উন্নয়ন ও মর্যাদা অক্ষুন্ন্য রাখতে, চাই ক্ষমতার ধারাবাহিকতা
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত ও সারাবিশ্বে অর্জিত মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে দেশের জনগণ আবারও আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বাধীন জোটকে ক্ষমতায় আনবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, নির্বাচন ও আন্দোলনে পরাজিতদের (বিএনপি-জামাত জোট) জনগণ কেন ভোট দেবে? এসব খুনি, যুদ্ধাপরাধী, আলবদর-আলশামসরা যাদের আমরা বিচার করেছি তারা ক্ষমতায় এলে দেশে একাত্তরের মতোই গণহত্যা চালাবে। এটাও দেশবাসী ভালো করেই বোঝে। তাই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মর্যাদার ধারা অক্ষুণœ ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে জনগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ ও তার জোটকে আবারও ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনবে। জনগণের প্রতি সেই আস্থা ও বিশ্বাস আওয়ামী লীগের রয়েছে।
ষড়যন্ত্রের পথ ছেড়ে গণতান্ত্রিক পথে আসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন ও আন্দোলনে পরাজিত বিএনপি নেত্রী ভালো করেই জানেন দেশের জনগণ তাকে ভোট দেবে না। এ কারণে এখন উনি (খালেদা জিয়া) এমন অবস্থা চাইছেন যাতে কেউ নাগরদোলায় চড়িয়ে কিংবা কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে ক্ষমতায় বসাবে। উনি সে চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু সে দোলা নিয়ে আর কেউ আসবে না, কোলে তুলে কেউ তাকে ক্ষমতায় বসিয়েও দেবে না। যাদের আশা করেন, তারাও তার ডাকে সাড়া দেবে না। কাজেই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে নানা কথা না বলে গণতন্ত্রের চর্চা করুন।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে গত ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। নির্বাচন কমিশন নিয়ে কথা বলার আগে ‘আয়নায় নিজের চেহারা’ দেখার জন্য খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ভোট চুরির অপরাধে যাকে (খালেদা জিয়া) দেশের জনগণ ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়েছিল, তিনি এখন নির্বাচনের শুদ্ধতা নিয়ে কোন মুখে কথা বলেন? এসব কথা বলার আগে ক্ষমতায় থাকতে কী করেছেন তা আয়না দিয়ে নিজের চেহারা দেখুন। একমাত্র আওয়ামী লীগই দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করে দেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেনÑ শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এমপি, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপি, সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি, সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র বদরউদ্দীন আহমেদ কামরান, কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল ইসলাম ঠা-ু, ঢাকা মহানগর (উত্তর) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ। সভা পরিচালনা করেন কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ এমপি ও উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমীন।
দেশের অগ্রযাত্রা ও বিশ্বে সৃষ্ট মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা কীভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে? যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার না করে পুরস্কৃত করে, তারা কীভাবে ন্যায় ও নৈতিকতায় বিশ্বাসী হতে পারে? যারা একাত্তরের ঘাতক, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়ে লাখো শহীদের রক্ত¯œাত জাতীয় পতাকাকে অপমানিত করে তারা কীভাবে শান্তিতে বিশ্বাসী হতে পারে?
