প্রতিবেদন

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্পায়ন এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বৈষম্য হ্রাসকরণ

জাতিসংঘ সারাবিশ্বের উন্নয়ন টেকসই করতে ১৭টি লক্ষ্য (এসডিজি) নির্ধারণ করেছে। প্রতিটির ক্ষেত্রে রয়েছে আবার একাধিক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। উত্তরণের গত তিন সংখ্যায় লক্ষ্য ১-৭ তুলে ধরা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮ম, ৯ম ও ১০ম লক্ষ্য হচ্ছে : সবার জন্য টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা; মজবুত অবকাঠামো নির্মাণ, টেকসই শিল্পায়ন ও নতুন উদ্ভাবনের পৃষ্ঠপোষণ এবং নিজের দেশের মধ্যে এবং এক দেশের সাথে অন্য দেশের মধ্যকার বৈষম্য হ্রাসকরণ। এ সম্পর্কে এবারের আলোচনা।

লক্ষ্য-৮ : সবার জন্য টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা
আনুমানিকভাবে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এখনও দিনে ২ ডলার বা সমপরিমাণ অর্থে জীবনযাপন করে। অনেক জায়গায় চাকরি দারিদ্র্যতা দূরীকরণ নিশ্চিত করে না। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে এই ধীর এবং অসমান অগ্রগতি দূর করতে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি পুনর্বিবেচনা ও পুনঃসজ্জিতকরণ প্রয়োজন।
টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিভিন্ন সমাজের প্রয়োজন হবে পরিবেশের ক্ষতি না করে অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করার অবস্থা তৈরি করা, যাতে মানুষ মানসম্মত চাকরি পায়। কর্মক্ষম সব মানুষের জন্য চাকরির সুযোগ ও ভালো কাজের পরিবেশ প্রয়োজন।

তথ্য ও উপাত্ত
* বৈশ্বিক বেকারত্ব ২০০৭-এ ১৭০ মিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১২ সালে ২০২ মিলিয়নে পৌঁছেছে, যার মধ্যে ৭৫ মিলিয়ন তরুণ ও তরুণী।
* প্রায় ২২০ কোটি মানুষ দিনে ২ ডলারে জীবিকা নির্বাহ করে। শুধু ভালো বেতনের স্থায়ী চাকরিই কেবল দারিদ্র্যতা দূর করতে পারে।
* ২০১৬ থেকে ২০৩০-এর মধ্যে নতুন চাকরি প্রার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে ৪৭০ মিলিয়ন চাকরির প্রয়োজন হবে।

লক্ষ্য-৮ এর অধীনে টার্গেটসমূহ
* জাতীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী বার্ষিক মাথাপিছু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে হবে এবং বিশেষভাবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বার্ষিক প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ৭ শতাংশে রাখতে হবে।
* পণ্য বহুমুখীকরণ, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, উচ্চমান ও শ্রমঘন খাতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে উচ্চতর অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা অর্জন করা।
* উৎপাদনশীল কার্যক্রম, মানসম্মত চাকরি সৃষ্টি, উদ্যোক্তা তৈরি, সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনকে সহায়তা দিয়ে এবং আর্থিক সেবা সহজলভ্য করাসহ ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি মাপের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে উন্নয়নমুখী নীতির প্রসার ঘটানো।
* উন্নত দেশগুলোর নেতৃত্বে ১০ বছর মেয়াদি স্থায়িত্বশীল ভোগ ও উৎপাদন সম্পর্কিত কর্মসূচি কাঠামো অনুসরণ করে ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক সম্পদের দক্ষ ব্যবহার ও উৎপাদন এবং পরিবেশের অবনতি ঘটানো থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে পৃথক করার প্রচেষ্টার অগ্রসরমান উন্নয়ন ঘটানো।
* ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিবন্ধী মানুষসহ সব নারী ও পুরুষের জন্য সমমূল্যের কাজের জন্য সমান পারিশ্রমিকে মানসম্মত কর্ম পরিবেশে পূর্ণ এবং উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
* ২০২০ সালের মধ্যে চাকরি, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত নেই এমন যুবদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা।
* শিশুসেনা নিযুক্ত ও ব্যবহারসহ জবরদস্তিমূলক শ্রম, আধুনিক দাসত্ব ও মানবপাচার দূরীকরণে এবং নিকৃষ্টতম শিশুশ্রম নিষিদ্ধ ও অপদমনে আশু ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম বন্ধ করা।
* প্রবাসী শ্রমিকসহ, বিশেষ করে মহিলা প্রবাসী শ্রমিক এবং যারা নিরাপত্তাহীন চাকরিতে লিপ্ত তারাসহ সব শ্রমিকের শ্রম অধিকারের নিরাপত্তা ও নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করা।
* ২০৩০ সালের মধ্যে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং স্থানীয় সংস্কৃতি ও পণ্যের উন্নতি বর্ধন করে এমনভাবে পর্যটন শিল্পের স্থায়িত্বশীল উন্নতি বিধানে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
* স্বদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের দক্ষতা বৃদ্ধি করে ব্যাংকিং, ইনসিওরেন্স ও আর্থিক সেবার পরিধি বিস্তৃত করে সবার কাছে সেবা পৌঁছে দিতে উৎসাহিত করা।
* স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে বাণিজ্যবিষয়ক কৌশলগত সহায়তার জন্য পরিবর্ধিত সমন্বিত কাঠামোর মাধ্যমসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়তা বাড়ানো।
* ২০২০ সালের মধ্যে যুবদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক কৌশলপত্র প্রণয়ন ও কার্যকর করা এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এষড়নধষ ঔড়নং চধপঃ বাস্তবায়ন করা।

