতীয়তাবাদী ও বিশ্বাসে গণতন্ত্রী। তাইতো তিনি কর্মী থেকে হয়েছেন নেতা আর নেতা থেকে হয়েছেন জননেতা। দেশনেতা থেকে হয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে একটি দলের নেতা থেকে হয়েছেন দেশনায়ক।
শেখ মুজিবুর রহমান স্কুলজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। কৈশোরেই জানান দিয়েছিল তার গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর বিচক্ষণতার। যা পূর্ণতা পায় পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার কৈশোরের রাজনীতির দীক্ষাগুরু এবং কৈশোরেই বঙ্গবন্ধুর কারাবাস। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদান করায় তিনি জীবনে প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার হন।
ম্যাট্রিক পাসের পর কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে অধ্যায়নকালে বঙ্গবন্ধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন প্রথম কাতারের রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন এবং ছাত্র যুবনেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কলকাতার কলেজ জীবনে বঙ্গবন্ধু এ উপমহাদেশের রাজনীতির স্বাভাবিক আবর্তে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন, বাঙালি আসলে স্বাধীনতা লাভ করেনি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলাভের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের হাতবদল হয়েছে মাত্র। এ উপলব্ধি নিয়ে কলকাতা থেকে ঢাকা ফিরে বঙ্গবন্ধু নতুন রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা নিয়ে অগ্রসর হন। প্রথমদিকে আত্মপ্রকাশ করে ছাত্রলীগ পরে আওয়ামী লীগ।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ষাটের দশকে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ’৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্রজনতা তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়। ১৯৭০-এর নির্র্বাচনে বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পক্ষে জানায় অকুণ্ঠ সমর্থন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির এ নির্বাচনী বিজয়কে মেনে নেয়নি।
বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলনে এবং চূড়ান্তু পর্বে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ দিয়ে ১৯৭১-এর মার্চে শুরু করেন নজিরবিহীন এক অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করলে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন থেকে ওয়্যারলেসযোগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বাংলার মাটি থেকে শেষ হানাদারটিকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ অব্যাহত রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাধীনতা ঘোষণা ও বিদ্রোহের অপরাধে সেখানে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে শুরু হয় গোপন বিচার। কোনো কিছুরই তাঁর দৃঢ়চেতা সংগ্রামী মনোভাবকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বীর বাঙালি ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে বিজয়ীর বেশে প্রত্যাবর্তন করেন স্বদেশভূমি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে।
বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ছিল গণমানুষের সুখ সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক গভীর মানবিক সংগ্রামী দর্শন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন অনুযায়ী গণমানুষের মুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, যেখানে সাংবিধানিকভাবেই ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ (সংবিধান অনুচ্ছেদ ৭)’। এ দর্শনের স্পষ্ট প্রতিফলন হলো তার স্বপ্ন- সোনার বাংলার স্বপ্ন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানের স্বপ্ন, শোষণ-বঞ্চনা- দুর্দশামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি ইতিহাসে কালিমাদিপ্ত একটি শোকাবহ দিন। এই দিন বাঙালির বাংলাদেশের স্থপতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের অনেক সদস্যকে হত্যা করেন দেশের কুচক্রী কিছু সেনাসদস্য। কিন্তু দেশের জন্য তাঁর ভালোবাসা আর কালজয়ী নেতৃত্ব যুগে যুগে তাঁকে করে তুলেছে এক অবিসংবাদিত নেতা। তাই তো শৈর্যে, বীর্যে, চেতনায়, নেতৃত্বে বাঙালি আজো তাঁকে স্মরণ করেন শ্রদ্ধার সঙ্গে।