এসডিজিতেও আমরা এমডিজির মতো সফল হব
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) মতো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে আমরা একইভাবে সফল হব। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ওপর যথাযথ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে উন্নত দেশসমূহকে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রথাগত আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা যাতে দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বৈশ্বিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে সেই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও মনোযোগী হতে হবে। গত ১৫ নভেম্বর দুই দিনব্যাপী বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) বৈঠকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই আহ্বান জানান।
ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অতিথি ছিলেন এশিয়ান ইনফ্রাসটাকচার ব্যাংকের (এআইআইবি) প্রেসিডেন্ট জিন লিকুন, ইউএসএআইডির কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ও লোকাল কনসালটেটিভ গ্রুপের কো-চেয়ার ইয়ানিনা জেরুজালেস্কি, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়েনচাই ঝাং, জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল কিনগো তৈয়দা এবং বক্তব্য রাখেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন। উদ্বোধন ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী ডেভেলপমেন্ট ফেয়ার ঘুরে দেখেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আমাদের সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে এদেশের মানুষের সার্বিক উন্নয়নে বদ্ধপরিকর। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আমাদের সরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন ধারা এগিয়ে নিতে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখবে। বাংলাদেশকে অমিত সম্ভাবনার দেশ অভিহিত করে তিনি বলেন, বিশ্বের বুকে একটি গতিশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার মতো সব উপায় ও উপকরণ আমাদের রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের পেলে আমরা আনন্দিত হব।
উন্নয়ন রূপকল্প বাস্তবায়নে সহায়তার প্রতিশ্রুতি
আগামী পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন উন্নয়ন সহযোগীরা। তারা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। একই সাথে বৈশ্বিক উন্নয়নের নতুন এজেন্ডা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রেও তারা বাংলাদেশের পাশে থাকবেন। তবে কিছু সতর্ক বার্তাও এসেছে তাদের কাছ থেকে। উন্নয়ন সহযোগীরা মনে করেন, সরকারের রূপকল্প অনুযায়ী ২০২১ সাল নাগাদ ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে অবকাঠামোর বর্তমান ঘাটতি দূর করতে হবে। কর-জিডিপি অনুপাত এখনকার পর্যায়ে থাকলে কাক্সিক্ষত সাফল্য আসবে না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) বৈঠক শেষে গত ১৬ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের পক্ষ থেকে এসব কথা বলা হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন সংস্থা ও দেশের তিন শতাধিক প্রতিনিধি এতে অংশ নেন। ১৫ নভেম্বর বিডিএফ বৈঠক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুদিনের বৈঠকে মোট ৮টি অধিবেশনে বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রগতি ও ভবিষ্যতের নীতি-কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়।
সম্মেলন শেষে একটি যৌথ ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। বিডিএফের ইশতেহারে জানানো হয়, বৈঠকের আলোচনার ভিত্তিতে সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের দ্বিতীয় ‘যৌথ সহযোগিতা কৌশল’ প্রণয়ন করা হবে। সুশীল সমাজ ও বেসরকারি খাতকে সাথে নিয়ে কীভাবে সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীরা একত্রে কাজ করতে পারে তার বিস্তারিত এই কৌশলপত্রে থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবুদল মুহিত এমপি বলেন, উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের উন্নয়নের পরিকল্পনা সমর্থন করেছেন। কিছু সাবধানতার কথা বলেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তারা তা অনুমোদন করেছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তারা সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ইউএসএইডের মিশন পরিচালক ও বিডিএফের কো-চেয়ার জ্যানিনা জারুজেলস্কি বলেন, উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, এসডিজির লক্ষ্যগুলো অর্জন এবং সরকারের রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে সহায়তা দিতে প্রস্তুত। উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা উচ্চাভিলাষী হলেও সঠিক কৌশল এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা তাদের কাছে শুধু অর্থের কথা বলিনি। আমরা বলেছি কৌশলগত সহযোগিতা দিন। যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছি, আমাদের তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিন। এ বিষয়ে ইউএসএইডের মিশন পরিচালক বলেন, তিনি তার সরকারকে বাংলাদেশের আহ্বানের কথা জানাবেন।
নবগঠিত এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) প্রেসিডেন্ট জিন লিকুন সুনির্দিষ্ট কোনো খাতে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কি-না জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, তারা এখনও অর্থায়নের কার্যক্রম শুরু করেন নি। তার সাথে অবকাঠামো বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
যেসব পরামর্শ এসেছে : বিডিএফ বৈঠকে উন্নয়ন সহযোগীরা সরকারকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী জানান, সবাই বলেছেন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ যথার্থ নয়। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এখানে বরাদ্দ বাড়বে। সহযোগীরা মনে করেন, যত নতুন পরিকল্পনাই নেওয়া হোক, জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও পরিবহনসহ অবকাঠামোর ঘাটতি পূরণ না করলে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে না। তারা মানবসম্পদে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলেছেন। জোর দিয়েছেন গুণগত শিক্ষার ওপর। দক্ষতা উন্নয়নে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণও বৈঠকে গুরুত্ব পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ১৬ কোটি মানুষের উন্নয়ন ঢাকা থেকে করা সম্ভব নয়। আমাদের অবশ্যই ৭টি বিভাগ ও ৬৪টি জেলায় যেতে হবে।
ইউএসএইডের ঢাকা মিশন প্রধান জ্যানিনা জারুজেলস্কি বলেন, ৪টি দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন উন্নয়ন সহযোগীরা। সেগুলো হলোÑ বিশ্ব অর্থনীতির সাথে তাল মিলিয়ে দক্ষতা বাড়ানো, পুষ্টি সমস্যা দূর করা, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা এবং অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো।
দুদিনের আলোচনার সারমর্ম : বৈঠকে আলোচনায় সম্পদের সমবণ্টনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্ত হিসেবে চিহ্নিত করেন উন্নয়ন সহযোগীরা। তারা মনে করেন, ভূমির মালিকানা, করনীতি ও সরকারি সেবা ব্যবস্থাপনার সংস্কার, মানসম্মত শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী সম্প্রসারণের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা যেতে পারে। তাদের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরা হয় যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিতকরণের জন্য খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন। আঞ্চলিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য নিরসনের নিয়ামক হিসেবে সুদৃঢ় আঞ্চলিক যোগাযোগকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেন উন্নয়ন সহযোগীরা।
এ ছাড়া আইনের শাসনের ওপর প্রতিষ্ঠিত সুশাসন নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব দেন উন্নয়ন সহযোগীরা। তাদের মতে, বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারের কার্যকারিতা বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বাড়াতে হবে। দেশের বাজেটে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। উচ্চ মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে ১০ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা তৈরির প্রস্তাব দেন তারা। একই সাথে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার জন্য মন্ত্রণালয় এবং উচ্চ শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য আলাদা দুটি মন্ত্রণালয় গঠনের কথা বলেন তারা।
চরম দারিদ্র্যপীড়িত ও দুস্থ মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন প্রতিনিধিরা। তারা জানিয়েছেন, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো, বাল্যবিয়ে দূরীকরণ, অবৈতনিক নিয়োগ কমানো, ভূমি এবং উৎপাদনশীল সম্পদের ওপর নারীর প্রবেশাধিকার ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর বিষয়ে বৈঠকে মতামত দেওয়া হয়।