আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা
লেখক: চৌধুরী শহীদ কাদের
তারিখ: ২০ জানুয়ারী ২০১৭
শহিদ আসাদের নাম তরুণ প্রজন্ম জানে কিনা জানি না। অনলাইনে ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন ট্রলে যেভাবে তরুণ প্রজন্মের জ্ঞান গরিমা তুলে ধরা হয় তাতে সন্দেহ থেকেই যায়। আজ ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদ দিবস। আমাদের অনেকের কাছে এখন মুক্তিযুদ্ধ মানে শুধুই বঙ্গবন্ধুর বন্দনা। আবার অনেকের কাছে পুরো বিষয়টাকে অস্বীকার করার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ মানেই শুধু বঙ্গবন্ধু নয়। কিংবা বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করলে মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষভাবে অস্বীকার করা হয়। আমাদের দেশে দৈনিক কোন না কোন দিবস পালিত হয়। এই ধরুণ রাষ্ট্রীয়ভাবে স্কুল কলেজে হাত ধোঁয়া দিবস পালিত হয়। কিন্তু এসব জাতীয় বীরদের স্মরণে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের কোন ধারণা দেয়া হয় না। আজকে বাংলাদেশের কোন স্কুল কলেজে শহিদ আসাদ দিবস পালিত হয়েছে আমার জানা নেই। আর আমরা প্রতিনিয়ত বলছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়তে হবে। চেতনা কোথা থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে নাজিল হবে জানি না। শহিদ আসাদদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আজকের বাংলাদেশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আসাদ। ১৯৬৯-এর এই দিনে ‘পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ আইয়ুব সরকার আরোপিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রায় ১০ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর বিশাল মিছিল বের হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে। মিছিলের সামনেই ছিলেন আসাদ। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পৌছলে পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী মিছিলে বাঁধা দেয় ও হামলা চালায়। এসময়ে আসাদ আধা ছত্রভঙ্গ মিছিলটি আবার সংগঠিত করে এগুতে শুরু করলে পুলিশ প্রথমে আসাদের ওপর বেওনেট চার্জ করে। এতে আহত হয়ে আসাদ মাটিতে পড়ে গেলে পুলিশ রিভলভার দিয়ে পয়েন্ট ব্লাঙ্ক-রেঞ্জ থেকে আসাদেরর বুকে গুলি করেন। এভাবেই শহিদ হন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) নেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ওরফে আসাদ। আসাদের মৃত্যুই ছিল আইয়ুবশাহীর মসনদের কফিনে শেষ পেরেক। আসাদ-হত্যার প্রতিক্রিয়াতেই গণআন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ যার চুড়ান্ত পরিণতি।
তাঁর মৃত্যুর সংবাদ সারাদেশে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কেন্দ্রিক আন্দোলন আসাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সাধারণের সম্পৃক্ততায় গণঅভ্যুত্থানে রুপ নেয়। ঢাকা পরিণত হয় প্রতিবাদ ও মিছিলের নগরীতে। ‘আসাদ-এর মন্ত্র : জনগণতন্ত্র’ হয় সে সময়ের সব থেকে জনপ্রিয় শ্লোগান।
হাজার বছর বাংলা বাঙালির ইতিহাসে আসাদ বেঁচে থাকবে শামসুর রহমানের কবিতা ‘আসাদের শার্ট’ কিংবা ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?’ কিংবা হেলাল হাফিজ-এর অন্যতম বা সব থেকে জনপ্রিয় কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ – ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কবিতায়।
নরসিংদী’র এক গ্রামে জন্ম নেওয়া স্কুল শিক্ষক পিতা-মাতার সন্তান তরুণ আসাদের বুকের রক্ত সেই দিনই মুছে দিয়েছিল সারা দেশে আইয়ুবের নামের সব নিশানা। সারা দেশে আইয়ুবের নামের সব স্থাপনা চলে যায় ‘আসাদ’ নামের দখলে। বড় সাধ করে আইয়ুব ঢাকার মোহাম্মদপুরে নির্মাণ করেছিলেন ‘আইয়ুব গেট’, সতঃস্ফুর্ত জনতা তার নামকরণ করেন ‘আসাদ গেট’। একইভাবে ‘আইয়ুব এভিনিউ’ হয় ‘আসাদ এভিনিউ’ এবং ‘আইয়ুব পার্ক’ হয়ে যায় ‘আসাদ পার্ক’।
আসাদের মৃত্যু পাকিস্তান সরকারকে বাধ্য করে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নিতে। এই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে শেখ মুজিব মুক্ত হন। তিনি পরিণত হন বঙ্গবন্ধুতে।
বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করলে মুক্তিযুদ্ধকে যেমন হেলা করা হয়, ত্রিশ লক্ষ শহীদকে যেমন অপমান করা হয়। ঠিক তেমনি আসাদদের অবদানকে ভুলে গেলে বঙ্গবন্ধুকে সঠিক মূল্যায়ন করা যায় না। আমরা অনেকেই মনে করি মুক্তিযুদ্ধের সকল নায়কদের স্মরণ করলে বঙ্গবন্ধুর অবদান খাটো হয়। আসলে এদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, ইতিহাসের গতিপথ নিয়ে ধারণা নেই। ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে যেখানে বসানোর সেখানে অধিষ্ঠিত করেছে। ড্রাম তত্ত্বের মতো ধারণা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর অবস্থান থেকে কখনো বিচ্যূত করতে পারবে না। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে বলছি ইতিহাসে জোর করে কাউকে বসানো যায় না। ইতিহাস তার পথ নিজেই খুজেঁ নেয়। গয়েশ্বর কিংবা খালেদাদের বাকওয়াজ ইতিহাস সেই স্রোতে আপনাআপনি হারিয়ে যায়। আমাদের দেশে যারা অতিরিক্ত বঙ্গবন্ধু বন্দনা করে, তাদের সবার মধ্যে একটা সমস্যা রয়েছে। এদের রয়েছে নানাবিধ মতলব। মতলব থেকে বের হয়ে মুখে নয় মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে অন্তরে ধারণ করুণ। মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদদের, নায়কদের কিংবা যারা আসাদের মতো বুকের রক্ত দিয়ে পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল তাদের শ্রদ্ধা করুণ। আগামী প্রজন্মকে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন।
‘শহীদ আসাদ অমর হোক। আমাদের দূর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক; আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’
লেখক: চৌধুরী শহীদ কাদের, সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।