আইএস ও খিলাফত
একবিংশ শতাব্দীর উষালগ্নে ইসলামি পুনরুত্থানের (জরারাধষরংস) সমস্যা একটি মাত্র মুসলিম প্রধান দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ বা ধর্মীয় চরমপন্থা এবং রাজনৈতিক ইসলামের সমস্যা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটি একটি আন্তর্জাতিক প্রপঞ্চ। জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান জনগোষ্ঠীর অনুসৃত ধর্ম ইসলাম। বর্তমানে বিশ্বে মুসলমান জনসংখ্যা ১.৬ বিলিয়ন। পৃথিবীর মোট মুসলমান জনসংখ্যার ৬২ শতাংশ বাস করে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে। পৃথিবীর ৫৬টি দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও ভারত হচ্ছে মুসলিম জনসংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় স্থানে। এ রকম বেশ কিছু দেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হলেও তাদের অবস্থান দ্বিতীয় স্থানে। সংখ্যার দিক থেকেও তারা উল্লেখযোগ্য। ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং ভারতের মোট মুসলমান জনসংখ্যার পরিমাণ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। এশিয়া ও আফ্রিকা মুসলমান প্রধান দেশগুলোর মধ্যে ধর্মভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে রয়েছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান ও সুদান। বর্তমানে মুসলমান প্রধান দেশগুলোর কোনো কোনোটিতে ইসলামি জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠনের তৎপরতা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটা একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের কাজ। মুসলমান প্রধান দেশগুলোয় ইসলামের নাম করে বিভেদ ও সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা এবং এসব দেশের স্থিতিশীলতা নষ্টের পেছনে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী মহলের উসকানি রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। সর্বশেষ খিলাফত প্রতিষ্ঠার নামে আইএসআইএসের উত্থান নতুন প্রপঞ্চ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এ কথা সবাই জানে যে, আফগান সীমান্ত থেকে বহু দূরে পাকিস্তানের এবোটাবাদ শহরের গোপন আস্তানায় হামলা চালিয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সংগঠন আল-কায়দার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে জীবন্ত গ্রেফতার করে মার্কিনীরা হত্যা করে। ২০১১ সালের ২ মে তার মরদেহ অজানা সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে তার চিহ্ন মুছে দেয়।
ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার ভেতর দিয়ে দৃশ্যত আল-কায়দা এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের হার্টকোর ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকেই আমরা জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ ও রক্ষণশীল অভিপ্রকাশ দেখতে পাই যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইরাক ও সিরিয়ায়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কে ওসমানিয়া (অটোমান) খিলাফতের অবসানের পর এবার কেবল পাকিস্তান বা ইরানের মতো ইসলামি রাষ্ট্র নয়, ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে সিরিয়া ও ইরাকের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত আইএসআইএস বা ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠাকামীদের দখলে। এটা একটা অভিনব ঘটনা।
অতীতে আয়েতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইরানি বিপ্লবে খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল না। তারা ইরানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছে। খিলাফত প্রতিষ্ঠার ধারণা আল-কায়দার থাকলেও তালেবানি রাজত্বকালেও আফগানিস্তানে খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়নি। এমনকি ‘আরব বসন্তের’ উপজাত মিসরের ইতিহাসের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসি বা তার দলও খিলাফত ঘোষণার কথা বলে নি। ব্রাদারহুড ইসলামি অনুশাসন ও কট্টর গোড়ানীতি গ্রহণ করলেও মধ্যযুগীয় সামন্ত্রতান্ত্রিক ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার আওয়াজ তোলে নি।
ইরাক ও সিরিয়ার বেশির ভাগ রক্তপাতের হোতা অতি উগ্র হিং¯্র সন্ত্রাসী গ্রুপ নিজেদের Islamic State of Iraq and al-sham (Syria) তথা ISIS পরিচয় দিয়ে ইরাক ও সিরিয়ার তৈল সমৃদ্ধ বিরাট এলাকা দখল করে নেয়। তারা ইরাকে আবার খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করে।
প্রকৃতপক্ষে আইএসআইএস আল-কায়দার ফর্মুলা গ্রহণ করে বিরাট এক সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলে। তবে আল-কায়দা ও মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যর্থতার পটভূমিতে ২০১৪ সালের ২৯ জুন আইএসআইএস আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামিক রাষ্ট্র ও খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। আবু বকর আল-বাগদাদীকে খলিফা তথা রাষ্ট্রপ্রধান এবং আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘোষণা সমগ্র ইসলামিক জগতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে।
আইএসআইএস বা তথাকথিত ইসলামি খিলাফত ইরাক ও সিরিয়ার যেসব অঞ্চল দখল করেছিল তার আয়তন প্রায় ৩৫ হাজার বর্গমাইল, যা প্রায় জর্ডানের সমান। সেখানে বসবাস করত মোটামুটি ৮ মিলিয়ন বা ৮০ লাখ মানুষ। আইএসআইএসের রয়েছে ৩৫ হাজার যুদ্ধবাজ জিহাদি। (সূত্র : নিউজ উইক, ৬ নভেম্বর, ২০১৪, http : //www.newsweek.com/2014/11/14)
আইএসের সন্ত্রাসীরা অধিকৃত অঞ্চলে এক মধ্যযুগীয় বর্বর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। তারা কার্যত শরিয়া আইনের নামে চরম ফ্যাসিবাদী ও মানবাধিকারের পরিপন্থী শাস্তির বিধান, দাসশ্রমের প্রচলন, নারীদের ওপর পাশবিক গণধর্ষণ ও প্রচ- নির্যাতনমূলক কর্মকা- চালাচ্ছে। ইরাকের কয়েকটি তৈলক্ষেত্র দখল করে সস্তায় অপরিশোধিত তেল বিক্রি করে যে অর্থ সংগ্রহ করছে, তাই দিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ এবং খিলাফতের বাহিনী পরিচালনা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১৫-১৬ এর মধ্যে সিরিয়ায় রাশিয়া এবং ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইএসআইএস-বিরোধী বেশ কয়েকটি নির্মূল অভিযান পরিচালনা করে। এসব অভিযানের ফলে আইএসআইএসের দখল থেকে বেশ কয়েকটি বড় বড় শহর এবং অঞ্চল পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। ফলে তাদের দখলিকৃত খিলাফতের আয়তন সংকোচিত হয়ে আসছে।
আইএসের অনুসারীরা হচ্ছে সুন্নী মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে উগ্র ‘সালাফি’ মতাদর্শের অনুসারী জিহাদি। এই সালাফি জিহাদিরাই নিজেদের হযরত মুহম্মদ (সঃ) এবং সপ্তম শতাব্দীর আদি খিলাফতের অনুসারী মনে করে। তারা আধুনিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে কঠোর শরিয়া আইন প্রবর্তন এবং তাদের খিলাফতের ভাবধারা সর্বত্র বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে।
আইএসআইএসের উত্থানের পেছনের কার্যকারণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই, এটিও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইরাকে সাদ্দাম-বিরোধী মার্কিন অভিযান, দখলদারিত্ব এবং গৃহযুদ্ধের সময়ই একদার সেকুলার এই দেশটিতে উগ্রপন্থার জন্ম নেয়। স্বঘোষিত খলিফা আবু বকর আল বাগদাদী মার্কিন দখলদারিত্বের আমলেই একটি শিয়া-বিরোধী জিহাদি গোষ্ঠী গড়ে তোলেন এবং জঙ্গি তৎপরতার জন্য মার্কিন সেনাদের হাতে বন্দী হন। বন্দী শিবিরেই তার সাথে আল-কায়দার যোগাযোগ গড়ে ওঠে। যেমন, ওসামা বিন লাদেন ও আল-কায়দা গড়ে তোলার পেছনে মার্কিনী ইন্ধন ছিল, তেমনি আইএসআইএস সৃষ্টির পেছনেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা এবং মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের অন্তর্ঘাতমূলক স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ থাকাও বিচিত্র নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প অন্য প্রার্থী ডেমোক্র্যাট দলের একসময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারির মধ্যপ্রাচ্য নীতির সমালোচনা প্রসঙ্গে আইএসআইএস সৃষ্টির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার কথা প্রকারান্তরে ফাঁস করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার পেছনেও আইএসআইএসের ভূমিকা রয়েছে বলে পশ্চিমা দেশগুলো বারবার বলে আসছে। এমনকি আইএসআইএসের অনলাইন থেকেও একাধিক জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশে আইএসআইএসের তৎপরতার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। সরকার সুস্পষ্টভাবে বলেছে, বাংলাদেশের সর্বশেষ জঙ্গি হামলাগুলোর পেছনে রয়েছে নয়া জেএমবি নামক স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা জঙ্গি সংগঠনের। প্রকৃতপক্ষে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে অতীতের আল-কায়দা নেটওয়ার্কের মতোই আইএসআইএসের নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে বলে পশ্চিমা দেশগুলো প্রচার চালাচ্ছে। ওই প্রচারণার সত্যতা যাচাই সাপেক্ষ। তবে আইএসআইএস সৃষ্টির সাথে যদি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা থেকে থাকে, তা হলে তারা যে (মার্কিনীরা) এসব দেশে আইএসআইএস রপ্তানির চেষ্টা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। বিশ্বব্যাপী মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে যদি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির কোনো পাঁয়তারা যুক্তরাষ্ট্র করে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
নূহ-উল-আলম লেনিন