প্রতিবেদন

আমি এ সম্মাননা বাংলার জনগণকে উৎসর্গ করছি

নাগরিক সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা

 বিশেষ প্রতিবেদন:  জাতীয় নাগরিক কমিটির দেওয়া বিশাল সংবর্ধনার সম্মাননা দেশবাসীর প্রতি উৎসর্গ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ সম্মাননা আমার প্রাপ্য নয়, এটার প্রাপ্য হচ্ছে বাংলার মানুষ, বাংলাদেশের জনগণের। তাই আমি এ সম্মাননা বাংলার জনগণকে উৎসর্গ করছি। আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই, হারাবারও কিছু নেই। এ দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য যে কোনো আত্মত্যাগ করতে আমি সদাপ্রস্তুত। আমরা দেশকে শাসন করতে নয়, জনগণের সেবক হয়ে সেবা করতে এসেছি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। দেশকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে হবে আরও উন্নতির উচ্চ-শিখরে, এ আমাদের প্রতিজ্ঞা।
গত ২৯ মে বিকেলে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাকে দেওয়া নাগরিক সংবর্ধনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ ৪০ বছর পর ভারতের পার্লামেন্টে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত চুক্তির সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হওয়াকে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সাফল্য উল্লেখ করে আরও বলেন, বাংলাদেশ আজ আর্থ-সামাজিকসহ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকে বিদ্রƒপ করে বলেছিলÑ স্বাধীন হলেও বাংলাদেশ হবে তলাবিহীন ঝুড়ি। কিন্তু আমি বলতে চাইÑ বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। সেই ঝুড়ি এখন উন্নয়নে ভরপুর। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নে ভরপুর একটি রাষ্ট্র। এটি এখন বিশ্বের সব দেশই স্বীকার করে বলছে, বাঙালি জাতি পারে। এটা সারাবিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত, বাঙালি পারে। বাংলাদেশকে কেউ আর এখন অবজ্ঞার চোখে কিংবা অপছন্দ করে না। বরং বাংলাদেশের উন্নয়ন বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে দেখা দিয়েছে।
ভারতের সাথে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নসহ জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্য অর্জনে যোগ্য নেতৃত্ব দেওয়ায় জাতীয় নাগরিক কমিটি প্রধানমন্ত্রীকে এ সংবর্ধনা দেয়। নাগরিক কমিটি এ সংবর্ধনার আয়োজন করলেও বৈরী আবহাওয়া এবং থেমে থেমে বৃষ্টি উপেক্ষা করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি রীতিমতো বিশাল জনসভায় রূপ নেয়। জাঁকজমকপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল দৃষ্টিনন্দন এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চলমান উন্নয়নের গতিধারাকে ত্বরান্বিত করতে তার পূর্ণ সমর্থনও ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠান শুরুর সময় মূল প্যান্ডেলে জায়গার সংকুলান না হওয়ায় হাজার হাজার মানুষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চতুর্দিকে টানানো মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আবার অনেকে কাকভেজা হয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনতে দেখা যায়। বৃষ্টিবিঘিœত বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ছাড়াও আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও বৃষ্টি উপেক্ষা করেই দলে দলে মিছিল নিয়ে এ নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দেন। বিকেল পৌনে ৪টায় প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে যোগ দিলে নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দসহ উপস্থিত সব শ্রেণি-পেশার মানুষ দাঁড়িয়ে ও করতালি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। প্রধানমন্ত্রীও এ সময় হাত নেড়ে সংবর্ধনার জবাব দেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সভাপতি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। বিকেল ৪টার পরে জাতীয় সংগীত ও ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর সূচনা বক্তব্য রাখেন সৈয়দ শামসুল হক। সূচনা বক্তব্যের পর সৈয়দ শামসুল হকের রচিত সংবর্ধনা উৎসবের ‘মর্মসংগীত’ এবং নৃত্য পরিবেশিত হয়। নৃত্যাঞ্চলের সদস্যরা দেশাত্মবোধক গানের সাথে নৃত্য পরিবেশন করেন। অ্যামিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান অনুষ্ঠানে তার প্রিয় ছাত্রী প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে অভিজ্ঞানপত্র পাঠ করেন। এর আগে শেখ হাসিনার হাতে নৌকার প্রতিকৃতির স্মারক তুলে দেন নাগরিক কমিটির সভাপতি সৈয়দ শামসুল হক। আর অভিজ্ঞানপত্র পাঠের পর কাঠের ওপর শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি সংবলিত একটি স্মারক আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর হাতে তুলে দেন ড. আনিসুজ্জামান। সবশেষে সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক দেশের উন্নয়নে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ এখন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামের পাশে আবশ্যিকভাবে ‘দেশরতœ’ উপাধি লেখার প্রস্তাব করলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হাজার হাজার শ্রেণি-পেশার মানুষ
