আন্দোলন>Movement
দেশ বা সমাজের সকল মানুষ অথবা কোনো অংশের মানুষ যখন কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে অথবা তাদের বিশেষ কোনো দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে সভা-সমাবেশে মিলিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং এর পাশাপাশি হরতাল, ধর্মঘট ইত্যাদি পালন করে সাধারণভাবে তাকে আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করা হয়। আন্দোলনের মর্মকথা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে জনগণের কোনো না কোনো অংশের সমষ্টিক সচেতন আলোড়ন সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক (ক্ষেত্রবিশেষে অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক) কর্মকা-। আন্দোলনের কোনো ধরাবাধা সংজ্ঞা নেই। তবে আন্দোলনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ১. আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট দাবি-দাওয়া, ইস্যু বা চূড়ান্ত লক্ষ্য; ২. জনগণের অংশগ্রহণ; ৩. আন্দোলনের রূপ; ৪. আন্দোলনের বৈধ ভিত্তি (সাংবিধানিক-আইনগত) এবং ৫. আন্দোলনের পরিধি ইত্যাদি।
আন্দোলনটি বৈপ্লবিক, সংস্কারবাদী নাকি সাধারণ গণতান্ত্রিক তা নির্ভর করে আন্দোলনের দাবি-দাওয়া-লক্ষ্য এবং অংশগ্রহণকারীদের শ্রেণি অবস্থান দ্বারা। যেমন ধরা যাক, কোনো পরাধীন দেশে আন্দোলনের লক্ষ্য যদি হয় পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন, স্বভাবতই এতে দেশের প্রায় সকল মানুষের অংশগ্রহণ বা সমর্থন থাকবে। এক্ষেত্রে আন্দোলনটি হবে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন। আবার ধাপে ধাপে জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করার লক্ষ্যে সরাসরি স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন দাবিও উত্থাপিত হতে পারে। যেমন ভাষা আন্দোলন।
প্রধানত শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক মুক্তির আন্দোলনকে বৈপ্লবিক গণ-আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। শ্রমিক শ্রেণি ও সমাজের অপরাপর শোষিত-বঞ্চিত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের ওপর শোষণ-বঞ্চনা অবসানের লক্ষ্যে যে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে তার বিপ্লবী নির্যাস হলো, পুরাতন রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে ‘শ্রমিক শ্রেণির’ রাজত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। মার্কসবাদীরা বৈপ্লবিক গণ-আন্দোলনে দুটি জিনিস অপরিহার্য মনে করে। প্রথম, উপযুক্ত রণনীতি ও রণকৌশল এবং দ্বিতীয়ত, বিপ্লবের চালিকাশক্তি হিসেবে অগ্রবাহিনীর ভূমিকা পালনে সক্ষম বিপ্লবী পার্টি।
এ দুটি ক্ষেত্রে আন্দোলনের রূপ-শান্তিপূর্ণ অথবা সশস্ত্র এর যে কোনো একটি অথবা দুটিই হতে পারে। এটা নির্ভর করে ঔপনিবেশিক শক্তি অথবা শাসকগোষ্ঠী কীভাবে, শান্তিপূর্ণ পন্থায় না বন্দুকের জোরে আন্দোলন মোকাবিলা করবে তার ওপর। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, নির্বাচন, সামরিক শাসনের অবসান, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বন্দিমুক্তি অথবা রাষ্ট্রব্যবস্থার নানা সংস্কারের দাবিতেও সংসদের ভেতরে অথবা বাইরে হতে পারে গণ-আন্দোলন। এসব দাবি-দাওয়ার সব কয়টি অথবা যে কোনো একটিতেই আন্দোলন সম্ভব। এসব আন্দোলনকে সংস্কারবাদী বা গণতান্ত্রিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও বৈধ সাংবিধানিক ধারার এসব আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। অনেক সময় আন্দোলনের সঙ্গেও রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্ন যুক্ত থাকে। বাংলাদেশে ১৯৯০-এর এরশাদ-বিরোধী আন্দোলন এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। ইংল্যান্ডের চার্টিস্ট আন্দোলন অথবা নেপালে রাজতন্ত্র-বিরোধী আন্দোলন বহুদলীয় বিকাশের পথ উন্মুক্ত করেছিল। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি আন্দোলন। আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন ও ঐতিহ্যবাহী শ্রেণি/পেশাগত আন্দোলন হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। আধুনিক শ্রমিক আন্দোলনের জন্ম ইংল্যান্ডে। বিশ্বে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের বড় অর্জন হচ্ছে ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম ও ৮ ঘণ্টা বিনোদন। একসময় কৃষক আন্দোলনও বেশ শক্তিশালী ছিল। সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি প্রথা, জমির অধিকার, ভাগচাষ প্রথা, মহাজনী প্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে ঐতিহ্যবাহী কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন দেশে। উন্নয়নশীল বিশ্বে ছাত্র আন্দোলন কেবল পেশাগত অর্থাৎ শিক্ষাজীবনের সমস্যায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাংলাদেশের ভাষা-আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত মূল চালিকাশক্তি ছিল ছাত্রসমাজ। ছাত্র আন্দোলন অনেক বেশি রাজনীতি-সম্পৃক্ত।
আন্দোলনের পরিধি এখন বিপুলভাবে বিস্তৃত হয়েছে। যেমন নারী আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব অর্জন করেছে। নারীর প্রতি বৈষম্য, নারী নির্যাতন, নারী ও শিশু পাচার প্রভৃতি বন্ধের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি সামনে এসেছে। আন্দোলন অভিধাটি একসময় নেতিবাচক ধারণা প্রকাশ করত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক ইস্যু ছাড়াও নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক ইস্যুতে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ইতিবাচক আন্দোলন গড়ে উঠছে।
আন্দোলন হতে পারে পরিকল্পিত অথবা স্বতঃস্ফূর্ত। পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াও কোনো তাৎক্ষণিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অথবা জরুরি ইস্যুতে স্বতঃস্ফূর্তভাবেও জনগণ আন্দোলনের পথে নেমে আসতে পারে।
নূহ-উল-আলম লেনিন