তিনি বলেন, বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় থেকে অত্যাচার-নির্যাতন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টি, দুর্নীতি-অর্থ পাচার ও দুঃশাসন ছাড়া দেশবাসীকে আর কিছুই দিতে পারেনি, আজ তারা নির্বাচন কমিশন নিয়ে কথা বলে। তাদের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রহসনের নির্বাচন, জিয়াউর রহমানের প্রহসনের হ্যাঁ-না ভোট, ’৮১ সালে নির্বাচনের নামে প্রহসন এবং ২০০১ সালে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ষড়যন্ত্রের নির্বাচন করার কথা কি বিএনপি নেত্রী ভুলে গেছেন? কিন্তু দেশবাসী ভোলে নি, কোনো দিনই ভুলবে না। আমরা দীর্ঘ সংগ্রাম করে জনগণের যে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে এনেছি, সেই ভোটের অধিকার নিয়ে আর কেউ ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। দেশের এই গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
গ্যাস বিক্রি করতে রাজি হলে ২০০১ সালের নির্বাচনেও ক্ষমতায় আসতে পারতামÑ এমন কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ওই নির্বাচনের আগে গ্যাস বিক্রি করার জন্য নানাভাবে চাপ দেওয়া হয়। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতিও আমাকে ডেকে নিয়ে ওই প্রস্তাব দেন। কিন্তু আমি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম, দেশের মানুষের গ্যাসের চাহিদা মিটিয়ে আগামী ৫০ বছরের জন্য রিজার্ভ রেখে যদি উদ্বৃত্ত থাকে সেই গ্যাস বিক্রি করব। ক্ষমতা আমার কাছে বড় নয়, দেশ ও জনগণের স্বার্থই আমার কাছে বড়।
তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগের মুহূর্তে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বাংলাদেশে এসে আমাকে ও খালেদা জিয়াকে গ্যাস প্রসঙ্গ নিয়ে বৈঠকে বসেন। আমার সাথে সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত জিল্লুর রহমান এবং বিএনপির ওই সময়ের মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে গ্যাস বিক্রির জন্য প্রস্তাব দেওয়া হলে আমি স্পষ্ট করে বলে দেই যে, দেশের মানুষের এতটুকু স্বার্থহানি হোক সেটা আমি হতে দেব না। ক্ষমতার লোভে দেশের সম্পদ বিক্রি করব, সেই আমি নই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই বৈঠকে সাফ এটা জানিয়ে দিয়ে চলে এলেও খালেদা জিয়া কিন্তু আসেন নি। উনি ক্ষমতার লোভে গ্যাস বিক্রির চুক্তি করে আসেন। তখন কিন্তু আমি একটি কথাই বলেছিলাম, আল্লাহ জন বুঝে ধন দেন। তারা একুটও গ্যাস পাবে না, বিক্রিও করতে পারবে না, পারেও নি। কারণ আমি জানতাম, তারা গ্যাস পাবে না, তো দেবে কী? এ কারণে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বেশি ভোট পেলেও ক্ষমতায় আসে বিএনপি। কিন্তু ক্ষমতায় এলেও বিএনপি নেত্রী কিন্তু গ্যাস বিক্রি করতে পারেন নি।
আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামাত জোটের নৃশংসতা, মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা ও সারাদেশে চালানো ধ্বংসযজ্ঞের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতি দেখেই বিএনপি ভীত হয়ে পড়ে। ক্ষমতায় থাকতে তারা হত্যা, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি, মানি লন্ডারিং, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়ে জাতীয় পতাকাকে অবমাননা, ১০ ট্রাক অস্ত্রের চোরাচালান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। তাদের কেন জনগণ ভোট দেবে? এটা খালেদা জিয়া ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন যে নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোট দেবে না। এ কারণে নির্বাচনে না এসে উনি আন্দোলনের নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করিয়েছেন।
তিনি বলেন, সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরব না এ কথা বলে খালেদা জিয়া ঘরে নিজে নিজেই বন্দী থেকে হুকুম দিয়ে দিয়ে জীবন্ত শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করিয়েছেন। একটি জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা কোনো সুস্থ মস্তিকের মানুষ করতে পারে না। এই বীভৎসতা কাজটিই করে গেছেন খালেদা জিয়া ও তার কুলাঙ্গার পুত্র। কিন্তু শত শত মানুষকে হত্যা করেও উনি সফল হতে পারেন নি। নাকে খত দিয়েই বিএনপি নেত্রীকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে ঘরে ফিরতে হয়েছে। তাই যারা আন্দোলন ও নির্বাচনে পরাজিত তাদের জনগণ কেন ভোট দেবে?
২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত গত প্রায় পৌনে সাত বছরে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দেশের মানুষ তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার পায়, আর হত্যা-ক্যু ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে তারা দেশকে লুটেপুটে খায়। দেশকে ধ্বংস করে দেয়। তিনি বলেন, ক্ষমতায় থেকে আমরা যতগুলো কাজ করেছি, তার সবগুলোই দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য করেছি। আজ সব ধরনের সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির রেখে যাওয়া ৩২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিয়ে যাত্রা শুরু করে আমরা এখন ১৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছি। দেশের ৭৮ শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, মাত্র পৌনে সাত বছরে আমরা দেশের এত উন্নয়ন করেছি, ২১ বছর ধরে ক্ষমতা দখলকারীরা কী করেছে?
প্রধানমন্ত্রী কারোর নাম উল্লেখ না করে বলেন, বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য যে, বারবার সংগ্রাম করে তারা অধিকার আদায় করে, ষড়যন্ত্র করে তা আবার ছিনিয়ে নেওয়া হয়। দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণী কিছু মানুষ আছে যারা প্রায়শই এসব চক্রান্তের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। এদের দেশের মানুষের সাথে বেইমানি করার চিহ্ন আমরা বারবারই দেখেছি। এদের ক্ষমতার মোহ এতই যে, এরা বরাবরই ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে হাত মিলিয়ে দেশকে পিছিয়ে দেয়, দেশের কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে হরণ করতে চায়।
২০০৮ সালে নির্বাচনের সময় ব্যর্থ হওয়া উপদেষ্টারাই এখন টকশোতে যান, কথা বলেন এমন অভিযোগ তুলে শেখ হাসিনা এর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, তারা টকশোতে গেলে বলা উচিত কী কারণে তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন। সে সময় কেন এমন ঘটেছিল। তখন তারা কেন ব্যর্থ হয়েছিল তা কখনও বলেন নি। তিনি বলেন, যারা নির্বাচন করার দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন করতে পারে না তারা কীভাবে উপদেশ দেয় বুঝি না। তখন বিএনপি-জামাত জোটের কারণেই তারা নির্বাচন করতে পারেন নি, এ কারণেই দেশে ওয়ান-ইলেভেনের সৃষ্টি হয়েছিল যোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী তার ৫০ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উল্টো পথে পরিচালিত করা হয়েছিল। ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে আমরা ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেছি। এবারের বিজয় দিবসে তরুণ-যুবা-ছাত্র-জনতার যে বাঁধভাঙা জোয়ার ও উল্লাস আমি দেখেছি। আমার দলের বিজয় শোভাযাত্রার কারণে আমাকে জ্যামে আটকে থাকতে হয়েছে। দেশের মানুষ সঠিক ইতিহাস জানতে পেরেছে বলেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এমন জোয়ারের সৃষ্টি হয়েছে। আমার ৫০ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, আর কোনোদিন কেউ দেশের প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করতে পারবে না। দেশের প্রকৃত চেতনা জাগ্রত হয়েছে বলেই দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এই অগ্রযাত্রা থেকে কোনো অপশক্তিই দেশবাসীকে আর বঞ্চিত করতে পারবে না। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধশালী বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আমরা গড়ে তুলবই।
আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য বিজয় শোভাযাত্রা
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে গত ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীতে আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় জনতার ঢল নামে। বিকেলে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ৩ কিলোমিটার আওয়ামী লীগের শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া সবার চোখে-মুখে ছিল বিজয়ের আনন্দ।
দুপুর আড়াইটার আগেই নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিজয় শোভাযাত্রা নিয়ে পাকহানাদারদের আত্মসমর্পণের স্থান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত হন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ৪৫ বছর আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে স্থানে পাকহানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছিল, সেখানে লাখো বাঙালিকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা শিখা চিরন্তনে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের মাধ্যমে এই বিজয় শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন। এরপর সেখান থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর অভিমুখে শোভাযাত্রা বের করা হয়। পুরো রাজধানীই যেন পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। বিজয় মিছিলপূর্ব বিশাল সমাবেশ থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে থেকেই বিএনপি-জামাতের সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলার ঘোষণা দেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
বিজয় শোভাযাত্রা চলাকালে চারদিকে মাইকের ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই বজ্রনির্ঘোষ স্বাধীনতার ধ্বনি। দূর-দূরান্ত থেকে জয় বাংলা স্লোগান তুলে বাস-ট্রাকে চড়ে মিছিলে এসেছে বিজয়-আনন্দে উচ্ছ্বল মানুষ। কোনো ট্রাকে আবার বানানো হয়েছে বিজয় মঞ্চ। আবার মিছিলের সাথে অনেকে নিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক বিশাল নৌকা, কাগজের তৈরি কামান, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধাস্ত্র নিয়েও অনেকে শামিল হয়েছিল বিজয় মিছিলে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে রাজাকারের আত্মসমর্পণের ড্যামি দৃশ্যও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মিছিলে। অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাত নিষিদ্ধ, স্বাধীনতা-বিরোধীমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে অনুষ্ঠিত হয় এ বিজয় শোভাযাত্রা।
ঢাকা মহানগরীর ১৫টি নির্বাচনী এলাকা, ৪১টি থানা এবং শতাধিক ওয়ার্ড থেকে অসংখ্য মিছিলের ¯্রােত এসে মিশেছিল ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে। সুশৃঙ্খল-দৃষ্টিনন্দন এই বিজয় শোভাযাত্রায় জাতীয় নেতাদের কণ্ঠেও ছিল একই শপথ, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, এখন রাজাকারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলব।’ নেতাদের এমন দৃপ্ত ঘোষণায় বিজয় শোভাযাত্রায় আসা হাজার হাজার মানুষের উৎফুল্লতা ও হর্ষধ্বনি সবার নজর কাড়ে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বিজয় শোভাযাত্রা শুরু হয়ে শাহবাগ, কাঁটাবন, বাটার মোড়, এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, মিরপুর রোড হয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে এসে শেষ হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে জন¯্রােতের সামনে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি বিজয় শোভাযাত্রার উদ্বোধন করে বলেন, মহান স্বাধীনতার বিজয়কে সুসংহত করতে প্রধান বাধা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই সাম্প্রদায়িকতাকে মোকাবিলা করতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে। সাম্প্রদায়িতাকে প্রতিহত ও পরাজিত করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলাই হবে এবারের মহান বিজয় দিবসের শপথ। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে দেশবাসীকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছাও জানান।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী দলের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ২৩ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের ফসলই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সবদিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সারাবিশ্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। এই অগ্রযাত্রা কেউই রুখতে পারবে না।
মহান বিজয় দিবসের এই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ যৌথভাবে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে খোলা ট্রাকের মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সংক্ষিপ্ত সমাবেশ। এতে সভাপতিত্ব করেন নগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ। এতে আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক এমপি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমীন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মুহাম্মদ সাঈদ খোকন প্রমুখ। সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে একাত্তরের রণাঙ্গনের সেই গগণবিদারী ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে বিজয় শোভাযাত্রা শুরু হয়।
আয়োজক ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ হলেও এই বিজয় শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। সুবিশাল এই বিজয় শোভাযাত্রায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী, সমর্থক ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার অসংখ্য সাধারণ মানুষকে অংশ নিতে দেখা যায়। শোভাযাত্রায় নারীদের অংশগ্রহণও ছিল উল্লেখ করার মতো। রাজধানীর ১০০টি ওয়ার্ড ও ৪১টি থানা থেকে অসংখ্য মিছিল আসতে শুরু করে সেখানে। বিকেল ২টা বাজার আগেই শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তায় মানুষের তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সময় বাড়ার সাথে সাথে বাদ্য-বাজনার তালে তালে নেচে-গেয়ে আসা তীব্র জন¯্রােতে পুরো এলাকায় রীতিমতো মহাসমাবেশে রূপ নেয়। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর ১৫টি নির্বাচনী এলাকা থেকে দলের সংসদ সদস্যদের নেতৃত্বে শোভাযাত্রা সবার দৃষ্টি কাড়ে।
বিজয় দিবসের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে উদযাপিত বিজয় দিবসের তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার শেষ দিন গত ১৮ ডিসেম্বর ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরবরে সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এপি অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিলের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে শুরু হওয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ থেকে পাঠ করেন রামেন্দু মজুমদার। স্বরচিত কবিতা পড়ে শোনান কবি ড. মোহাম্মদ সামাদ, আসলাম সানী। কবিতা আবৃত্তি করেন শিমুল মোস্তফা, ড. শাহাদাত হোসেন লিপু। সংগীত পরিবেশন করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল, তিমির নন্দী। সংগীত পরিবেশন করে দর্শক মাতিয়ে তোলেন ফেরদৌস ওয়াহিদ, বারী সিদ্দিকী, কুদ্দুস বয়াতী ও লিলি ইসলাম। অনিক বসুর পরিচালনায় ‘স্পন্দন’ নৃত্য পরিবেশন করে। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করেন অধ্যাপিকা মেরিনা জাহান।