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন খাতে সরকারের অভাবনীয় সাফল্য তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেন, অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান। অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক বুদ্ধিজীবী, মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্যবর্গ, সাধারণ সম্পাদকসহ কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য, ঢাকার দুই মেয়র, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী নেতা, আইনজীবী, পেশাজীবীসহ ঢাকা এবং আশপাশের জেলাগুলোর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
সংবর্ধনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্থল সীমান্ত চুক্তি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সংসদে ওই চুক্তিটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্তি করলেও ভারতে তা হয়নি। তবে সেই চুক্তিটি দীর্ঘ ৪১ বছরের মাথায় ভারত সরকার সংবিধান সংশোধন করে এ চুক্তি অনুমোদন করেছে। এর জন্য আমি ভারত সরকারকে অভিনন্দন জানাই। তিনি বলেন, ভারতের সংসদের সীমান্ত স্থল চুক্তিটি পাসের ক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা সমর্থন দিয়েছে। আর এটি আমাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সাফল্যে। ইতোপূর্বেও আমরা তৃতীয় পক্ষের কোনো ধরনের সহযোগিতা ছাড়াও গঙ্গার পানি চুক্তি, শান্তি চুক্তি এবং সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি করেছি। এ দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল। যে কোনো দেশের সাথে সমস্যা আলোচনা এবং সুসম্পর্কের মাধ্যমেই যে সমাধান করা যায় আমরা তা প্রমাণ করেছি।
দেশের সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করাই সরকারের দায়িত্ব এ কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের নীতি হচ্ছে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের উন্নয়ন। সেই গ্রামের অবহেলিত মানুষটিরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তার সেই অধিকার রক্ষাই আমাদের লক্ষ্য। স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। প্রতিটি মানুষ তার অধিকার পাবে। তিনি বলেন, একটি জাতির জীবনে কোনো দিকদর্শন না থাকলে সে জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য রূপকল্প ঘোষণা করেছি। এখন তা বাস্তবায়নে কাজ করছি।
দারিদ্র্যই বাংলাদেশের একমাত্র শত্রুÑ এ কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এই দারিদ্র্য থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত করতে হবে। দেশের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সরকার দারিদ্র্য নির্মূলে সফল হবে। জাতির জন্য যে কোনো আত্মত্যাগে নিজে প্রস্তুত এ কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মৃত্যুভয় করি না। জন্মেছি যেহেতু একদিন মরতে হবে। বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, আরও অনেক দূর পথ চলতে হবে। বাংলাদেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যেতে হবে।
১৯৮১ সালে তার দেশে ফেরার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, মা-বাবা, ভাই সব হারিয়ে ছয় বছর নির্বাসনের পর যখন বাংলার মাটিতে ফিরে এসেছিলাম সেদিন লাখো মানুষের ¯েœহ ভালোবাসা পেয়েছিলাম। কিন্তু খুঁজে ফিরছিল আমার চোখ, এই দুটি চোখে আমি খুঁজে ফিরেছিলাম আমার মা-বাবা, আমার ছোট্ট রাসেলকে। আমি তাদের পাইনি। বাংলার মানুষের মাঝে আমি ফিরে পেয়েছিলাম আমার হারানো বাবা-মা, হারানো ভাইয়ের ¯েœহ।
তিনি বলেন, ’৭৫-এর পর আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এই বাংলার মানুষের জন্যই তো আমার বাবা আত্মত্যাগ করেছিলেন, কাজেই বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনা, গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে, আমার পিতার সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিছু করা দরকার যত আত্মত্যাগ করা দরকার আমি সব করব। সেই সাথে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সেই ঘাতক, যারা শুধু আমার পিতাকে কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছিল বাংলার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে সেই খুনিদের বিচার বাংলার মাটিতে করবই। আমরা তাদের বিচার করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, রায়ও কার্যকর হচ্ছে। আমি দেশবাসীর সহযোগিতা চাই, যাতে সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে পারি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ফিরে এসেছিলাম একটা লক্ষ্য নিয়ে যে ’৭৫-এর পর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের আর্দশকে হারিয়েছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে যে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, যে বাংলাদেশ গড়ে উঠবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, যে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলবেÑ সেটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করে বাংলাদেশের মর্যাদাকে ক্ষুণœ করা হয়েছিল, সেই মর্যাদাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। সে জন্যই আমি ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের ফেলে রেখে বাংলাদেশে চলে আসি। তিনি বলেন, এত আত্মত্যাগ কখনও বৃথা যেতে পারে না। ২১ বছর পর আমরা সরকার গঠন করতে সক্ষম হই। পিতার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছি। এই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করেছি এবং বাস্তবায়নও করছি।
তিনি বলেন, ’৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আমরা যে অর্জন করেছিলাম ২০০১-এর পর তা ভূলুণ্ঠিত হয়ে যায়। বাংলার মানুষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, ২০০৯ সালের নির্বাচনে তারা আমাদের নির্বাচিত করে আমাদের মানুষের সেবা করার সুযোগ করে দিয়েছে। আজ যতটুকু আর্থ-সামাজিক উন্নতি করতে পেরেছি তা এ দেশের মানুষের জন্যই। তাই আজকে যে সংবর্ধনা তা আমার নয়, বাংলার মানুষের প্রাপ্য। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নীতি বাংলার আপামর মানুষ। সেই গ্রামে অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকা অবহেলিত মানুষকে টেনে তোলা আমাদের লক্ষ্য। এটাই তো আমাদের নীতি। এ জাতির জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে আমি প্রস্তুত। শত বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত এবং ২০৪১ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলবই।

বাংলাদেশকে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়েছেন তিনি
সংবর্ধনায় নাগরিক কমিটি নেতৃবৃন্দ
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় নাগরিক কমিটির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘দেশরতœ’ উল্লেখ করে নাগরিক কমিটির সভাপতি ও লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেন, আজ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামের প্রারম্ভে আবশ্যিকভাবে ‘দেশরতœ’ শব্দটি ব্যবহার হবে। আমি সবার পক্ষ থেকে তাকে ‘দেশরতœ’ উপাধিতে ভূষিত শেখ হাসিনাকে এই বিশেষণে সম্বোধন বা উল্লেখ করার আহ্বান জানাচ্ছি। এ সময় উপস্থিত জনতা করতালির মাধ্যমে এ বক্তব্যকে স্বাগত জানায়।
প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া নাগরিক সংবর্ধনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলনমেলায় দাঁড়িয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতৃবৃন্দরাও দেশের উন্নয়ন ও জঙ্গি-সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা, সাহসিকতা ও রাষ্ট্রনায়কোচিত কর্মকা-ের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়েছেন। আমাদের মর্যাদাবান করেছেন, সম্মানিত করেছে। দেশে আজ সেই ২০০১-০৫ সালের বিএনপি-জামাত জোট সরকারের নির্যাতন, মানুষ হত্যা নেই, ২০১৩ সালে নির্বাচন ঠেকানোর নামে তা-ব নেই। সবই শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণে এখন স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে শেখ হাসিনা দেশে বিচারের সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সভাপতির বক্তব্যে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেন, শেখ হাসিনা শুধু বঙ্গবন্ধুর কন্যা নন, বঙ্গবন্ধুর সম্প্রসারিত বাহু। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন রাজনীতির কবি, তার কন্যা শেখ হাসিনা হচ্ছেন উন্নয়নের কবি। প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি এবং অকুতোভয়ে তিনি দেশকে ক্রমাগত উন্নততর দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শুধু সরকার কিংবা বিরোধী দল নয়, নাগরিক সমাজই হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের মানুষ আজ শান্তি, স্বস্তি ও প্রগতির মধ্যে বসবাস করছে। অপশক্তিদের জ্বালাও-পোড়াও ও পুড়িয়ে মানুষ হত্যা অপরাজনীতি দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে উন্নীত করার জন্যই প্রধানমন্ত্রীকে আমরা নাগরিক সংবর্ধনা দিচ্ছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এখন দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। আমাদের রপ্তানি বেড়েছে ২ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের প্রবৃদ্ধি ৬.৫ শতাংশ হবে। মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বেড়েছে কয়েকগুণ। দারিদ্র্যতার হার কমার পাশাপাশি ধনী গরিবের বৈষম্যও কমেছে। বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে স্থিতিশীল ও গতিশীল অর্থনীতির দেশ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে দেশকে গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী একজন শ্রমিকের মতো দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার কারণে নিজস্ব অর্থায়নে শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণ করছেন। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্যতা পালিয়ে যাবে।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, এদেশে সব সময় নেতিবাচক বিষয়ই গুরুত্ব পায়, ইতিবাচক কর্মকা- খুব একটা গুরুত্ব পায় না। বিগত সময়ে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি বারবার নষ্ট করা হয়েছে। আর শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়েছেন। আমাদের মর্যাদাবান করেছেন, সম্মানিত করেছেন। দেশে আজ সেই ২০০১-০৫ সালের জোট সরকারের নির্যাতন, মানুষ হত্যা নেই, ২০১৩ সালে নির্বাচন ঠেকানোর নামে তা-ব নেই। সবই শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণে এখন স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। গত ৭০ বছরে যে সমস্যার সমাধান করা যায়নি, শেখ হাসিনা সেই সমস্যা সমাধান করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি, ভারতের সাথে গঙ্গা চুক্তি, সমুদ্রসীমা বিজয় অর্জন করেছেন। এখন মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়ন করছেন। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন। অথচ এর চেয়ে কম কাজ করে কেউ কেউ বিদেশে বড় সম্মান পেয়েছেন।
অর্থনীতিবিদ ড. খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, আজকে আমাদের উপস্থিতি শুধু সংবর্ধনা দিতে নয়, আমরা এসেছি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি, নেতৃত্বের প্রতি নাগরিকের সমর্থন ও আস্থা জানানোর জন্য। তিনি বলেন, আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক যে অর্জন তা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নেই। দারিদ্র্যের হার কমেছে। মানুষের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। একজন দিনমজুরও সারাদিন পরিশ্রম করে ১১ কেজি চাল ক্রয় করতে পারে। জ্বালাও-পোড়াও ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের মধ্যেও আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে। আর এসব সম্ভব হচ্ছে কেবল শেখ হাসিনার গৃহীত নানামুখী নীতি বাস্তবায়নের ফলে। তবে টেকসই উন্নয়নে সবার অংশীদার হতে হবে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, শেখ হাসিনা যখন নির্বাসনে ছিলেন তখনও একটা সংস্কৃতি ছিল, তা হলো ভয়ের সংস্কৃতি, শঙ্কার সংস্কৃতি। কিন্তু তিনি তা অতিক্রম করে দেশে ফিরেছেন। সাহসের সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে তিনি বিচারের সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছেন। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপ পুরো দেশের সংস্কৃতিই পাল্টে দিয়েছে। জঙ্গি-সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার লড়াইয়ে পুরো দেশের মানুষ তার সাথে থাকবে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেন বলেন, শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই বিতরণ কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। বিদেশিদের কেউ যদি এ দেশে আসে তা হলে তারা দেখতে পারবে শিক্ষার পুণ্যভূমিতে এসেছে। বর্তমান সরকারই শিক্ষার আলো দান করেছে।
শহীদ জয়া শ্যামলী নাসরিন বলেন, শেখ হাসিনার সরকার আমলে যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও রায় কার্যকর হওয়ায় শহীদদের আত্মা শান্তি পাচ্ছে। আমরা শহীদ পরিবার স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছি। বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় নারী জাতির পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাই।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান ক্রিকেটসহ ক্রীড়াঙ্গনে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা তুলে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সব ধরনের সহযোগিতার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় আধুনিক ক্রীড়া অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। তার অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ড ও পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে যে অবস্থায় খেলা হয়, তিনি খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেন। এটা পরবর্তী জয়ে অবদান রাখে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল মঞ্চে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে থেকে বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী মিতা হক ও মনিরুজ্জামান চৌধুরীর পরিবেশনায় রবী›ন্দ্র সংগীত, এমএ মান্নান ও বুলবুল মহলানবীশসহ অন্য শিল্পীদের পরিবেশনায় নজরুলসংগীত এবং মমতাজ বেগম এমপির কণ্ঠে ছিটমহল নিয়ে লেখা গান শোনেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পর দেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর পরিবেশনায় মনোজ্ঞ নৃত্যও পরিবেশন করা হয়। এদিকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের সুবিশাল মঞ্চও সাজানো হয়েছিল অপরূপভাবে। বিশাল ব্যানারের এক পাশে ১৯৭৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্থলসীমান্ত চুক্তির ঐতিহাসিক স্থিরচিত্র এবং বামপাশে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের চিত্র স্থান পায়। অনুষ্ঠানের সভাপতি সৈয়দ শামসুল হক তার বক্তব্যের সময় পুরো সংবর্ধনা অনুষ্ঠান সফল হওয়ার পেছনে যারা কঠোর পরিশ্রম করেছেন, তাদের সবাইকে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *