আওয়ামী লীগের ৬৮ বছর ও বাঙালির হিরণ্ম অর্জন
অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন: সংগ্রাম-গৌরবের পতাকাবাহী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৬৮ বছর অতিক্রম করতে চলেছে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কেএম দাশ লেনের ‘রোজ গার্ডেন’-এ এক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠলগ্নে এই দলের নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। দলীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণের মাধ্যমে ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করা হয়। জন্মলগ্ন থেকে অদ্যাবধি এই দল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দান, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক অগ্রগতিসহ বাঙালির যা কিছু অর্জন সবই সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে।
সাম্প্রদায়িক ও অবৈজ্ঞানিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি পৃথক ভূ-খ- নিয়ে কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠিত হয়। এই দুই অংশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি এমনকি নৃতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে কোনো মিল ছিল না। অচিরেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেÑ রাষ্ট্রভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রশ্নে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে অস্বীকৃতি জানিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছাত্রসমাজ, সংস্কৃতিসেবী, বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় তীব্র ক্ষোভ। এরই পটভূমিতে তরুণ সংগ্রামী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণায় আত্মপ্রকাশ করে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। এই ছাত্র সংগঠনই বাঙালির সকল জাতীয় আন্দোলনে সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে আসছে।
একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া সাধারণ মানুষের মুক্তি সম্ভব নয়Ñ এ উপলব্ধি থেকেই বাঙালির অধিকার আদায়ের বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষে আওয়ামী লীগকে একটি শক্তিশালী ও গণমুখী দল হিসেবে গড়ে তোলেন।
১৯৪৮ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন ১৯৫২ সালে গণজাগরণে পরিণত হয়। অব্যাহত রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার সংগ্রামী জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান কারাভ্যন্তরে থেকে ভাষা আন্দোলনে পালন করেন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে বলেছেনÑ ‘বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করতে পারলে তাদের দাসত্বের শৃঙ্খল আবার পরতে হবে। মাতৃভাষার অপমান কোন জাতি সহ্য করতে পারে না।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ-১৯৭)
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বীর শহীদদের আত্মদানের ভেতর দিয়ে ভাষা আন্দোলন যৌক্তিক বিজয় অর্জন করে। ভাষা আন্দোলনের বিজয়ের পটভূমিতে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় হয়। তিন জাতীয় নেতা শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট বিজয় লাভ করে। কুটিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও বিভেদ সত্ত্বেও পূর্ব বাংলায় দুই বছরের (৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ থেকে ৭ অক্টোবর ১৯৫৮) আওয়ামী লীগ শাসন এবং কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের এক বছর (১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ থেকে ১৮ অক্টোবর ১৯৫৭) শাসন সৃষ্টি করে গণতন্ত্র বিকাশের বিপুল সম্ভাবনা। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ সময় আওয়ামী লীগ সরকার ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি ঘোষণাসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে।
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে বঙ্গবন্ধুসহ সকল নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমগ্র ছাত্রসমাজ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ দুই দশকের বঞ্চনা, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ১৯৬৫ সালে সংঘটিত পাক-ভারত যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির ৬-দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। ৬-দফার পক্ষে ব্যাপক গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। ১৯৬৮ সাথে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে ১৯৬৯ সালে ৬-দফাভিত্তিক ১১-দফা আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। পতন ঘটে আইয়ুব স্বৈরশাহীর।
জেনারেল ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে নতুন সামরিক জান্তা সার্বজনীন ভোটাধিকার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিণত হন গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে।
নির্বাচনে সকল পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। লক্ষ কোটি মানুষ স্বাধিকারের দাবিতে সমুদ্র গর্জনে রাজপথে নেমে আসে। স্বাধিকার আন্দোলন পরিণত হয় স্বাধীনতা সংগ্রামে। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
২৫শে মার্চ কালরাতে পাকহানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার পরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এক অধিবেশনে মিলিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করেন। একই সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে গঠন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর বলে খ্যাত মেহেরপুর জেলায় বৈদ্যনাথতলার আ¤্রকাননে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে।
দীর্ঘ ৯ মাস লড়াই-সংগ্রামের পর ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও তিন লক্ষাধিক মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। শুরু হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের সংগ্রাম। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে শূন্য হাতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ গড়ার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, কল-কারখানা ও ক্ষেত-খামারের উৎপাদন, ১ কোটি উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুসহ জনগণকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য সকল কর্মপন্থা গ্রহণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্বের কারণে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ভারতীয় মিত্রবাহিনী স্বদেশে ফিরে যায়। মাত্র ৯ মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একটি সংবিধান উপহার দেয়। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি অর্জন করে, সদস্যপদ অর্জন করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার। মাত্র সাড়ে তিন বছরে ধ্বংসস্তূপ থেকে যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশ যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, ঠিক সেই মুহূর্তে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। কারাগারে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। কায়েম হয় অন্ধকারের রাজত্ব। শুরু হয় হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি।
খুনি মোশতাকের অপসারণের পর অস্ত্র হাতে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে। এ সময় আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার-নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জেনারেল জিয়া দেশে চালু করেন ‘কারফিউ গণতন্ত্র’। গণভোট ও নির্বাচনের নামে ভোটব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদ জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন।
১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বৈরাচারবিরোধী নবতর আন্দোলনে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নেয়। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তীব্র আন্দোলনে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। মানুষ আশায় বুক বাঁধে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যাতে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় না আসতে পারেন সেই লক্ষ্যে শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র।
জামাতের সাথে গড়ে ওঠে বিএনপির গোপন আঁতাত। ষড়যন্ত্র ও আঁতাতের অংশ হিসেবে বিএনপি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হয়। আবারও জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় বিএনপি। জনগণের ওপর নেমে আসে তীব্র রাজনৈতিক নিপীড়ন ও দমননীতি। ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য খালেদা সরকার ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মানুষ গর্জে ওঠে। খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। ২১ বছরের দুঃসহ স্বৈরশাসনের অবসান হয়।
শেখ হাসিনার সরকার জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। সরকারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়। এ সময় গঙ্গা পানি চুক্তি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদন করা হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ সামাজিক ক্ষেত্রে অর্জিত হয় চমকপ্রদ সাফল্য। খাদ্য ঘাটতির দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় ২১শে ফেব্রুয়ারি অর্জন করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরব। আওয়ামী লীগের এই পাঁচ বছরের শাসন আমল জাতীয় জীবনের এক স্বর্ণালি অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম একটি নির্বাচিত সরকার তার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বিএনপি-জামাত জোটের যোগসাজসে কারচুপির মাধ্যমে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনিবার্য বিজয়কে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হত্যা-নির্যাতন, মেয়েদের ওপর পাশবিক নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করে বাংলাদেশকে এক ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছরে শাসন আমলে বাংলাদেশের সামনে যে অমিত সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, বিএনপি-জামাতের দুঃশাসনে সেই সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলকে নেতৃত্ব শূন্য করার জন্য হয় গভীর ষড়যন্ত্র। তারই অংশ হিসেবে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করা হয়। নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। সরকারি মদদে উগ্রসাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী সৃষ্টি করা হয়। বিএনপি-জামাত জোটের সর্বগ্রাসী লুটপাট ও অপশাসনের কারণে ক্ষমতায় আসে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে তাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুগভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
শেখ হাসিনার আপসহীন সাহসী ভূমিকা এবং তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ষড়যন্ত্রকারীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। অবশেষে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পায়। আওয়ামী লীগ সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ ঘোষণা করে। দিনবদলের সনদ ‘রূপকল্প-২০২১’-এর পথ ধরে দেশ পৌঁছে যায় উন্নয়নের মহাসড়কে। এ সময় জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকর করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জনগণের ভোটে আওয়ামী লীগ পুনরায় নির্বাচিত হয়। এ বিজয়ের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের গতিকে চলমান রাখা সম্ভব হয়েছে। সন্ত্রাস, অবরোধ, জঙ্গিবাদের সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা ঘোষণা দিয়েছেন ‘রূপকল্প-২০২১’-এর ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে উন্নত সমৃদ্ধ জনপদ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নি¤œমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নে শীর্ষ পাঁচ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। মানুষের মাথাপিছু আয় আজ ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলার। মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭১.৭ বছর। খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ আজ খাদ্য উদ্বৃত্তের বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
দেশপ্রেমের মহান ব্রত নিয়ে সকল বাধা-বিপত্তি, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, নাশকতা মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সারাদেশে উন্নয়নের যে মহাযজ্ঞ চলছে তার সাথে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে দলের নেতা-কর্মীদের আজ দায়িত্ব নিতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত বিশাল কর্মী বাহিনীই আওয়ামী লীগের মূল শক্তি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘এই সংগঠন সঠিক নেতৃত্ব ও ত্যাগী কর্মী বাহিনী এবং জনসমর্থন পেয়েছে বলেই গৌরবের সাথে শত ষড়যন্ত্র, বাধা অতিক্রম করে বিজয় অর্জন করেছে, স্বাধীনতা এনেছে, পৃথিবীর বিপ্লবের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’
৬৮ বছরের সংগ্রামী অভিযাত্রায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে, রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই ক্ষণে তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী আওয়ামী লীগ অতীতে কখনই ইতিহাস নির্ধারিত ভূমিকা পালনে পিছপা হয়নি। আগামীতেও বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই দল গৌরবের পতাকা বহন করে দেশকে নিয়ে যাবে কাক্সিক্ষত উন্নয়নের স্বপ্নযাত্রায়। আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীদের প্রতি আবেদনÑ আসুন আমরা শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রাখিÑ তার হাতকে শক্তিশালী করি। তিনিই আমাদের নিয়ে যেতে পারবেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায়।
লেখক : তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