আমার মুক্তিযুদ্ধ, কিছু স্মৃতি এবং আমার প্রথম ভালোবাসা
১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এক বন্ধুর অব্যবহৃত একটা বাইসাইকেল হাতে আসে। তখন খুলনার দৌলতপুর বিএল কলেজের এইচএসসি এর শেষ বর্ষের ছাত্র আমি। সেসময় এই বাইসাইকেলটি এতটা গতি ও উত্তেজনা নিয়ে এসেছিল ভাবতে এখন অবাক লাগে। একদিন একটা সপিংমলে যাবার জন্য সাইকেলটা কোথাও রাখার দরকার ছিল। অগত্যা সাইকেল রাখতে গেলাম আমার পূর্ব্ পরিচিত নাম করা একজন আইনজীবীর বাসায় যিনি আমাকে পুত্রসম স্নেহ করতেন। কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলে অদ্ভুত সুন্দর হাসি দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে সাইকেল রাখার জায়গা করে দিল শ্রদ্ধাভাজন আইনজীবীর মহাসুন্দরী কন্যা। এই সুন্দর হাসিটাই মাথার ভিতর গেথে থাকল। সপ্তাহ খানেক মাথা খাটিয়ে বুদ্ধি বের করলাম এই হাসি কি করে প্রতিদিন দেখা যায়।
আমি যেখানে থাকতাম সেখান থেকে ১০ মিনিট হেঁটে কলেজে যাবার বাস পাওয়া যায়। এতদিন সেভাবেই কলেজে গিয়েছি। নতুন ব্যবস্তায় ১৫ মিনিট সাইকেল ভ্রমণ শেষে সেই ভুবনমোহন হাসি দেখে আরও ১০ মিনিট হেঁটে বাস ধরে কলেজে যাওয়া শুরু হল। এ এক অদ্ভুত নেশায় পেয়ে বসল আমায়। এভাবে চলতে চলতে ১৯৭০ এর নির্বাচন ও পরবর্তী উত্তেজনাকর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কলেজে যাওয়া বন্ধ হল, সাথে হাসি দর্শনও। এসব মাথা থেকে বের করে এপ্রিলে ফাইনাল পরীক্ষার কথা চিন্তা না করে ভারতে যাই গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র, গোলাবারুদের উপর প্রশিক্ষণ ছাড়াও Bridge, culvert ধ্বংস করার উপর ও বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সবকিছু মিলিয়ে চরম উত্তেজনাকর মানসিক অবস্থা। প্রশিক্ষণ শেষে পশ্চিম বাংলায় ফেরত এসে নিজের গোলাবারুদ যখন হাতে পেলাম তখন আমার মত ভোলাভালা মানুষটিও মনের দিক থেকে বীর পুরুষে রূপান্তরিত হলো। তারপর ২৮ জনের দলের সাথে দেশে ৯ নম্বর সেক্টরের আওতায় আমার নিজ এলাকা মোল্লাহাটে পাঠানো হয় আমাকে।
জুলাই মাসের প্রথম দিকে ১০ জনের একটা অগ্রবর্তী দল পাঠানো হল মোল্লাহাট সদরের কাছাকাছি একটা গ্রামে। আমাদের কাছে এরকম খবর ছিল যে পাক সেনারা গোপালগঞ্জ থেকে মোল্লাহাট হয়ে যেকোন সময় আমাদের এলাকায় ঢুকে পড়বে। পানিভর্তি একটা খাল সামনে রেখে আমরা অবস্থান নেই। প্রথম দিন ভোর বেলায় আমিসহ আরও একজনকে পাঠানো হয় এই খাল পার হওয়ার বাঁশের সাঁকো পাহারা দেবার জন্য। আমরা রাস্তা ছেড়ে ঘন গাছপালার ভিতর দিয়ে খালের পাড়ে গিয়ে অবাক হয়ে দেখি শ’খানেক পাক সেনা খাল পাড়ের জন্য গোটা দশেক নৌকায় উঠছে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হল শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা রক্ত বয়ে গেল। কথা ছিল আমরা গুলি ছোড়া শুরু করলে পিছন থেকে বাকীরা আমাদের সাথে যোগ দেবে। আমার কাছে ছিল SLR (Self loading rifle) আর অন্যজনের কাছে ৩০৩ রাইফেল। আগেই বলা ছিল প্রয়োজনে আমিই প্রথম গুলি ছুড়ব। আমি গুলি ছোড়ার জন্য ট্রিগার টেনে দেখলাম কোন শব্দ হলো না। দেখলাম আমার SLR এর Bridge block আটকে গেছে এবং পাক সেনাদের নৌকায় ওঠা প্রায় শেষ। এটা আমি বুঝলাম যে আগামী কয়েক সেকেণ্ডের ভিতর আমার অস্ত্র চালু করতে না পারলে পেছনের সবাই আমরা মারা পড়ব। এসময় মাথা ঠাণ্ডা রাখা কঠিন। আমি সাথে সাথে Bridge block খুলে আটকে থাকা গুলি বের করে Gas volume adjust করি। তারপর আমি বিরতিহীন ভাবে গুলি ছুড়তে থাকি। আমার সাথীও গুলি ছুড়তে থাকে। আমাদের পিছনে থাকা লোকরাও গুলি ছুড়তে ছুড়তে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।
পাক সেনারা আমাদের এমন Fire power বোধহয় আশা করে নাই। তারা খাল পাড় না হয়ে ফিরে যায়। এর তিনদিন পর গানবোটে করে এসে আমাদের পিছন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। আমি আগের দিনের মত খাল পাহারায় ছিলাম সাথে আর এক জনকে নিয়ে। দুপুর ১২ টার দিকে এক লোক এসে আমাদের খবর দিল যে পাক সেনারা আমরা যে বাড়িতে থাকি তা দখল করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের লোকরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। সে আরও বলল যে আমাদেরও পালাতে হবে কারন ওরা এদিকেই আসছে। আমার সাথের ছেলেটা আমার থেকে পিছনে থাকায় গ্রামের লোকেরা তার লুকানোর ব্যবস্তা করে। কিন্তু তখন আমি ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে যার উপর দিয়ে পাক সেনারা এগিয়ে আসছিল। আমার তখন আর লুকানোর জায়গা নাই। কোন উপায় না পেয়ে রাস্তা থেকে ২০ গজ মত দূরে কচুরীপানা ভর্তি গলা পর্যন্ত ডোবা পানিতে নেমে পড়ি। কচুরীপানার উপর রাইফেলটা লুকিয়ে রেখে পানিতে ডুব দিলাম। কোন রকমে নাকটা ভাসিয়ে রাখলাম বাতাস নেবার জন্য। কিছুক্ষণ পর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া বুটের শব্দ পেতে শুরু করি। তখন মনে হচ্ছিল মৃত্যুটা অনেক কাছে চলে এসেছে। কি অবাক কাণ্ড! সেই মুহূর্তে বাবা মা ভাই বোন সহ পৃথিবীর আর কারও কথা আমার মনে আসে নাই। মৃত্যুর এত কাছে এসে শুধু মনে হয়েছে এ জীবনে রেহমুর সেই ভুবন ভুলানো হাসি বুঝি আর দেখা হল না। এখনও আমার কাছে অজানা এমন চিন্তার রহস্য। এটাকি ভালবাসা? তাহলে এটাই জীবনের প্রথম ভালবাসা।