ইতিহাস : প্রবন্ধ

গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ও সাফল্যের তিন বছর

আবদুল মান্নান : বাংলাদেশে গণতন্ত্র কী হুমকির মুখে? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের নিত্যদিন হতে হয়। একটি দেশ যদি দীর্ঘ সময় ধরে গণতন্ত্র চর্চা করে তা হলে তা কখনো হুমকির মুখে পড়ার কথা নয়। যেমনÑ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত অথবা জাপান। এসব দেশেই একাধিক রাজনৈতিক দল আছে। কোনো কোনোটিতে সীমিত, যেমন যুক্তরাষ্ট্র অথবা যুক্তরাজ্য। আবার কোনোটিতে শয়ের ওপর, যেমন ভারত। সেই সব দেশে সাংবিধানিক নিয়ম মেনে গণতন্ত্র চর্চা হয়। সময়মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী দল বা জোট ক্ষমতাসীন হয় এবং সংবিধানে বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে পরিবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসব দেশে আবার কোনো কোনোটিতে নির্বাচন কমিশনই নেই, যেমন যুক্তরাষ্ট্র। আবার কোটি কোটি ভোটারের জন্য খুবই ছোট আকারের নির্বাচন কমিশন থাকে, যেমন ভারত। বিশাল ভারতবর্ষে নির্বাচন কমিশনের সদস্য সংখ্যা মাত্র তিনজন, যাদের একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। নির্বাচন কমিশন সংবিধানের আওতায় এবং কমিশনের আইনের অধীনে কাজ করে। একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দেশের সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক ভোটার হতে পারেন এবং নির্বাচনেও অংশগ্রহণ নিতে পারেন। তবে এই অধিকার আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা দীর্ঘদিনের জন্য ব্যাহত হয়। প্রথমে বঙ্গবন্ধুর খুনি খোন্দকার মোশতাক জেনারেল জিয়ার নির্দেশেই সংবিধান স্থগিত করে দেশে সামরিক আইন জারি করেন। কিছুদিন পর জিয়া মোশতাককে সরিয়ে নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। অবশ্য জেল হত্যাকা-ের পর কিছুদিনের জন্য বিচারপতি সায়েম সাক্ষিগোপাল রাষ্ট্রপতি ছিলেন। জিয়া শুধু রাষ্ট্রপতিই নন, জেনারেল সফিউল্লাহকে সরিয়ে নিজে সেনাপ্রধান হন এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোটের তামাশার মাধ্যমে নিজের রাষ্ট্রপতির পদ দখল করাকে বৈধতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এই নির্বাচনে কোনো কোনো কেন্দ্রে ১০০ ভাগেরও বেশি ভোট গণনা করা হয়। জিয়া তার এককালীন সহকর্মী জেনারেল আইয়ুব খানের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। জিয়া মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর নিয়ে পিছনের তারিখ দিয়ে নিজেকে লে. জেনারেল পদে পদোন্নতিও দিয়েছিলেন। দেশে গণতন্ত্র থাকলে তা কখনও সম্ভব ছিল না। জিয়ার মৃত্যুর পর তার উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি পরে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হয়ে ছিলেন। কিন্তু তাকেও এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন এবং পরবর্তীকালে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। নব্বইয়ের দশকে তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন হলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল।
১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামাতের সাথে একটি গোপন আঁতাত করে বিজয়ী হয়েছিল যদিও শুরুর দিকে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো তাদের প্রার্থীই ছিল না। তাদের অনেক প্রার্থী প্রথমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে বিজয় লাভ করেন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের পিছনে মূলত কাজ করেছিল অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস ও কিছুটা অগোছালো নির্বাচন পরিচালনা।
একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশে এ ধরনের নির্বাচনকে কখনো হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। এই মেয়াদে নির্বাচিত সংসদের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা চালু। নানা বাধা-বিপত্তি ও সমস্যা থাকা সত্ত্বেও পঞ্চম সংসদ অনেকটা কার্যকর ছিল; কিন্তু ১৯৯৪ সালের মাগুরা উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল বিএনপির নজিরবিহীন কারচুপির ফলে সংসদের ভিতরে ও বাইরের বিরোধী দলসমূহ বিএনপির মতো একটি দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয় বলে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ৩টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তুলে তা আদায়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এতে বিএনপি ছাড়া সকল দল অংশগ্রহণ করে। প্রথমে এই দাবি মানতে বিএনপি অস্বীকার করে এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সব দলের বর্জনের মুখে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে। সব দল সেই নির্বাচন বর্জন করলেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নিয়ে গঠিত ফ্রিডম পার্টি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। যদিও এই নির্বাচন আওয়ামী লীগ বর্জন করে এবং তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখে কিন্তু সেই আন্দোলনের চেহারা বর্তমানের মতো এত ভয়াবহ ছিল না। আগুনে পুড়ে কিংবা বোমার আঘাতে কোনো নিরপরাধ মানুষের প্রাণ হরণ হয়নি। জনগণের সম্পদে আগুন দেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। কোথাও রেললাইন উপড়ানো হয় নি। ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়ে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল (অব.) আবদুর রশিদ। তাকে বেগম জিয়া সংসদে বিরোধীদলীয় নেতাও বানিয়েছিলেন। আন্দোলনের মুখে সেই সংসদেই পাস হয়েছিল ত্রয়োদশ সংশোধনী, যা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নামে পরিচিত। সব দলের ও জনগণের অংশগ্রহণের ফলে আন্দোলন বেগবান হলে বেগম জিয়া ৩০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী পদ হতে পদত্যাগ করেন এবং রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেন। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সাংবিধানিকভাবে গঠিত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয় এবং সমমনা কয়েকটি দলের সমর্থনে সরকার গঠন করে। উল্লেখ্য, বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কয়েক সপ্তাহ পর ২০ মে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস অনিয়মতান্ত্রিক ও নজিরবিহীনভাবে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমকে বরখাস্ত করে সেনাবাহিনীতে একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেন, যা বিচারপতি হাবিবুর রহমানের বিচক্ষণতার কারণে ভেস্তে যায়।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বেগম জিয়া তার পরাজয়কে কখনো সহজভাবে নিতে পারেননি। তিনি অভিযোগ তোলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনার পক্ষপাতিত্বের কারণে তাকে এই নির্বাচনে হারতে হয়েছে। আবু হেনার পদত্যাগের দাবিতে তিনি ও তার দল শুরু থেকেই দেশে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ২০০১ সালের মেয়াদ শেষে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার শান্তিপূর্ণভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয় এক গভীর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কাছে। এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু সাঈদ আর বিদেশি কিছু গোয়েন্দা সংস্থা। নির্বাচনে পরাজিত হলেও শেখ হাসিনা পরাজয় মেনে নিয়েছিলেন। সেই পাকিস্তান আমল হতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার জন্য সব সময় চেষ্টা করা হয়েছে। কখনো এই চেষ্টায় সেনাবাহিনী জড়িত ছিল আবার কখনো সিভিল প্রশাসন। তাদের সহায়তা করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল। ষড়যন্ত্রের কাছে আওয়ামী লীগ সব সময় পরাভূত হয়েছে।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি দাবি তোলে তাদের ভাষায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া তারা অথবা তাদের জোটভুক্ত দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। সংবিধানের আওতায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এ ব্যবস্থায় নির্বাচন সম্ভব নয়। আর সংবিধানের যে ধারা দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল করে দিয়েছেন তাকেও সংবিধানে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। কিন্তু এসব কথা বেগম জিয়া বা তার মিত্ররা শুনতে নারাজ। তারা তাদের দাবি পূরণে সরকারকে বাধ্য করতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির কয়েক মাস আগে থেকেই দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তারা ঘোষণা দেয় তারা শুধু নির্বাচন বর্জনই করবে না প্রতিহত ও প্রতিরোধও করবে। বিএনপির জন্য সেই যুদ্ধ ছিল ক্ষমতায় যাওয়ার যুদ্ধ আর তাদের প্রধান মিত্র জামাতের জন্য ছিল একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাদের যেসব শীর্ষ স্থানীয় নেতা বিচারের মুখোমুখি তাদের বাঁচানো। সেই যুদ্ধে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল ৫ হাজার বাস। ১০ হাজার গাড়িতে আগুন দেওয়াসহ ভাঙচুর করা হয়। ১৪৮ মানুষকে হত্যা করা হয়, যাদের মধ্যে ছিল ৫৬ জন গাড়িচালক। ভয়াবহ পেট্রলবোমা সন্ত্রাসে নতুন অস্ত্র হিসেবে অভিষিক্ত হয়। শতাধিক নিরীহ মানুষ পেট্রলবোমার আঘাতে ঝলসে যায়, যাদের অনেকেই জীবন-মৃত্যুর সাথে লড়াই করে পরাজিত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে আন্দোলনের নামে প্রথমবারের মতো পুলিশ, বিজেবি ও সেনাসদস্যকে হত্যা করা হয়। রেললাইন তুলে ফেলার উৎসব শুরু হয়। নির্বিচারে রেলের বগিতে আগুন দেওয়ার ঘটনা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে ওঠে। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে প্রথমবারের মতো। একাত্তরের পর এমন ভয়াবহ নৃশংসতা এই দেশের মানুষ কখনো ঘটতে দেখেনি। এতসব ভয়াবহ ঘটনার পরও প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রীকে নির্বাচনকালীন একটি সর্বদলীয় অন্তবর্তীকালীন সরকার যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান এবং বলেন বেগম জিয়া যে কটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে চান তা-ই তাকে দেওয়া হবে। কিন্তু বেগম জিয়া তার অবস্থানে অনড় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ আসনে বিজয় লাভ করে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। এই নির্বাচন যদি না হতো, তা হলে দেশে অবধারিতভাবে একটি সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হতো এবং তার ফাঁকে তৃতীয় কোনো শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করত। বেগম জিয়া সম্ভবত তা-ই প্রত্যাশা করছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কারণে এ যাত্রায় বেগম জিয়ার সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায় এবং যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এক বছর পর পিছন ফিরে দেখা যেতে পারে গত এক বছরে সরকারের অর্জন কেমন ছিল এবং জনগণের কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু বেড়েছে বা কমেছে। দেশের একটি প্রথম শ্রেণির ইংরেজি দৈনিক ‘ঢাকা ট্রিবিউন’ গত ১২ জানুয়ারি দেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে একটি জাতীয় জরিপ প্রকাশ করে। সেই জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭২ শতাংশ মানুষ মনে করেছে বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনায় সফল হয়েছে এবং ৬২ শতাংশ বিএনপির গত এক বছরের কর্মকা-কে অসফল কর্মকা- হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ৪১.৩ শতাংশ মানুষ মনে করেছে এ মুহূর্তে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেন। এর বিপরীতে বিএনপির ঘরে রায় পড়েছে ৩৩.৭ শতাংশ। ৪৫.৬ শতাংশ মানুষ শেখ হাসিনাকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। বেগম জিয়াকে চেয়েছেন ২২.২ শতাংশ মানুষ। বিএনপি এবং তাদের মিত্রদের এত গণবিধ্বংসী আন্দোলন আন্দোলন খেলার পরও আওয়ামী লীগ তথা বর্তমান সরকার কেন এই জরিপে এগিয়ে থাকল? এমন প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। তার সহজ-সরল উত্তর হতে পারে গত এক বছরে সরকারের অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সরকার দেশের মানুষকে অনেক স্বস্তিতে রাখতে পেরেছে।
গত এক বছরে সরকারের দুটি বড় অর্জন সম্পর্কে না বললেই নয়। প্রথমটি ছিল বিশ্বব্যাংকসহ অনেক দেশি ও বিদেশি গোষ্ঠীর নানা ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ শুরু করা, যার অগ্রগতি এখন বিশ্ববাসীর কাছে পরিষ্কার দৃশ্যমান। এই একটি অর্জন বাংলাদেশের সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। দ্বিতীয় অর্জন এই সময়ে বাংলাদেশ শুধু খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই লাভ করেনি, এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ একটি খাদ্য রপ্তানি দেশ হিসেবে আভির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে চতুর্থ বৃহৎ চাল উৎপাদনকারী দেশ। যে দেশ নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদন করতে পারে, সেই দেশকে পিছনে ফিরে থাকতে হয় না। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার সরকার পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার পর তার ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করে। একটি চরম অনিশ্চিত বিশ্বে শুধু বার্ষিক পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে দেশের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ের সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার ওপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে এবং এর ফলে দেশের সার্বিক অগ্রযাত্রা বারবার হোঁচট খেয়েছে। বিশ্বের অনেক প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ও সমাজ-চিন্তকরা বর্তমানে স্বীকার করছে বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বের উন্নয়নের একটি রোল মডেল এবং বিশ্বে যে কটি স্বল্পন্নোত দেশ দ্রুত উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে, তার মধ্যে প্রথম ৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বিগত বছরে একমাত্র শ্রীলংকা ছাড়া এশিয়ার কোনো দেশই জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ওপরে রাখতে পারেনি, বাংলাদেশ পেরেছে। বর্তমানে এই প্রবৃদ্ধি ৬.১১ শতাংশ। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেটের পরিমাণ ছিল ৬১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, তা আগামী অর্থবছরে ৩ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হবে। বিএনপি-জামাত জোট যখন ক্ষমতা ছাড়ে তখন বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার, তা বর্তমানে ১ হাজার ১৯০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। বর্তমান আর্থিক বছর শেষ হওয়ার আগেই তা ১ হাজার ২০০ ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ২৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, যা আগামী এক বছরে ২০ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে অর্থনীতিবিদরা ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। অথচ বিএনপি-জামাত জোট যখন ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ে তখন বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। একেবারে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০০৬ সালে ২৪.২ শতাংশ হতে বর্তমানে ১১ শতাংশে নেমে এসেছে। গত এক বছরে ৫ কোটি মানুষ নি¤œ আয়ের তালিকা হতে মধ্যম আয়ের তালিকায় উঠে এসেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর সরকারের প্রচেষ্টায় দেশে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং ২৫ লাখ মানুষ কাজ নিয়ে দেশের বাইরে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি বিদেশে আমাদের দেশের যেসব মানুষ কর্মরত আছেন তাদের রেমিট্যান্স। ২০০৬ সালে তারা বাংলাদেশে ৪.৮০ বিলিয়ন ডলার প্রেরণ করত, যা বর্তমানে ২২.৩৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩.৪৮ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বিদেশি পুঁজি যে কোনো স্বল্পোন্নত দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকটি দেশই এই পুঁজি আকর্ষণ করার জন্য চেষ্টা করে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু বাংলাদেশে অবকাঠামোগত সুবিধার অপ্রতুলতা ও সুশাসনের অভাবে সেই পুঁজি আমরা সব সময় আকর্ষণ করতে পারিনি। সেই পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশ গত এক বছরে কিছুটা হলেও সামনের দিক অগ্রসর হতে পেরেছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ০.৭৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৪ সালে ৬.৮৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে যেখানে আমাদের রপ্তানি আয় ছিল ১০.৫৩ বিলিয়ন ডলার, তা গত অর্থবছরে ৩০.১৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। মনে রাখতে হবে এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে দিয়েছিল। শিল্পোৎপাদানের বড় চালিকাশক্তি হচ্ছে জ্বালানি তথা বিদ্যুৎ। এশিয়ার প্রায় প্রত্যেকটি দেশই বিদ্যুৎ ঘাটতির দেশ। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল ৩২০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে বাংলাদেশ ১৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে বিতরণ সমস্যা মুখ্য। উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো নিঃসন্দেহে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের বড় সাফল্য। তবে মনে রাখতে হবে বিদ্যুতের চাহিদা সব সময় উৎপাদনের আগে আগে চলে। এটি সব দেশের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
শিক্ষা জাতির মেরুদ-। বর্তমানে বাংলাদেশ শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সফলতা অর্জন করেছে তা বিশ্বে যে কোনো দেশের জন্যই একটি অনুকরণ যোগ্য উদাহরণ। বাংলাদেশই বিশ্বে একমাত্র দেশ যে দেশ বছরের প্রথম দিনেই প্রায় ৩২ কোটি পাঠ্য পুস্তক প্রাইমারি স্কুল ও মাদ্রাসার ছাত্রদের হাতে পৌঁছে দেয়। তবে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার সংখ্যা আমাদের দেশে এখনো বেশ বড় সমস্যা। শিশুদের স্কুলে ধরে রাখা এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে দেশের ৬৯ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত বলে দাবি করতে পারে, যা ২০০৬ সালে ৪৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপ দেয় এমন মানুষ বাংলাদেশে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের গত এক বছরের অর্জন তাক লাগানোর মতো। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা বাহিনীতে বর্তমানে ৯ হাজার বাংলাদেশি প্রতিরক্ষা ও পুলিশ বাহিনী কর্মরত আছেন, যা এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এক নম্বর অবস্থানে নিয়ে গেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ১২টি আন্তর্জাতিক সংস্থায় নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছে, যার মধ্যে আছে আইএমএসও, আইটিইউ ও মানবাধিকার কমিশন। তবে সবচেয়ে তাক লাগানো নির্বাচন ছিল কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি ইউনিয়নে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর বিজয় এবং তার রেশ না ফুরাতেই সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী আন্তঃপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন, যা ছিল তার জন্য দ্বিতীয় দফর অর্জন। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জন করা। কিছু নৈরাশ্যবাদী ছাড়া এখন এটি পরিষ্কার যে ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ এই লক্ষ অর্জন করবে এবং একদা হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে যে দেশটিকে পরিচিত করার চেষ্টা করেছিলেন তা একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে পরিচিত হবে।
বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাপকাঠিতে অনেক ক্ষেত্রে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে; যেমন মাতৃমৃত্যু, বিশুদ্ধ পানীয় জলের প্রাপ্যতা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, প্রাথমিক শিক্ষার হার, পল্লি বিদ্যুতায়ন, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি। বাংলাদেশের এসব অর্জন বিশ্ব স্বীকৃত। তবে বাংলাদেশকে পিছনের দিকে টেনে ধরতে এখনও একাধিক শক্তি কাজ করছে। বাংলাদেশের মানুষকেই ঠিক করতে হবে তারা কী উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় থাকবেন না-কি আবার আগের অস্বস্তিকর স্থবির যুগে ফিরে যাবেন। তারা বাংলাদেশকে একটি শান্তির দেশ হিসেবে দেখতে চায় না-কি একটি জঙ্গিবাদী অকার্যকর ও রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত হতে চায়। সরকারের সামনে এখন একাধিক বড় চ্যালেঞ্জ। এগুলোর মধ্যে আছে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার সকল ষড়যন্ত্র রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা এবং যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি বাস্তবায়ন করার কার্যকর ব্যবস্থা করা। পথ নিঃসন্দেহে দীর্ঘ। তবে জনগণের ওপর আস্থা ধরে রাখতে পারলে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া কঠিন নয়।
গণতন্ত্র চাইলেই পাওয়া যায় না। তার জন্য একাত্তরে ত্রিশ লক্ষ মানুষ নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। সেই শহীদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান দেখানো দেশের ১৬ কোটি মানুষের কর্তব্য।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[১৩ জানুয়ারি ২০১৫ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট সেমিনার কক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটি আয়োজিত ‘গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা : সাফল্যের এক বছর’ শীর্ষক সেমিনারের মূল প্রবন্ধ থেকে সংক্ষেপিত]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *