‘একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে মাথা নত করি না’
গত ২১ আগস্ট ভয়াল-বীভৎস গ্রেনেড হামলার এক যুগপূর্তিতে নানা শোকের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতি স্মরণ করেছে আত্মোৎসর্গকারীদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের জনগণ বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত অস্থায়ী বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। নিহতদের পরিবার, পঙ্গুত্ব নিয়ে প্রাণে বেঁচে থাকা নেতা-কর্মীদের কণ্ঠে ছিল একই দাবিÑ আর বিলম্ব নয়, ঘাতক ও নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
ভয়াল ২১ আগস্ট উপলক্ষে ওই দিন দুপুরের পর থেকেই গ্রেনেড হামলার স্থল বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে হামলায় শহীদের পরিবার এবং দীর্ঘ ১২ বছর ধরে গ্রেনেডের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ও পঙ্গুত্ব জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা আহতদের উপস্থিতিতে সেখানে রীতিমতো আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ১২টি বছর পেরিয়ে গেলেও আহতদের চোখে-মুখে ওই ভয়াল হামলার বীভৎসতার আতঙ্কের ছাপ ছিল স্পষ্ট। তারা এখনও দেহে বয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রেনেডের স্পিøন্টার, যার ব্যথা এখনও মনে করিয়ে দেয় ওই দুঃসহ স্মৃতির কথা।
বিকেল ৪টায় প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থলে এসেই প্রথমে সেখানে স্থাপিত শহীদদের অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং পরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সকল শহীদদের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্টের শহীদ, জাতীয় চার নেতা, ২১ আগস্টের শহীদসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাসীন ১৪ দলের নেতারাও শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা নিবেদনকালে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা সভা শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শহীদদের পরিবার এবং পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকা আহত নেতা-কর্মীদের সাথে কথা বলেন। এ সময় শহীদ পরিবারের সদস্যদের কান্নায় পুরো অনুষ্ঠানের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করার পর সবার শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি ছাড়াও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এমপি, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এমপি, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, মাহবুব-উল-আলম হানিফ এমপি, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়–য়া, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা এবং সরকারের মন্ত্রীগণ, সংসদ সদস্যবর্গ উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ ত্যাগ করার পর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ২১ আগস্টের অস্থায়ী শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। একপর্যায়ে অস্থায়ী শহীদ বেদি ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা দিবসে প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, দেশে ফেরার পর থেকেই মৃত্যু আমার পিছু ছুটেছে, কিন্তু আমি কখনও ভয় পাই নি। আমি কখনও মৃত্যুকে ভয় করি না। কারও কাছে মাথা নত করি না; উপরে আল্লাহ ছাড়া। একমাত্র আল্লাহর কাছেই আমি মাথা নত করি। কারণ, আমি জাতির পিতার কন্যা, এটা আমি সব সময় মনে রাখি। জন্মালে মৃত্যু হবে, তাই মরার আগে আমি মরতে রাজি না। আর যারা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস লালন-পালন করে, যারা গ্রেনেড মেরে মানুষ মারে তাদের স্থান বাংলার মাটিতে হবে না। এদের প্রতিরোধ করেই দেশের মানুষের জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করব।
ভয়াল-রক্তাক্ত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা দিবস উপলক্ষে গত ২১ আগস্ট হামলার স্থল বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই গ্রেনেড হামলার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ তার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামাত জোটকে দায়ী করে বলেন, এই হামলার আগে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া, তাদের জোটের নেতাদের বক্তব্য এবং বিএনপি নেত্রীর পুত্রের কর্মকা-ই প্রমাণ দেয়Ñ এই ঘটনার জন্য কারা জড়িত। এটা নতুন করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা পুরো বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিলেও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও বিএনপি-জামাত জোট সরকারকে নাড়া দেয়নি। বরং তারা এই হামলার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছে।
ওই ভয়াল গ্রেনেড হামলায় মৃত্যুজাল ছিন্ন করে প্রাণে বেঁচে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য প্রদানের আগে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নির্মিত অস্থায়ী শোকবেদিতে গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী ঘুরে ঘুরে গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্বজন এবং আহতদের সাথে কুশলবিনিময় করেন। প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে নিহতদের স্বজন ও সর্বাঙ্গে বিঁধে থাকা ঘাতক গ্রেনেডের স্পিøন্টারের দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে প্রাণে বেঁচে থাকা আহত নেতাকর্মীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে রীতিমতো হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে সান্ত¡না দেন এবং সবার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। এ সময় অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি। অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রী-এমপিসহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল কিন্তু বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও বিএনপি-জামাত জোট সরকারকে নাড়া দেয়নি। উল্টো সংসদে বিএনপি নেত্রী ও তাদের দলের নেতারা বললেন; গ্রেনেড হামলা নাকি আমরাই ঘটিয়েছি! আমি নাকি ভ্যানিটি ব্যাগে গ্রেনেড নিয়ে গিয়ে মেরেছি। আমার প্রশ্নÑ আমি কখন গ্রেনেড মারা প্রশিক্ষণ নিলাম? তারা সারা বাংলাদেশে রটালোÑ এই ঘটনা আমরাই ঘটিয়েছি। আমরা প্রশ্ন, আমরা কি সেদিন সেখানে সুইসাইড করতে গেছি। যে গ্রেনেড যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় সেই গ্রেনেড ব্যবহার করা হলো আমাদের সমাবেশে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দুঃখী মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করছি। জাতির পিতা যে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে সারাজীবন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন, সেই লক্ষ্য নিয়ে আমিও কাজ করে যাচ্ছি। আমরা মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করছি, তার বিনিময়ে গুলি, বোমা ও গ্রেনেড হামলার শিকার হচ্ছি। তিনি বলেন, আল্লাহ রক্ষা না করলে এই ভয়াবহ হামলা থেকে আমি রক্ষা পাওয়ার কথা নয়।
তিনি বলেন, এত বড় মানবতাবিরোধী ঘটনার পর সংসদে আমাদের একটি কথাও বলতে দেয়নি বিএনপি সরকার। আমি তখন বিরোধীদলীয় নেতা। কি দুর্ভাগ্য, এই ভয়াবহ হামলা নিয়ে আলোচনা এমনকি একটি নিন্দা প্রস্তাব নিতেও দেওয়া হয়নি সংসদে। এতেই স্পষ্ট হয়, কারা এই ঘটনার সাথে জড়িত ছিল। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে হয়নি। তৎকালীন বিএনপির এমপি-মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বক্তব্যেই সব সময় একটি আভাস ছিল, তা হচ্ছে আমাকে তারা এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে চিরতরে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে খালেদা জিয়া প্রকাশ্য একটি জনসভায় বলেছিলেনÑ প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, আমি কোনোদিন বিরোধীদলীয় নেতাও হতে পারব না। এই বক্তব্যের বহিঃপ্রকাশ কিন্তু হয়েছে ২১ আগস্টে। আমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই আমি কোনোদিন বিরোধীদলীয় নেত্রী হতে পারব নাÑ এটাই উনি বোঝাতে চেয়েছেন। তার কথায় এই হামলার ষড়যন্ত্রের কথা ছিল স্পষ্ট। আর হামলার আগে খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান ৫ নম্বর ধানমন্ডি তার শ্বশুরবাড়িতে একটানা ৯-১০ মাস ছিল। পহেলা আগস্ট ধানমন্ডি থেকে সেনানিবাসের বাসায় ফিরে যায়।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বিএনপির নেত্রীর পুত্র কেন এতদিন শ্বশুরবাড়িতে ছিল? সেখানে বসে ষড়যন্ত্র করতে সুবিধা হবে এ জন্যই? তিনি বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে বিএনপি নেত্রী ও দলটির অন্য নেতাদের প্রতিটি বক্তব্যে আভাস ছিল আমাকে হত্যার। তাদের বক্তব্য এবং তারেক রহমানের কর্মকা- দেখলেই স্পষ্ট হবে এই হামলার সাথে কারা জড়িত ছিল। এটি এখন আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার কোনো দরকার নেই।
ভয়াল গ্রেনেড হামলায় মৃত্যুজাল ছিন্ন করে প্রাণে বেঁচে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ’৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকেই মৃত্যু আমার পিছু হেঁটেছে, কিন্তু আমি কখনও ভয় পাই নি। মৃত্যুকে আমি ভয় করি না। আর একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কাউকে আমি পরোয়া করি না। আল্লাহর কাছে ছাড়া আর কারও কাছে মাথা নত করি না। জন্মিলে মরতে হবে, কিন্তু মরার আগে মরতে আমি রাজি নই। কারণ আমি জাতির পিতার কন্যা। বারবার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আমি বেঁচে আছি। আল্লাহ জন্ম দেয় কিছু কাজ করার জন্য। সেই কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহই তাকে রক্ষা করে। আল্লাহ রক্ষা না করলে আমি ২১ আগস্ট প্রাণে বাঁচতে পারতাম না।
২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলার কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, একটা দুটো নয়, বৃষ্টির মতো ১৩টি গ্রেনেড ছুড়ে আমাদের সমাবেশের ওপর হামলা করা হয়। মনে হচ্ছে রীতিমতো কেয়ামত ঘটে যাচ্ছে। দুটি গ্রেনেড অবিস্ফোরিত থাকলেও সেটিও ধ্বংস করে দেওয়া হয় যাতে কোনো আলামত না থাকে। তিনি বলেন, ট্রাকে থাকা নেতাকর্মীরা মানবঢাল রচনা করে আমাকে রক্ষা করেন। এ সময় আমার চশমা খুলে পড়ে গেলে আমি দূরে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমাকে রক্ষায় মানবঢাল রচনার সময় হানিফ ভাইয়ের (ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) মাথায় অসংখ্য গ্রেনেডের স্পিøন্টার বিদ্ধ হচ্ছিল। তার মাথা বেয়ে রক্ত আমার গায়ে পড়ছিল। হামলার পর আমার গায়ে রক্ত দেখে অনেকেই ভেবেছিল আমি আহত হয়েছি। কিন্তু আমার কিছু হয়নি। আমাদের নিরাপত্তারক্ষীরা পাল্টা গুলি ছুড়লে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
২১ আগস্ট হামলা যে পূর্ব পরিকল্পিত ছিল তার উদাহরণ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই দিনের ভয়াবহ এই হামলায় আওয়ামী লীগের ২২ নেতাকর্মী মৃত্যুবরণ করেছে। অজ্ঞাত ছিল আরও দুজন। জানি না তাদের মধ্যে কেউ হয়তো হামলাকারীও হতে পারে। এত বড় একটি ঘটনা ঘটল অথচ পুলিশ ছিল নীরব। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় আমাদের সভা-সমাবেশের প্রতিটিতে পুলিশ বাধা দিয়েছে। অথচ হামলার দিন পুলিশের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। আশপাশের মার্কেট-অফিসের ছাদে নিরাপত্তার জন্য আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা পাহারার জন্য যেতে চাইলেও পুলিশ তাদের যেতে দেয়নি কেন? আমাদের সমাবেশে কোনোই নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না।
তিনি বলেন, হামলার পর চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ, আহত মানুষের আর্তনাদ। অবাক লাগে এত বড় ঘটনা ঘটার পরও পুলিশের কোনো তৎপরতা ছিল না। সেখানে আহত মানুষ কাতরাচ্ছে তাদের উদ্ধার না করে পুলিশ তৎকালীন সরকারের নির্দেশে টিয়ারগ্যাস ও লাঠিচার্জ করে। আমি জানি না পৃথিবীতে এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা। তিনি বলেন, হামলাকারীরা যাতে নিরাপদে, নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে পারে সে জন্য টিয়ারগ্যাস ও লাঠিচার্জ করা হয়েছে। উদ্ধারের জন্য আসা কোনো গাড়ি সেখানে আসতে দেয়নি পুলিশ। তিনি বলেন, একটি ঘটনা ঘটলে সরকারের পক্ষ থেকে আলামত সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং উদ্ধারকার্য পরিচালনা করা প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু উল্টো আলামত সংরক্ষণের পরিবর্তে একে একে সব ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। যতটা সম্ভব হয়েছে আমাদের নেতাকর্মীরা আলামত সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে। বিএনপি এই ঘটনার তদন্ত করল না, আলামত সংগ্রহ করল না। বরং দেশি ও আন্তর্জাতিক চাপে কোথাকার কোন গ্রামের একজন জজ মিয়াকে ধরে নাটক সাজাল, সে হামলা করেছে।
২১ আগস্ট হামলার পর সেদিনের হাসপাতালগুলো ও ডাক্তারদের আচরণের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সেদিন হাসপাতালগুলোতে বিএনপি মনোভাবাপন্ন একজন ডাক্তারকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমাদের মনোভাবাপন্ন ডাক্তাররা হাসপাতালগুলোতে ছুটে গিয়েছে। তৎকালীন পিজি হাসপাতালে একজন আহতকে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। কী জঘন্য মনোভাব নিয়ে তারা সে সময় কাজ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই নাÑ এ ধরনের ঘটনা আর বাংলাদেশে ঘটুক। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ আমরা চাই না। আমরা চাই বাংলাদেশের উন্নয়ন ও দেশের মানুষের শান্তি। তবে এখনও নানা ধরনের চক্রান্ত চলছে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূলে আমরা যখন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি, সেখানে তারা মদদ দিচ্ছে। নানা ঘটনা ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশ যখন সুষ্ঠুভাবে চলছে, কিছু বিদেশি শক্তি যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তারা এখনও চক্রান্ত করছে। নানা ঘটনা ঘটাতে মদদ দিয়ে যাচ্ছে।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ আন্তর্জাতিক ইস্যু উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনো দেশই এখন নিরাপদ নয়। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী বড় ইস্যু এটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সম্প্রতি বাংলাদেশি ইমাম ও মুসল্লিকে হত্যা করা হয়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নাজমুলসহ আরেকটি প্রদেশ কানেকটিকাটেও বাংলাদেশিকে হত্যা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করি। জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে রূখে দাঁড়ালে এ ধরনের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত আমরা রুখে দিতে পারব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের লালন-পালন করে। যারা মানুষকে হত্যা করে। যারা গ্রেনেড মেরে মানুষ মারে; তাদের স্থান বাংলার মাটিতে হবে না। এদের প্রতিরোধ করেই দেশের মানুষের জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, জনগণের শক্তিতে আমরা বিশ্বাস করি। জনগণের শক্তিই হচ্ছে বড় শক্তি। জনগণ যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, জনগণ যদি রুখে দাঁড়ায়, যা ইতোমধ্যে রুখে দাঁড়িয়েছে। তা হলেই আমরা বাংলাদেশকে এ ধরনের ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করতে পারব।
তিনি আরও বলেন, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সারাজীবনই বাংলাদেশের মাটিতে হয়েছে। যেখানে জাতির পিতার মতো একজনকে হত্যা করতে পারে। যিনি স্বাধীনতা এনে দিলেন, আত্মপরিচয়ের সুযোগ দিলেন, বাঙালি হিসেবে একটা জাতির মর্যাদা দিয়ে গেলেন। একটি রাষ্ট্র ও পতাকা দিয়ে গেলে তাকে পর্যন্ত এই মাটিতে হত্যা করা হয়েছে। তাই ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের গভীরতা মাথায় রেখেই সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যেভাবেই হোক বাংলার মাটি থেকে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দূর করে শান্তি নিয়ে আসতে হবে। এটি অনুধাবন করেই আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা দিয়ে ক্ষমতায় আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকার সদ্য বিদায়ী বিএনপি-জামাত সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সর্বপ্রথম আমার ওপর আঘাত হানলো। একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে গ্রেফতার করল। কিন্তু তখনও বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়াকে কিছুই করা হয়নি। আমাকে মাইনাস করাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। এ সময় দলের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, তারা ওই সময় সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হয়েছিলেন বলেই নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি।
দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যতই বাধা-বিপত্তি ও ষড়যন্ত্র হোক না কেন, এ দেশের গরিব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটাবোই, আজকের দিনে এই আমার প্রতিজ্ঞা। জনগণের মাঝে গণসচেতনা সৃষ্টি করে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যারা জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি করে, গ্রেনেড হামলা করে মানুষকে হত্যা করে, তাদের যেন বাংলাদেশের মাটিতে ঠাঁই না হয়। সেজন্য দেশবাসীকে আরও সজাগ ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যারা স্বাধীনতা চায় না, দেশের মানুষের মঙ্গল চায় না এদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সারাজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, জীবন দিয়ে গেছেন, সেই পিতার কন্যা হিসেবে রাজনীতিতে আমার একটাই লক্ষ্যÑ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আর রাজনীতির একটাই শক্তি জনগণের কল্যাণ করা।