লক্ষ্য-৯ : মজবুত অবকাঠামো নির্মাণ, টেকসই শিল্পায়ন এবং নতুন উদ্ভাবনের পৃষ্ঠপোষণ
টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন ও বিভিন্ন দেশ ও জনপদের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো যেমনÑ যাতায়াত ব্যবস্থা, সেচ ব্যবস্থা, শক্তি এবং তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ অপরিহার্য। এটা সর্বজন বিদিত যে, উৎপাদন ও আয়ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ প্রয়োজন। ইনকুসিভ এবং টেকসই শিল্পোন্নয়ন আয়ের প্রাথমিক উৎস, যা দ্রুত মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে এবং পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে সহায়তা করে। প্রযুক্তিগত উন্নতি পরিবেশগত বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন যেমনÑ সম্পদ বৃদ্ধি, শক্তির সুষ্ঠু ব্যবহার ইত্যাদির ভিত্তি। প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উদ্ভাবন ব্যতীত শিল্পায়ন সম্ভব নয় আবার শিল্পায়ন ব্যতীত উন্নয়নও সম্ভব নয়।
তথ্য ও উপাত্ত
* এখনও অনেক উন্নয়নশীল দেশে রাস্তা, তথ্য ও যোগাযোগ সংক্রান্ত প্রযুক্তি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের মতো মৌলিক অবকাঠামো অপ্রতুল।
* উন্নয়নশীল বিশ্বেও প্রায় ২.৬ বিলিয়ন মানুষ পুরোপুরিভাবে বিদ্যুৎ সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হয়।
* বিশ্বব্যাপী ২.৫ বিলিয়ন মানুষ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ পানির অভাবে ভুগছে, তাদের মধ্যে অসংখ্য মানুষ সাব-সাহারান আফ্রিকার বাসিন্দা।
* ১-১.৫ মিলিয়ন মানুষ নির্ভরযোগ্য ফোনসেবা থেকে বঞ্চিত।
* মানসম্মত অবকাঠামো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের সাথে ধনাত্মকভাবে সম্পর্কিত।
* অপর্যাপ্ত অবকাঠামো বাজার, কর্মসংস্থান, তথ্য ও প্রশিক্ষণে অভিগম্যতার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা; যা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
* অনুন্নত অবকাঠামো স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগ সীমিত করে।
* বহু আফ্রিকান দেশ, বিশেষত যেসব দেশের আয় অত্যন্ত কম, তাদের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হয়।
* কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ম্যানুফেকচারিং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত; ২০০৯ সালে এক্ষেত্রে প্রায় ৪৭০ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হয়েছে, যা ২.৯ বিলিয়ন শ্রমশক্তির প্রায় ১৬ শতাংশ। ধারণা করা হয়, ২০১৩ সালে এই সংখ্যা অর্ধ বিলিয়নেরও বেশি ছিল।
* শিল্পায়নের ফলে চাকরির নানাবিধ ইতিবাচক প্রভাব সমাজে পড়বে। প্রতি একজন তৈরি কার্যক্রমে পারদর্শী এবং ২.২ জনের নানাবিধ চাকরির সুযোগ হবে।
* ক্ষুদ্র এবং মধ্য পর্যায়ের উদ্যোক্তার সক্রিয় হবে শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণে এবং উৎপাদকরা শিল্পায়নের প্রথম পর্যায়ে অধিকমাত্রায় সংকটাপন্ন হবে এবং তারা সাধারণত ব্যাপক চাকরির ক্ষেত্র সৃষ্টি করবে। তারা ৯০ শতাংশ পরিমাণ বিশ^ব্যাপী ব্যবসা এবং এর মাধ্যমে ৫০-৬০ শতাংশ পরিমাণ চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করবে।
* স্বল্পোন্নত দেশগুলোর খাদ্য ও পানীয় (কৃষিশিল্প) এবং বস্ত্র ও পোশাকশিল্প ক্ষেত্রে ভালো সম্ভাবনা আছে, যা টেকসই কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক।
* মধ্যম আয়ের দেশগুলো বেসিক ও ফেব্রিকেটেড মেটাল ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশের মাধ্যমে লাভবান হতে পারে কারণ এর আন্তর্জাতিক চাহিদা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
* উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কৃষি উৎপাদনের খুব বেশি হলে ৩০ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত করা হয়, যেখানে উন্নত দেশগুলোতে এর হার ৯৮ শতাংশ। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কৃষি ব্যবসার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে।

লক্ষ্য-৯ এর অধীনে টার্গেটসমূহ
* অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানব কল্যাণের স্বার্থে আঞ্চলিক ও আন্তঃসীমান্ত অবকাঠামোসহ মানসম্মত, নির্ভরযোগ্য, টেকসই ও মজবুত অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে, যা হবে সাশ্রয়ী এবং যা সবাই সমানভাবে ব্যবহার করতে পারবে।
* ইনকুসিভ ও টেকসই শিল্পায়নের ওপর জোর দিতে হবে; যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে জাতীয় পরিস্থিতির সাথে সংগতি রেখে কর্মসংস্থান ও মোট জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে শিল্প খাত উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে যাতে এর অবদান দ্বিগুণ হয়।
* উন্নয়নশীল দেশের ক্ষুদ্র শিল্প ও অন্যান্য উদ্যোগের ক্ষেত্রে আর্থিক সেবা, সহজলভ্য ঋণ ও বাজার ব্যবস্থায় অভিগম্যতা বাড়াতে হবে।
* ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই শিল্পায়নের লক্ষ্যে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং বহুলভাবে নির্মল ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও শিল্প প্রক্রিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প অবকাঠামোর উন্নতি করতে হবে; এই লক্ষ্যে সব দেশের নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
* সকল দেশে বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও শিল্পক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত ক্ষমতা বাড়াতে হবে; ২০৩০ সালের মধ্যে নতুন উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে হবে, সাথে সাথে প্রতি মিলিয়নে গবেষণা ও উন্নয়নকর্মীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এবং সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে।
* আফ্রিকান, স্বল্পোন্নত, স্থলবেষ্টিত এবং উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রসমূহে আর্থিক, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সহজতর করতে হবে।
* উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দেশজ প্রযুক্তির উন্নয়ন, গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং শিল্প বৈচিত্র্যতা ও পণ্যের মান বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন ও পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করা হবে।
* উল্লেখযোগ্য হারে তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ বৃদ্ধি এবং ২০২০ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে স্বল্প মূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি।

লক্ষ্য-১০ : নিজের দেশের মধ্যে এবং এক দেশের সাথে অন্য দেশের মধ্যকার বৈষম্য হ্রাসকরণ
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পৃথিবীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যমুক্ত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। স্বল্পোন্নত, স্থলবেষ্টিত এবং উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র যারা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত তারাও দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে ক্রমাগত অগ্রসর হচ্ছে। তারপরও সমাজে বৈষম্য বিদ্যমান বিশেষত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সম্পদের অধিকারের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য আরও প্রকট।
উপরন্তু, বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক আয় বৈষম্য হ্রাস পেলেও দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ আয় বৈষম্য বেড়েছে। ক্রমে সবাই এ বিষয়ে একমত হচ্ছে যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য শুধু দারিদ্র্য হ্রাসকরণ পর্যাপ্ত নয়, যদি না এতে টেকসই উন্নয়নের ৩টি মাত্রা তথা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত এই ৩টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত না থাকে।
বৈষম্য কমাতে সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে সার্বজনীন নীতি প্রণয়ন করতে হবে।

তথ্য ও উপাত্ত
* জনসংখ্যার আকার অনুযায়ী ১৯৯০-২০১০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আয় বৈষম্য গড়ে ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
* উন্নয়নশীল দেশগুলোর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পরিবার যা মোট জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ, ১৯৯০ সালের চেয়েও বেশি আয় বৈষম্যপূর্ণ সমাজে বসবাস করে।
* ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্য কোনো অনিবার্য বিষয় নয়; দেখা গেছে বিভিন্ন দেশ শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি অর্জনের সময় আয় বৈষম্য নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে।
* বৈষম্যের অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করা না গেলে আয় বৈষম্য কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা যাবে না।
* জাতিসংঘ পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক জরিপ থেকে জানা যায়, সারাবিশ্বের নীতি-নির্ধারকরা এটা স্বীকার করেছেন যে, তাদের দেশে সাধারণভাবে উচ্চ হারে বৈষম্য বিদ্যমান, যা দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে হুমকিস্বরূপ।
* এটা প্রমাণিত যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ২০ শতাংশ দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর মাঝে পাঁচ বছরের নিচের শিশুমৃত্যুর সম্ভাবনা ধনী জনগোষ্ঠীর ৩ গুণ।
* সামাজিক সুরক্ষা বিশ্বব্যাপী বাড়ানো হয়েছে, তবু এখনও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসা ব্যয়ভারে জর্জরিত হওয়ার সম্ভাবনা ৫ গুণ বেশি।
* যদিও অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে মাতৃমৃত্যু হার কমেছে, তবু এখনও জন্মদানের সময় মাতৃমৃত্যুর সম্ভাবনা শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে ৩ গুণ বেশি।

লক্ষ্য-১০ এর অধীনে টার্গেটসমূহ
* ২০৩০ সালের মধ্যে জনসংখ্যার দরিদ্রতম ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর আয় জাতীয় আয়ের তুলনায় অধিক হারে ক্রমবর্ধমান ও টেকসইভাবে বৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন।
* ২০৩০ সালের মধ্যে বয়স, লিঙ্গ, প্রতিবন্ধিতা, জাতীয়তা, আদিবাসীতা, ধর্ম, অর্থনীতি ও অন্যান্য যে কোনো সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সবার ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণ নিশ্চিত করা।
* সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতকরণ ও বৈষম্য দূরীকরণের জন্য বৈষম্যমূলক আইন, নীতি ও প্রথা বাদ দিতে হবে এবং যথাযথ আইন, নীতি ও কর্মপন্থা প্রণয়ন করতে হবে।
* সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের নীতি, বিশেষত অর্থনৈতিক, মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি নীতি গ্রহণ করতে হবে।
* বিশ্ব অর্থবাজার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং ব্যবস্থা উন্নীতকরণ এবং তার জোরদার বাস্তবায়ন।
* আরও বিশ্বাসযোগ্য, জবাবদিহিমূলক ও আইনসিদ্ধ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলো যাতে তাদের মতামত রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
* সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বৈধ, নিরাপদ ও নিয়মিত অভিবাসন নিশ্চিতকরণ।
* বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তি মোতাবেক উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ।
* স্বল্পোন্নত, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ও স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্রগুলোর উন্নয়নে তাদের জাতীয় পরিকল্পনা ও কর্মসূচির সাথে সংগতি রেখে উন্নয়ন সহযোগিতা, বিদেশি বিনিয়োগ ইত্যাদি উৎসাহীকরণ।
* ২০৩০ সালের মধ্যে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ ৩ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা এবং ৫ শতাংশের বেশি ব্যয়বহুল রেমিট্যান্স করিডর বাদ দেওয়া।

গ্রন্থনা : রাজীব পারভেজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *