প্রতিবেদন

এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দিনে বিএনপি নীরব কেন?

প্রথমবারের মতো জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালিত

জাতীয় সংসদে স্বীকৃতির পর এবারই প্রথম ২৫শে মার্চ জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালন করেছে বাংলাদেশ। মশাল প্রজ্বালন, আলোর মিছিল, বিভীষিকাময় সেই কালরাতের স্মৃতিচারণ আর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা।

গত ২৫শে মার্চ গণহত্যা দিবসে ঢাকেশ্বরী মাঠে ঢাকা দক্ষিণ মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় বক্তব্য রাখছেন সড়ক ও যোগাযোগমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমপি ছবি : সাজ্জাদ হোসেন জীবন, উত্তরণ

উত্তরণ প্রতিবেদন: আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এমপি বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া যখন শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন, তখনই পাকিস্তানিরা বই লিখে গণহত্যার চিত্রকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের যদি কেউ বিকৃত করে থাকে, সেটা জিয়াউর রহমান ও তার সহধর্মিণী খালেদা জিয়া করেছেন। অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে, অনেকেই ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা কেউই ব্যাহত করতে পারবে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি ২৫শে মার্চ গণহত্যা দিবস সম্পর্কে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান জানতে চেয়ে বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক বলে নিজেদের দাবি করে, আমি সেই ঘোষক দাবিদার দলকে (বিএনপি) জিজ্ঞেস করতে চাই, ২৫শে মার্চের এই গণহত্যা দিবসে আপনাদের কর্মসূচি কী? আমি জানতে চাই আপনারা এই নৃশংস হত্যাকা-ের দিনে নীরব কেন? আমি জানতে চাই আজকের এই দিনে গণহত্যার বিষয়ে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান কি? বাংলাদেশের জনগণ এসবের উত্তর বিএনপির কাছ থেকে জানতে চায়। তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।
ভয়াবহ ২৫শে মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর লালবাগের আজাদ অফিস মাঠে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আয়োজিত জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে নেতারা এসব কথা বলেন।
মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাতের সভাপতিত্বে সভায় আরও বক্তব্য রাখেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মোজাফফর হোসেন পল্টু, সভাপতিম-লীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক এমপি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ এমপি, দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এমপি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, ঢাকা দক্ষিণ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ প্রমুখ।
জনসভায় ওবায়দুল কাদের প্রশ্ন রেখে বলেন, গণহত্যা দিবসে বিএনপি নীরব কেন? কারা সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে মদদ দেয়, আলবদর শত্রুদের সাথে মিত্রতা করে। কারা মুক্তিযুদ্ধকে মানে নাÑ এটা জাতির সামনে পরিষ্কার। তিনি বলেন, বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে না, ’৪৭ সালের পাকিস্তানের ধ্যান-ধারণা লালন করে।
দলীয় নেতা-কর্মীদের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, দলের ভেতরে ভেতরে কাউয়া আছে। কাউয়া পঁচাত্তরেও ছিল, একাত্তরেও ছিল। কাউয়া এখনও আছে। ক্ষমতার ¯্রােতে এসব কাউয়ারা ঢুকে যায়। আর কিছু কিছু নেতা দল ভারী করার জন্য এসব কাউয়াদেরও লিস্টে নাম লেখায়। তবে আমাদের কাউয়ার দরকার নেই।
‘২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে যুদ্ধ হতো কি-না সন্দেহ আছে’ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন বক্তব্যের জবাবে মাহবুব-উল-আলম হানিফ এমপি বলেন, এই তথ্য ফখরুল সাহেব কোথায় পেলেন? জিয়াউর রহমান নিজেই বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। ফখরুল সাহেব আপনি তো যুদ্ধই করেন নাই, স্বাধীনতার পক্ষেই ছিলেন না। আপনারা কি করে জানলেন জিয়াউর রহমানের ঘোষণায় বাঙালি জাতি স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন?
প্রথমবারের মতো জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালিত
জাতীয় সংসদে স্বীকৃতির পর এবারই প্রথম ২৫শে মার্চ জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালন করেছে বাংলাদেশ। মশাল প্রজ্বালন, আলোর মিছিল, বিভীষিকাময় সেই কালরাতের স্মৃতিচারণ আর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে ঢাকাসহ সারাদেশে পালিত হয়েছে ২৫শে মার্চ ভয়াল কালরাত্রি স্মরণে নানা অনুষ্ঠানমালা। রাতে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য ও নতুন প্রজন্মের হাতের মশাল আর হাজারও প্রজ্বলিত মোম থেকে ছড়িয়ে পড়া আলোতে আলোকিত হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা। আলোর মিছিল করে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
গণহত্যা দিবসের প্রতিটি অনুষ্ঠানেই সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে যে কোনো মূল্যে রুখে দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। দিবসটি পালনে আয়োজিত সকল অনুষ্ঠানে ২৫শে মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি ছিল প্রচ-। পাকি হন্তারকদের ঘৃণা-ধিক্কার জানানোর পাশাপাশি একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে পরাজিত পাকিস্তানের নতুন ষড়যন্ত্রের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক এবং শহীদ পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, একাত্তরের ২৫শে মার্চের কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। একাত্তরের গণহত্যার কথা এখনও অস্বীকার করে পাকিস্তান। বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় ও মর্যাদার ইতিহাস প্রতিষ্ঠার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে পাকিস্তানের মিথ্যাচারের জবাব দিতেই ২৫শে মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রয়োজন।
গণহত্যা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির মধ্যে ছিল গণহত্যার ওপর আলোকচিত্র প্রদর্শনী, আলোচনা সভা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যাবিষয়ক গীতিনাট্য/সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সরকারের উদ্যোগে ২৫শে মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ প্রাঙ্গণে ‘রক্তাক্ত ২৫ মার্চ : গণহত্যা ইতিবৃত্ত’ শিরোনামে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসব অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন করেন।
এদিকে গণহত্যা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। এ উপলক্ষে জগন্নাথ হলে ওইদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত হল প্রাঙ্গণে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কর্মসূচির মধ্যে ছিল চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, শহীদদের স্মরণে স্থাপনাশিল্পের প্রদর্শন, সন্ধ্যা ৭টায় নাট্যানুষ্ঠান, রাত ৮টায় দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা আবৃত্তি, রাত ১১টায় মশাল প্রজ্বালন, ১১টা ৫৯ মিনিটে গণসমাধিতে মোমবাতি প্রজ্বালন এবং শ্রদ্ধা নিবেদন।
পাকিস্তানে গণহত্যা দিবস পালিত
যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ২৫ মার্চ পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে গণহত্যা দিবস পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে সকালে চ্যান্সারিতে এক আলোচনার আয়োজন করা হয়। সভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে, বিশেষ করে ২৫শে মার্চ কালরাতে শাহাদাতবরণকারীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী পাঠ করা হয়।
আলোচনায় বক্তারা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালি ছাত্র, যুবকসহ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত হামলা ও নৃশংস হত্যাকা-ের কথা উল্লেখ করেন। তারা বলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর এই বর্বরতা ও নৃশংস গণহত্যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সংঘটিত অন্য যে কোনো গণহত্যার চেয়ে ভয়াবহ। গত ২৫ মার্চ ঢাকায় প্রাপ্ত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
আলোচনা সভায় হাইকমিশনার তারিক আহসান ২৫শে মার্চ রাতে নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বিনা প্ররোচনায় বর্বরোচিত হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, এ ঘটনার পরই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *