এবার খুন হলো ব্লগার নীলাদ্রি
এবার নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়কে। গত ৭ আগস্ট দুপুরে ভাড়া বাসায় ঢুকে হত্যা করা হয় তাকে। এ হত্যাকা-ে পুলিশ উগ্রপন্থিদের সন্দেহ করে। সেদিনই সন্ধ্যায় এক ই-মেইল বার্তায় হত্যার দায় স্বীকার করে আনসার আল ইসলাম নামের একটি সংগঠন। এ নিয়ে চলতি বছরের সাত মাসে চারজন লেখক ও ব্লগার খুন হলেন। এর আগে ২০১৩ সালে খুন করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে।
নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (২৭) গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে ¯œাতকোত্তর শেষ করে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তিনি ‘নিলয় নীল’ নামে বিভিন্ন গোষ্ঠীবদ্ধ ব্লগে লিখতেন। ফেসবুকেও ছিলেন একই নামে। স্ত্রী আশা মনিকে নিয়ে পূর্ব গোড়ানের একটি বাড়ির পাঁচতলায় দুই কামরার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন তিনি। ৭ আগস্ট বেলা সোয়া ১টায় চার ব্যক্তি ওই বাসার ভেতরে ঢুকেই নীলাদ্রিকে কুপিয়ে হত্যা করে। তার স্ত্রী আশা মনি বলেন, ৭ আগস্ট দুপুরে বাজার থেকে ফেরেন নীলাদ্রি। আশার বোন তন্বী সেই দিন বোনের বাসায় বেড়াতে যান। তন্বী বাজার থেকে আনা তরি-তরকারি কাটছিলেন। এ সময় ১৯-২০ বছর বয়সী এক তরুণ বাসার দরজায় টোকা দেন। দরজা খুললে ওই তরুণ বলেন, তিনি বাসা ভাড়া নিতে চান। আশা বলেন, তারা তো বাড়ি ছাড়ছেন না। ভাড়া নেবেন কীভাবে? কথা বলতে বলতেই ওই তরুণ বাসার ভেতরে ঢুকে পড়েন। কালো টি-শার্ট, জিনস পরা তরুণটির পিঠে একটি ব্যাগ ছিল। বাসায় ঢুকে তরুণটি মুঠোফোন টিপতে থাকেন। তখন আশা তার স্বামী নীলাদ্রিকে ডাক দেন। এর মধ্যেই আরও তিনজন বাসার ভেতরে ঢুকে পড়েন। ঢুকেই তারা ‘নারায়ে তাকবির’ বলে নীলাদ্রিকে কোপাতে শুরু করেন। একজন আশাকে পিস্তলের মুখে বারান্দায় নিয়ে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। আশার বোনকে রান্নাঘরেই আটকে রাখা হয়। আশা বলেন, ‘আমি সব শক্তি দিয়া চিৎকার করতাছি মাইরা ফালাইলোরে, মাইরা ফালাইলো। কেউ আগায়া আসেনি। কেউ যদি আইসা কলাপসিবল গেটটাও লাগায়া দিত, তাও ওদের ধরা যাইত।’ সব মিলিয়ে ২ থেকে ৩ মিনিটের ভেতরেই পুরো ঘটনাটি ঘটে যায় বলে আশা জানান। তার স্ত্রী বারবার বলছিলেন, গণমাধ্যমে তার চেহারা দেখানোর ফলে এখন তার জীবনও শঙ্কায় পড়ল। হামলাকারীদের একজনের মুখে দাড়ি ছিল। খুনিরা চলে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরে আশপাশের লোকজন এসে ভেতরের দরজা খুলে দিলে আশা ঘরে ঢুকেই দেখেন, রক্তে ভাসাভাসি মেঝের ওপর পড়ে আছেন তার স্বামী। আশা বলেন, খুনিরা মৃত্যু নিশ্চিত করার পর ঘর থেকে বের হয়েছেন। খুনিরা বড় রামদা ও চাপাতি জাতীয় ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছেন।
নীলাদ্রির গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর সদরের টোনা ইউনিয়নে। ২০০৭ সালে পিরোজপুর সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে নীলাদ্রি বড়। দুই বছর আগে আশা মনিকে বিয়ে করে গোড়ানের ওই বাড়িতে ওঠেন। পরীবাগে একটি গবেষণা সংস্থায় চাকরি করতেন নীলাদ্রি। সংস্থাটির চেয়ারপারসন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল। তিনি বলেন, এক মাস আগে তার প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন নীলাদ্রি। মেজবাহ কামাল বলেন, সরকারের কাছে হেফাজতে ইসলামের দেওয়া ৮৪ ব্লগারের তালিকায় নীলাদ্রির নাম ছিল। এমনকি পরে ১৬ জনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করেছিল উগ্রপন্থিরা, সেখানেও নীলাদ্রির নাম ছিল। এসব নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন তিনি। সিলেটে নিহত ব্লগার অনন্ত বিজয় দাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন নীলাদ্রি। অনন্ত হত্যার পর আরও বেশি শঙ্কায় পড়েন নীলাদ্রি। অনন্ত হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে শাহবাগ থেকে ফেরার পথে তাকে অনুসরণ করছিলেন দুই তরুণ। বিষয়টি বুঝতে পেরে নীলাদ্রি রাস্তায় নেমে যান। পরে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে বন্ধুদের ফোনে বিষয়টি জানান। বন্ধুরা গিয়ে তাকে বাসায় নিয়ে যান। বিষয়টি তিনি অফিসে জানালে অফিস থেকে তাকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পরই ঢাকায় ফিরে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। নীলাদ্রি গত ১৫ মে তাকে অনুসরণ করার বিষয়টি নিজের ফেসবুক পাতায় প্রকাশ করেন।
৭ আগস্ট সন্ধ্যায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো এক ই-মেইল বার্তায় ‘আনসার আল ইসলাম’ এ হত্যার দায় স্বীকার করেন। এর আগে অনন্ত বিজয় হত্যার পরে আনসার বাংলা-৮ নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। অভিজিৎ হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আনসার বাংলা-৭ নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে দায় স্বীকার করা হয়। নীলাদ্রির বাবা তারাপদ চট্টোপাধ্যায় ছেলের হত্যার বিচার দাবি করে বলেন, আমার নিরপরাধ ছেলেকে যারা হত্যা করেছে, আমি তাদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।