একাত্তরের পরাজিত শক্তিই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে
শোকের মাসের প্রথম দিনে রক্তদান কর্মসূচিতে প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, এখন নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে; জঙ্গিবাদ। এসব ঘটনার সাথে যারাই ধরা পড়ছে গোড়ায় গেলে দেখা যায় তারা একাত্তরের পরাজিত শক্তি, স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরের উত্তরাধিকারীরাই জড়িত। এসব জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ তাদেরই সৃষ্টি। এরা আবার পরাজিত হবে। বাংলাদেশের মাটিতে কোনো জঙ্গি-সন্ত্রাসীর ঠাঁই হবে না। এ দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া হবে না। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার শক্তি যে বাংলাদেশের রয়েছে, আমরা তা প্রমাণ করেছি।
গত ১ আগস্ট বিকেলে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে স্মৃতিবিজড়িত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনের সামনে শোকের মাস আগস্টের সূচনা দিনে কৃষক লীগ আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি ও আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। আজ থেকে ৪১ বছর আগে ১৫ আগস্টের সেই ভয়াল ও বিভীষিকাময় হত্যাকা-ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বারবার আবেগে জড়িয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা।
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এমপি, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এমপি, জনপ্রশাসনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি, মাহবুব-উল-আলম হানিফ এমপি, ড. আবদুর রাজ্জাক এমপি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল আহসান খান, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এমপি, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুল হক রেজা প্রমুখ। এতে সভাপতিত্ব করেন কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা। কৃষক লীগের প্রকাশনা ‘কৃষক কণ্ঠ’ প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। আলোচনা সভা শেষে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। অগুনতি মুজিব অনুরাগী রক্তদান করেন।
আবেগাপ্লুত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান কেবল বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্রই করেন নি, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর মৃত মানুষের চরিত্র হননেরও চেষ্টা করেছেন। আমি দেশে ফিরে আসার পর আমাকে এই বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এই বাড়িতে আমার বাবা-মা মারা গেছেন। আমি মিলাদ পড়ব, জিয়াউর রহমান সেখানে যেতে দেয়নি। রাস্তার ওপর বসেই শত বাধা অতিক্রম করে মিলাদ পড়তে হয়েছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে যে বাড়িতে (ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবন) আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, রাস্তায় বসে মিলাদ পড়তে হয়েছে; সেই বাড়ি আমাকে হস্তান্তর করার জন্য তারা ব্যস্ত হয়ে যায়। আইনজীবীদের মাধ্যমে বাড়ি বুঝে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তখন বুঝতে পারিনি তাদের তাড়া কেন।
তিনি বলেন, বাড়ি হস্তান্তর করার পরে ৪০ দিন ধরে টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে ওই বাড়িতে হীরা, মুক্তা, টাকা পাওয়া গেছে। আর জিয়া একটি ভাঙা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি রেখে গেছেন। ১০০ টাকার নোট বঙ্গবন্ধু বন্ধ করেছিলেন। সেই নোট ট্রাঙ্ক ভরে এনে দেখিয়েছিল এসব পাওয়া গেছে ওই বাড়িতে। কিন্তু বাংলার মানুষ এসব বিশ্বাস করেনি। কারণ, দেশকে কে কতটুকু দিয়েছে তা মানুষ জানে। তিনি বলেন, কৃত্রিমভাবে চরিত্র তৈরি করে সত্য চাপা দেওয়া যায় না। আমাদের বিজয়ের ইতিহাস কয়েক প্রজন্ম জানতেই পারেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে ৭ মার্চের ভাষণ তারা শুনতে পেয়েছে। অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে, কিন্তু বাংলার মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র আর কোনোদিন সফল হবে না।
শোককে শক্তিতে পরিণত করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পাইনি। বরং খুনিদের ইনডেমনিটি দিয়ে রক্ষা, মদতদান ও পুরস্কৃত করার ঘটনা দেশবাসী দেখেছে দীর্ঘ ২১টি বছর ধরে। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়েছে। জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল, তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দেয় এই জিয়াউর রহমান। জেনারেল এরশাদও বঙ্গবন্ধুর খুনিকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেছিলেন। আর জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দুই খুনি কর্নেল রশিদ ও হুদাকে এমপি করে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েছিলেন। এভাবেই হত্যার ষড়যন্ত্র ও খুনিদের মদদ দিয়েছে তারা।
আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর এই কন্যা বলেন, কী অপরাধ ছিল আমার মা ও ছোট ভাই শিশু রাসেলের? যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, বাঙালির বিজয় মেনে নিতে পারেনি; তারাই কিছু আন্তর্জাতিক শক্তির সহায়তায় ১৫ আগস্ট আমার বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে। কখনও কল্পনাও করতে পারিনি আমরা দুই বোন সবহারা হয়ে যাব। তিনি বলেন, বাংলার শোষিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করেছেন বঙ্গবন্ধু। তার ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিলেন বাঙালি জাতি। এই বিজয় মেনে নিতে পারেনি তারা, এতে সমর্থন দিয়েছিল তাদেরই কিছু দোসর। তারাই বাংলার মানুষের কাছ থেকে জাতির পিতাকে কেড়ে নিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদেশে যাওয়ার আগে শেখ রাসেল আমার সাথে যেতে চেয়েছিল। নিয়ে গেলে তাকে এভাবে জীবন দিতে হতো না। বঙ্গবন্ধুর রক্তের কাউকে জীবিত না রাখতে ঘাতকরা একযোগে তিন বাড়িতে আক্রমণ করে আমাদের পরিবারের ১৮ জনকে হত্যা করে। সবাইকে রেখে গেলাম; কিন্তু ফিরে এসে কারোর মুখটুকুও আমরা দু’বোন দেখতে পারলাম না। দেশে এসে পরিবারের কাউকে না পেলেও দেশের লাখো-কোটি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, তাদের কাছ থেকেই আমি আমার বাবা-মায়ের ¯েœহ-ভালোবাসা পেয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব হারানোর ব্যথা বুকে নিয়ে আমি দেশে ফিরে এসেছিলাম একটাই লক্ষ্য নিয়ে, তা হচ্ছে দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে, দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের উন্নত জীবন দিতে। বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শ নিয়েই আমি দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। দেশের মানুষকে উন্নত জীবন দিতে আমি আমার জীবনকে উৎসর্গ করেছি। শোককে শক্তিতে পরিণত করে বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবই। এ ব্যাপারে দেশবাসীর সহযোগিতা চাই। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলবোই, ইনশাল্লাহ!