প্রতিবেদন

অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার পায়রা বন্দর

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার এবং দেশে সুষম ও টেকসই উন্নয়নে সমুদ্রবন্দরের ভূমিকা অতুলনীয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে ১০টি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে তার মধ্যে অন্যতম একটি ‘পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর’। পায়রাকে পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশের সমুদ্রবন্দর রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। তৃতীয় বিশ্বের দ্রুত অগ্রসরমান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সমুদ্রবন্দরের সম্প্রসারণ, আধুনিকায়ন ও এর সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সেই উন্নয়নের ধারাটিকে আরও বেগবান করা সম্ভব।
২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নে রাবনাবাদ চ্যানেলের পশ্চিম তীরে ১৬ একর জমির ওপর পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয়। পায়রা বন্দরকে ঘিরে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল সরকার। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরে শুধু জেটি নয়, থাকবে মোট ২০ ধরনের অবকাঠামো। পায়রা বন্দরে টার্মিনাল-জেটির পাশাপাশি তেল শোধনাগার, বিদ্যুৎকেন্দ্র, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, অর্থনৈতিক অঞ্চল, এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট অঞ্চল, বিমানবন্দর এবং জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের ব্যবস্থাও থাকবে।
১ হাজার ১২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের মধ্যে এই সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এরই মধ্যে বাংলাদেশের তৃতীয় বাণিজ্যিক সমুদ্রবন্দর হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে ‘পায়রা’। পদ্মাসেতু নির্মাণের পর এই সমুদ্রবন্দরটি দক্ষিণ জনপদের অর্থনীতির চিত্র পুরোই বদলে দেবে। ইতোমধ্যেই পায়রা বন্দরকে ঘিরে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ শুরু হওয়ায় পাল্টে যাচ্ছে উপকূলীয় মানুষের জীবনযাত্রা। এই বন্দরকে ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে এতদাঞ্চলের অবহেলিত মানুষ।
ট্রানজিট সুবিধার আওতায় এই বন্দর ব্যবহার করতে পারবে ভারত, নেপাল ও ভুটান। অন্যদিকে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক করিডর বিসিআইএম’র প্রাণকেন্দ্রও হয়ে উঠবে এই বন্দর। ফলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পায়রা সমুদ্রবন্দর অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হবে। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের সুবিধা হলো, এখানে জোয়ার-ভাটা ২৪ ঘণ্টা বিদ্যমান এবং পানির গভীরতাও বেশি। ফলে সরাসরি মাদার ভ্যাসেল হতে জেটিতে পণ্য খালাস সম্ভব। পায়রা বন্দরে গভীর সমুদ্রে বিচরণক্ষম ৮-১০ ড্রাফটের জাহাজ ধারণ করতে পারবে, যে সুযোগ চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে নেই। চট্টগ্রামের চেয়ে এখান থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব কম হওয়ায় হ্রাস পাবে অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যয়।
বন্দর নির্মাণের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১৬ একর জায়গা মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। রাবনাবাদ নদ ঘেঁষা বন্দরকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করতে প্রায় ১ হাজার মিটার নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। বন্দরে নির্বিঘেœ রাতেও কর্মসম্পাদনের জন্য বসানো হয়েছে ৭০টি সৌরবিদ্যুৎ স্ট্রিট লাইট। বসানো হয়েছে সিগন্যাল বাতি। পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়ানোর জন্য ৩টি পন্টুন বসানোসহ সংযোগ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। পন্টুনে পণ্য ওঠা-নামানোর জন্য ভারী দুটি ক্রেন বসানো হয়েছে। বন্দরে ভারী যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য ক্রয় করা হয়েছে দুটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর। বন্দরের নিরাপত্তার জন্য সেন্ট্রি পোস্টসহ নিরাপত্তা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বন্দরকে আধুনিকায়ন করতে কলাপাড়ার ধানখালীতে নির্মাণ হচ্ছে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এই টার্মিনালে যেমন গুদাম থাকবে তেমনি মালামাল আনা-নেওয়ারও ব্যবস্থা থাকবে। ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে আরও দুটি কন্টেইনার টার্মিনাল হবে।
প্রতিবছর ৪০ মিলিয়ন টন কয়লা রাখা যাবে এমন স্থানের জন্য ৫০০ একর জমি বরাদ্দ করা হবে। এই বাল্ক টার্মিনালটি ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ হবে। এখানে কয়লাভিত্তিক ৮টির মতো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হবে। পায়রায় একটি এলএনজি টার্মিনাল হবে। সরকার একটি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন করবে এবং এজন্য ২ হাজার একর ভূমি বরাদ্দ দেওয়া হবে।
এরই মধ্যে পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড় রেল প্রকল্প ২৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন স্থাপনের জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও ব্রিটিশ কোম্পানি ডিপি রেল লিমিটেড ইউকে’র মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই রেলপথের মাধ্যমে বছরে প্রায় ২০ লাখ ইউনিট কনটেইনার পরিবহন সম্ভব হবে।
এই বন্দর পূর্ণাঙ্গ চালু হলে এখানে সার কারখানা, জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ ভাঙা কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। পায়রা বন্দরকে ঘিরে পর্যটনের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। জাতির পিতার ওপর এখানে একটি স্মৃতিসৌধ বা ভাস্কর্য নির্মাণ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ভবন নির্মাণ, ইকো পার্ক প্রতিষ্ঠা, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ, শুধু বিদেশিদের জন্য ট্যুরিস্ট জোন প্রতিষ্ঠা, মেরিন ড্রাইভ, মেরিন পার্ক, সি একুরিয়াম প্রতিষ্ঠা, আন্তর্জাতিকমানের স্টেডিয়াম প্রতিষ্ঠা, গলফ ও টেনিস কোর্ট প্রতিষ্ঠা, কনভেনশন সেন্টার হোটেল মোটেল জোন প্রতিষ্ঠা, শপিংমল, পিকনিক স্পটসহ অন্যান্য বিনোদনমূলক অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে একটি বহুমুখী টার্মিনাল প্রতিষ্ঠা করা হবে।
পদ্মাসেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে পায়রা বন্দরই হবে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। জিটুজি সহযোগিতায় এটি ২০১৮ সালের মধ্যে সমাপ্ত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *