উত্তাল মার্চ : ৫ মার্চ ঢাকায় কার্ফু তুলে নেয়া হয়
১৯৭১ সালের ৫ মার্চ ঢাকা থেকে কার্ফ্যু তুলে নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়। তবে তখন পরিস্থিতি ছিলো থমথমে।
পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত দৈনিক ‘দ্য ডন’ পত্রিকা দিনের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর ঢাকা থেকে জানিয়েছিল, সামরিক শাসক কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কার্ফ্যু তুলে নেয়ার পর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
ঘোষণায় বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান শান্তির আহবান জানানোর পর গত ২৪ ঘন্টায় সাধারণ আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আগে বুধবার ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভা থেকে অবিলম্বে নগরী থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়ে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। এরপর থেকে রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্যান্য সংগঠন অবিলম্বে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি জানায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে এদিন সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। রাজধানীতে সেদিন ছিলো হরতালের চতুর্থ দিন এবং প্রদেশে ছিলো তৃতীয় দিন। আওয়ামী লীগ প্রধান পরের দিনও হরতাল পালনের ঘোষণা দেন।
১৯৭১ সালের ৫ মার্চ সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ব্যাংক এবং অন্যান্য অফিস দুই ঘন্টার জন্য খোলা রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগের দিন ব্যাংক ও অফিস দুই ঘন্টা খোলা রাখার নির্দেশ দেন। দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ব্যাংক ও অফিস খোলা ছিলো।
৫ মার্চ টঙ্গিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুই জনের মৃত্যু হয়। টঙ্গিতে টেলিফোন শিল্পে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালালে একজন নিহত এবং ১৫ জন আহত হয়।
রাজশাহীতে বুধবার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা মিছিলে গুলি চালালে একজন নিহত এবং ৪ জন আহত হয়।
জেলা প্রশাসনের একজন মুখপাত্র সংবাদ সংস্থা পিপিকে জানান, মালোপাড়ায় টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সামনে গোলযোগের সূত্রপাত ঘটে।
এখানে প্রাপ্ত খবরে বলা হয়, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ৩ মার্চের পর থেকে শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালিত হয়।
১৯৭১ সালের ৫ মার্চ রংপুরে সন্ধ্যা থেকে দশ ঘন্টার কার্ফ্যু জারি করা হয়। এ দিনে ঢাকায় এবং দেশের অন্যান্য স্থানে পৃথক পৃথক সমাবেশ ও মিছিল হয়।
দুপুর দুইটার পর ঢাকায় জনজীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। রাস্তায় যান চলাচল করে। হরতাল শেষে কিছু কিছু দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়। ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঢাকার বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে একটি লাঠি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মিছিল শেষে তারা পুনরায় বায়তুল মোকাররম এলাকায় সমবেত হয়ে সমাবেশ করে।
পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি সমাবেশ করে। সমাবেশ শেষে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) এবং বাংলা ছাত্রলীগ নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করে। তারা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
নগরীর জিন্নাহ এভিনিউ, বায়তুল মোকাররম, স্টেডিয়াম ও নিউমার্কেট এলাকার দোকানপাট হরতাল শেষেও বন্ধ ছিলো।
পাকিস্তান লেখক সমিতি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের নিন্দা জানায়। তারা একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
খিলগাঁও ভূমি বিতরণ কমিটি বায়তুল মোকাররম এলাকায় সন্ধ্যায় একটি সমাবেশ করে।
নারায়ণগঞ্জে দেশের কার্ফ্যু প্রত্যাহারের দাবিতে একটি বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে গৃহবধু ও ছাত্র-শিক্ষকরা অংশ নেন। সমাবেশে শেষে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
পূর্ব পাকিস্তান সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করায় তীব্র নিন্দা জানানো হয়। তারা নিরস্ত্র লোকদের হত্যাকা-ের নিন্দা জানান।
পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্যরা গণআন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এবং সংবাদপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কামাল লোহানী বিকেল তিনটায় প্রেসক্লাব চত্বরে এক সমাবেশের ডাক দেয়। পরে প্রেসক্লাব থেকে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি বায়তুল মোকাররমে গিয়ে গণসমাবেশে রূপ নেয়।