উত্তাল মার্চ : খুলনা মহানগরী ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে উত্তাল হয়ে ওঠে
১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে খুলনা মহানগরী উত্তাল হয়ে ওঠে।
রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডির ৩২নং সড়কের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মূলতঃ দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের শাসন মূলতঃ অকার্যকর হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। সব কিছু চলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী।
১৯৭১ সালে খুলনায় মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলোর বর্ণনা দিয়ে সাবেক ছাত্রলীগ সেতা মো. ইউনুস আলী ইনু বাসস’কে বলেন, সে সময়ে তারা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতাদের পাঠানো নির্দেশ অনুযায়ী খুলনা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
হাজার হাজার জনতা রাস্তায় নেমে আসে এবং পাকিস্তান শাসনের বিরুদ্ধে মুহর্মুহু স্লোগান দিতে থাকে। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানায়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ সর্বোচ্চ সংখ্যক আসনে জয়লাভ করে।
ইনু বলেন, শহীদ হাদিস পার্কে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ছাত্রলীগ নেতা এসএম বাবর আলীর নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় হুমায়ন কবির বালু। কমিটির মনোনীত অপর সদস্যরা হলেন, শেখ আবদুল কাইয়ুম, হায়দার গাজী সালাউদ্দিন রুনু, হেকমত আলী ভুইয়া, আবুল কাশেম, সিরাজুল হক ফকির এবং মাহবুব আলম হিরণ।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) ডেপুটি কমান্ডার ইনু আরো বলেন, আওয়ামী লীগ নেতারা খুলনা অঞ্চলে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
সরকারি ও বেসরকারি অফিস এমনকি সকল ব্যবসায়ী কর্মকা- থেমে যায়। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। অঞ্চলে সকল প্রকার সরকারি ও বেসরকারি কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।
আন্দোলন আরো বেগবান করতে খুলনা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ সকাল সাড়ে ৯টায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। নগরীর শহীদ হাদিস পার্কে এই পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে সর্বস্তরের হাজার হাজার লোক অংশ নেয়।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কেন্দ্রীয় নেতাদের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে এবং হরতাল অবরোধ সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিল করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং শ্রমিক ও ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে।
ইনু বলেন, অসহযোগ আন্দোলন সফল করতে খালিশপুরে শিল্প এলাকা এবং দৌলতপুর এলাকায় শ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা আন্দোলনের পর থেকে এই অঞ্চলে সকল আন্দোলন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে।
ইনু বলেন, সে সময়ে ১২টি ইউনিয়ন ও জোনে বিভক্ত ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১২ জন আহ্বায়ক এসকল ইউয়িন ও জোনে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
মুক্তিযোদ্ধা এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য শেখ আবদুল কাইয়ুম বলেন, সে সময়ে খুলনা বেতার কেন্দ্র এবং লুৎফর রহমান জাহাঙ্গীর প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা দেশের ডাক জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
খুলনা সিটিজেন ফোরামের বর্তমান চেয়ারপার্সন কায়উম বাসস’কে বলেন, স্বাধীনতাকামী জনতা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সকল কর্মসূচিতে যোগ দেন। তারা পাকিস্তানি পতাকা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য পাকিস্তানকে বিদায় জানাতে মানসিক প্রস্তুতি দেখায়।
কায়উম ১৯৭১ সালের মার্চের গণআন্দোলনের ইতিহাস স্মরণ করে আবেগাপ্লত হয়ে পড়েন এবং বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে খুলনায় প্রথম শহীদ হন এক লন্ড্রী দোকান কর্মচারী হাদিস।
পাকিস্তানি পুলিশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে গুলি চালালে হাদিস নিহত এবং অপর ৫০ জন আহত হন। পরে এক সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে নগরীর পার্কটি শহীদ হাদিস পার্ক নামকরণ করা হয়। হাদিস নিহত হওয়ার পর প্রতিদিন বিকেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে অসহযোগ আন্দোলনের সর্বশেষ খবর এখানে প্রচার করা হতো।