উন্নয়ন অগ্রযাত্রা কেউ রুখতে পারবে না : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব ষড়যন্ত্র ও বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, জ্বালাও-পোড়াও আর বাধা দিয়ে দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা কেউ রুখতে পারবে না। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার চেষ্টা বরদাশত করা হবে না। এদেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান হবে না।
স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেটি বলে, সেটিই তিনি বলছেন। খালেদা জিয়া পাকিস্তানের সুরেই কথা বলেন। কত বড় দুঃসাহস, তিনি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে বিতর্ক করেন!
গত ১১ জানুয়ারি রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের বিশাল জনসভায় সভাপতির বক্তৃতায় শেখ হাসিনা এ কথা বলেন।
‘বিডিআর বিদ্রোহের আগে ৪৫ বার ফোন তারেকের’
২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সম্পৃক্ততার অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিডিআর বিদ্রোহ শুরু হয় সকাল ৯টায়, আর খালেদা জিয়া সকাল ৭-৮টায় সেনানিবাসের বাসা ছেড়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। এর রহস্য কী? এই ঘটনায় তার যোগসূত্র কী, তার জবাবও জনগণকে দিতে হবে। এই বিদ্রোহের আগে তার ছেলে তারেক রহমান রাত ১টা থেকে ২টার মধ্যে লন্ডন থেকে ৪৫ বার ফোন করে তার মাকে বারবার বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। এখন এ ঘটনার সাথে তারও (তারেক) সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়া বললেন আওয়ামী লীগ সরকারই না-কি বিডিআর বিদ্রোহ ঘটিয়েছে। আমরা ক্ষমতায় আসার মাত্র দুই মাসের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহ হয়। তবে সরকার মাত্র দু’দিনে এই বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করে। এখন নতুন একটি সরকার কেন এই বিদ্রোহ ঘটাবে?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিডিআর বিদ্রোহে যে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা মারা যান, তার ৩৩ জনই আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান। তাদের কেন সেখানে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিলÑ সেটাও একটি প্রশ্ন। আমরা তখন মাত্র দু’মাস ক্ষমতায়। এই হত্যার বিচার আমরা করেছি। এটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। একদিন এই ষড়যন্ত্রের মূলোৎপাটনও হবে।
‘মনে শান্তি নেই বলেই খালেদা জিয়া মানুষ হত্যা করছেন’
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক বিতর্কিত বক্তব্য প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া অনেক বক্তৃতাই করেন। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়েছি। কিন্তু তিনি বলে দিলেন, মুক্তিযুদ্ধে এত লোক মারা যাননি। আসলে তার ‘দিল হে পেয়ারে পাকিস্তান’। তাই পাকিস্তানিরা যে সংখ্যা বলে, সেটিই তিনি বলে দিলেন। তার মনে শান্তি নেই। দেশ যখন উন্নয়নের দিকে তখন তার মনে শান্তি থাকে না। এ কারণেই তিনি আবারও মানুষ হত্যা শুরু করেছেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালজুড়ে এবং ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিন আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামাতের সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ও মানুষ পুড়িয়ে হত্যার বিবরণও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারা দেশের মানুষ একবার দেখেছে একাত্তরে। আরেকবার দেখেছে ২০১৩ ও ২০১৫ সালে খালেদা জিয়ার আন্দোলনের নামে। তবে দেশের মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। পৌরসভা নির্বাচনের মাধ্যমেই প্রমাণ হয়েছে তাদের এই জ্বালাও-পোড়াও দেশের মানুষ পছন্দ করে না। নির্বাচন ও মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া মানুষের ভোট নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু তার স্বামী জিয়াউর রহমান এদেশে ‘হ্যাঁ-না’ ভোটের মাধ্যমে মানুষের ভোটের অধিকার নস্যাৎ করেছিলেন। ওই নির্বাচনে ১১০ শতাংশ ভোট ‘হ্যাঁ’তে পড়েছিল, ‘না’ বাক্সে কোনো ভোটই পড়েনি। আর খালেদা জিয়াও ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন ও কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেশের মানুষের আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন।
বক্তব্যের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর কাছে সোহরাওয়ার্দী ময়দানে পাকিস্তানি হানাদাররা আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেন অপূর্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেই সেই স্বাধীনতা পূর্ণ হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এমপি, সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ এমপি, ডা. দীপু মনি এমপি, জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি (সদ্য প্রয়াত) এম এ আজিজ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম এমপি, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এমপি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য সুজিত রায় নন্দী, আমিনুল ইসলাম আমিন, যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ, শ্রমিক লীগের সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ, কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা, যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আখতার, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাউছার, ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন প্রমুখ। জনসভা পরিচালনা করেন কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।
জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন
বিএনপি-জামাত জোটসহ সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ও শপথের মধ্য দিয়ে গত ১০ জানুয়ারি ঢাকাসহ সারাদেশে পালিত হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন, স্মৃতিচারণ, আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছে স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, পাকিস্তানি গোষ্ঠী ৪৪ বছর ধরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারা দেশের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। কিন্তু যত ষড়যন্ত্রই হোক না কেন রাজাকাররা সফল হবে না। একাত্তরে এদেশের মানুষ ওই পাকিস্তানিদের পরাজিত করেছিল। এদেশের মানুষ পরাজিত হয়নি।
তিনি বলেন, স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানিরা ভেবেছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সাত দিনও টিকবে না। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে, তা তারা কখনও ভাবেনি। তাই যতই ষড়যন্ত্র করুক তারা আগেও সফল হতে পারেনি, এখনও সফল হতে পারবে না। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এই অগ্রযাত্রা কেউ ব্যাহত করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু ভবন ও তার আশপাশের এলাকায় মানুষের ঢল নামে। সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে হাজার হাজার নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে পুরো এলাকা জনারণ্য হয়ে পড়ে। শিশু-কিশোরসহ হাজার হাজার নারী-পুরুষ বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। ফুলে ফুলে ভরে যায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির বেদিমূল।
সকাল ৭টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে সরকারপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। এ সময় তিনি সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দদের সাথে নিয়ে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে আওয়ামী লীগের পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু ভবনের ভেতরে যান এবং সেখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করেন। এ সময় মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু ভবন ত্যাগ করার পর সর্বস্তরের মানুষ জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।