খুলাফা-ই-রাশিদীন, খলিফা ও খিলাফত
নূহ-উল-আলম লেনিন : খলিফা শব্দের আভিধানিক অর্থ A successor; a lientanant; a Vicegerant or a deputy. শব্দটি পবিত্র কোরআনে হযরত আদম (আ.) সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়েছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে।
সুরা ২, বাকারা : ৩০
আর (স্মরণ কর) যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, “আমি প্রতিনিধি সৃষ্টি করেছি, ‘তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকেও সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে। অথচ আমরাই তো আপনার সপ্রশংসা মহিমা কীর্তন ও পবিত্রতা ঘোষণা করি।…
সুরা ৩৮, স্বোয়াদ : ২৬
“হে দাউদ আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার কর…।”
ইসলামের ইতিহাসে খলিফা বলতে বুঝানো হয়েছে মহানবী হযরত মুহম্মদ (স.)-এর উত্তরাধিকারীকে, যার হাতে ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার বেসামরিক, সামরিক এবং ধর্মীয় বিধিবিধান প্রয়োগের সর্বময় ক্ষমতা। খলিফা ইসলামি আইনের রক্ষক, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী। তিনি একাধারে শাসক এবং মুসলিম সমাজের ইমাম বা ধর্মীয় নেতা। খলিফা কোরআন ও হাদিসের আলোকে দেশ শাসন, প্রজাপালন এবং ধর্মীয় কৃত্যসমূহ সম্পাদনের জন্য দায়িত্ববান। হযরত আবু বকর (রা.) ও অন্য সাহাবাদের মতে খলিফা হবেন (হযরত মুহম্মদ (স.)-এর পরিবারের বাইরের) কোরাইশ বংশ থেকে। হযরত আলী (রা.)-র অনুসারীদের মত ছিল খলিফা হবেন হযরত মুহম্মদ (স.)-এর পরিবারের সদস্যদের মধ্য থেকে।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য আইএস নামক জঙ্গি সংগঠন যে মতবাদ প্রচার করছে তার সারবত্তা বুঝতে হলে খিলাফত সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়।
হযরত মুহম্মদ (স.) মদিনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ১০ বছর অবস্থান করার পর ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রের কর্ণধার কে হবেন, তেমন কাউকে তিনি ঠিক করে যান নি। এ বিষয়ে হযরত মুহম্মদ (স.)-এর কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল না। আরবের ঐতিহ্যগত প্রথা অনুযায়ী গোত্রীয় প্রধানদের পদ বংশানুক্রমিক ছিল না। হযরত মুহম্মদ (স.)-এর মৃত্যুর পর আনসারগণ একত্র মিলিত হয়ে তাদের মধ্য থেকে একজনকে মদিনার শাসক মনোনীত করার উদ্যোগ নেয়। তাদের দাবি ছিল যেহেতু তারাই হযরত মুহম্মদ (স.) এবং তার সহযাত্রী শরণার্থী অর্থাৎ মুহাজিবদের মদিনায় স্থান দিয়েছে, মদিনায় ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করেছে, সে কারণে তাদের মধ্য থেকেই মদিনার শাসনকর্তা নিয়োগ করতে হবে। তারা সা’দ ইবনে উবায়দা নামে একজন খজরজকে নেতা নির্বাচনের জন্য পছন্দও করেছিল। আনসারদের এই উদ্যোগের কথা শুনে হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত উমর (রা.) অনৈক্য ও বিভেদের আশঙ্কা করে আনসারদের সভাস্থলে হাজির হন। আনসারদের যুক্তি মেনে নিয়েও আবু বকর (রা.) তাদের বুঝালেন যে, এখানে কেবল মদিনার শাসক নিয়োগ হবে না, সমগ্র আরবের জন্য, সকল গোত্রের গ্রহণযোগ্য একজনকে শাসনকর্তা নিয়োগ করতে হবে। এ প্রশ্নে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা, বাগ্বিত-া এবং যুক্তি পাল্টাযুক্তি চলতে থাকল। এক পর্যায়ে কুরাইশদের মধ্য থেকে একজনকে শাসনকর্তা নিয়োগের প্রশ্নে ঐকমত্য হয়। স্বাভাবিকভাবেই বয়োজ্যেষ্ঠ এবং হযরত মুহম্মদ (স.)-এর বিশ্বস্ত সাহাবা, যাকে তিনি তার অসুস্থতার সময় নামাজে ইমামতি করতে দিয়েছিলেন, সেই হযরত আবু বকর (রা.)-কেই তারা খলিফা এবং ইমাম হিসেবে নির্বাচিত করে। সবাই তার আনুগত্য মেনে নেয়।
এভাবে হযরত মুহম্মদের (স.) মৃত্যুর পর খিলাফতের যাত্রা শুরু হয়। হযরত আবু বকর (রা.)-এর পর হযরত উমর, হযরত উসমান (রা.) এবং হযরত আলী (রা.) খলিফার দায়িত্ব পান। এই চার খলিফার মধ্যে আবু বকর (রা.) ছাড়া অন্য তিনজনই আততায়ীর হাতে নিহত হন। ইসলামের ইতিহাসে এই চারজন খলিফার শাসনকালকেই ‘খুলাফা-ই-রাশিদীনের’ যুগ বলা হয়। খুলাফা-ই-রাশিদীনের অর্থ সত্য পথে পরিচালিত খলিফাগণ। “ওরা সবাই হযরত মুহম্মদ (স.)-এর নিকটতম ও প্রিয়তম সাহাবা ছিলেন এবং তারই শিক্ষা ও আদর্শ এঁদেরকে সরাসরিভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং তাঁরই প্রদর্শিত পথে এঁরা শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। সেই জন্যই এঁদেরকে খুলাফা-ই-রাশিদীন বা সত্য পথে পরিচালিত খলিফা বলা হয়।” (ড. মফীজুল্লাহ কবীর, ইসলাম ও খিলাফত)
তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান গণী (রা.) আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পাঁচ দিন পর হযরত আলী (রা.) অনিচ্ছা সত্ত্বেও খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দামেস্কের প্রাদেশিক শাসক মু’আবিয়া (রা.) ছাড়া অন্য সবাই আলী (রা.)-র আনুগত্য মেনে নেন। মু’আবিয়া (রা.) উসমান (রা.)-এর হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন। মু’আবিয়া (রা.) ও আলী (রা.)-র বিরোধ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে পর্যবসিত হয়।
আলী (রা.) ও মু’আবিয়া (রা.)-র মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও সমঝোতা হলেও শেষ পর্যন্ত চতুর মু’আবিয়া (রা.) আলী (রা.)-র প্রতি আনুগত্য প্রকাশে অস্বীকৃতি জানায়। আলী (রা.) মদিনা হতে কুফায় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। এদিকে মু’আবিয়া (রা.) নিজেকে খলিফা হিসেবে দাবি জানায়। তবে আলী (রা.)-র জীবিতাবস্থায় সে প্রকাশ্যে নিজেকে খলিফা বলতে সাহস পায় নি। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে খারিজি সম্প্রদায়ের তিনজন ঘাতক কুফায় আলী (রা.)-কে, দামাস্কাসে মু’আবিয়া (রা.)-কে এবং ফুসকাতে আমর (রা.)-কে একই দিনে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। আমর ওই দিন অসুস্থ থাকায় মসজিদে না আসায় হত্যা চক্রান্ত থেকে বেঁচে যান। আলী কুফায় এবং মু’আবিয়া (রা.) দামাস্কাসে আক্রান্ত হন। মু’আবিয়া (রা.) আহত হন। কিন্তু আলী (রা.) কুফার মসজিদে নিহত হন। আলীর (রা.) মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠপুত্র হাসান (রা.) খলিফা ঘোষিত হয়। কিন্তু স্বল্প দিনের মধ্যেই হাসান বিষ প্রয়োগে নিহত হন।
এদিকে মু’আবিয়া (রা.) সুস্থ হয়ে উঠে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে সমগ্র মুসলিম জগতের খলিফা ঘোষণা করেন। শুরু হয় বংশগত উমাইয়া শাসন। অন্যদিকে আলী (রা.)-র মৃত্যুর মধ্য দিয়ে খুলাফা-ই-রাশিদীনের অবসান ঘটে। তবে ইতোমধ্যে মুসলিম সমাজ সুন্নী ও শিয়া মতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শিয়ারা সুন্নী শাসকদের খলিফা এবং তাদের ইমাম হিসেবে অস্বীকৃতি জানায়। শিয়াদের ওপর চরম নির্যাতন সত্ত্বেও শিয়া মুসলমানগণ হযরত আলী (রা.)-র বংশধর ১২ জন ইমামকে তাদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে কয়েক শতাব্দীব্যাপী অনুসরণ করেছে।
৬৬১ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১২৬১ বছর দামাস্কাস, বাগদাদ, কায়রো, কর্ডোভা ও কনস্টান্টিনিপল্স-এ আরব-অনারব বিভিন্ন বংশের নামে যে খিলাফত চালু ছিল, তা আসলে ছিল বংশগত রাজতন্ত্র।
নি¤েœ বিভিন্ন খিলাফতের শাসনকাল উল্লেখ করা হলোÑ
১. খুলাফা-ই-রাশিদীন ৬৩২-৬৬০ খ্রি. মদিনা Ñ কুফা
২. উমাইয়া বংশ (দামাস্কাস) ৬৬১-৭৪৯ খ্রি.
৩. আব্বাসীয় বংশ (বাগদাদ) ৭৫০-১২৪০ খ্রি.
৪. ফাতেমি (কায়রো) ৯১০-১১৭১ খ্রি. (শিয়া অনুসারী)
৫. স্পেনের খিলাফত (কর্ডোভা ও গ্রানাডা) ৭৫৫-১৪৯২ খ্রি.
৬. ওসমানীয় (অটোমান) (কনস্টান্টিনিপল্স) ১২৯৯-১৯২২ খ্রি.
উল্লিখিত চিত্র থেকে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে উমাইয়া খিলাফতের পর মুসলিম বিশ্বে বস্তুত একক শাসনকেন্দ্র ও খিলাফত ছিল না। আব্বাসীয়, ফাতেমাইড এবং স্পেনীয় খিলাফত সমান্তরালভাবে চালু ছিল। তেমনি অটোমান সা¤্রাজ্য বা খিলাফত (১২৯৯-১৯২২) বিদ্যমান থাকা অবস্থায়ই কর্ডোভা ও গ্রানাডার পতনের পূর্ব পর্যন্ত স্পেনীয় খিলাফত (৭৫৫-১৪৯২ খ্রি.) ও স্বাধীনভাবে তাদের অধিকৃত রাজ্য শাসন করেছে। ইতোমধ্যে অন্যান্য খিলাফতের পতন ঘটলেও একমাত্র অটোমান খিলাফত বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত টিকে ছিল। কিন্তু অটোমান শাসকরা প্রথম থেকেই নিজেদের ‘সুলতান’ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের জন্যই কেবল নিজেদের ‘খলিফা’ বলে সা¤্রাজ্য শাসন করেছেন।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ইসলামি বিশ্ব উমাইয়াদের পর আর কখনোই এক কেন্দ্রের শাসনাধীন বা খিলাফতের অধীন ছিল না। মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, পূর্ব আফ্রিকা, তুরস্ক ও স্পেনে যখন নানা বংশের তথাকথিত খিলাফত চালু ছিল, তখন অবিভক্ত ভারতে সুলতানি আমল ও মোগল আমলের শাসকরা নিজেদের রাজা-বাদশাহ হিসেবেই বংশানুক্রমিক শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। দূরপ্রাচ্যেÑ ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় কোনো খিলাফত ছিল না। সেখানেও ছোট-বড় রাজা-বাদশাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল।
সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় পরাধীন ভারতবর্ষে যখন মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে নিয়ে (খিলাফত কমিটি ও কংগ্রেসের ঐক্য) অটোমান খিলাফত রক্ষার আন্দোলনে জান কবুল আন্দোলনে রত, তখন খোদ তুরস্কের জনগণ কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে খিলাফতের অবসান ঘটাতে ব্যস্ত।
উনিশ শতকে আরব উপদ্বীপে মৌলবাদী ওয়াহাবি মতাদর্শবাদের অনুসারী গোষ্ঠীটি বর্তমান সৌদি পরিবারকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে সাহায্য করে। ওয়াহাবিরা যতই আদি ইসলামে ফিরে যাওয়ার ফতোয়া দিক না কেন, তারা নিজেরা খুলাফা-ই-রাশিদীন বা খিলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করে বরং সৌদি আরবে বংশগত রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করে। এখনও সৌদি রাজ পরিবার ও সৌদি আরবের জনগণ ওহাবি মতাদর্শ অনুসরণ করছে।
উপরোক্ত ঐতিহাসিক তথ্য বিচার করে এ কথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, বর্তমানে ইরাক-সিরিয়ায় যুদ্ধরত আইএস জঙ্গিরা যে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে, তার সাথে ইসলামি খিলাফতের কোনো সম্পর্ক নেই।