প্রতিবেদন

গণতন্ত্রের বীর সেনানী শহীদ মো. ময়েজউদ্দিন

১৯৩০ সালের ১৭ মার্চ তার জন্ম। গণতন্ত্র রক্ষার এই বীর সেনানীর ৩১তম শাহাদাতবার্ষিকী আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর। একজন সমাজসেবক ও আইনজীবী শহীদ মো. ময়েজউদ্দিন আজীবন মানুষের সেবা করে গেছেন। বর্তমান গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার মোক্তারপুর ইউনিয়নের বড়হরা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজসেবক হিসেবে শহীদ মো. ময়েজউদ্দিন জনতার হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন।
১৯৪৮ সালে কালিগঞ্জ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ (আরআরএন) পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা, ১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। ১৯৫৬ সালে সিএসপিতে (বর্তমানে বিসিএস) কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েও স্বাধীনচেতা ময়েজউদ্দিন সরকারি চাকরিতে যোগদান না করে ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করেন। পাশাপাশি পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে নজরে আসেন। কলেজে পড়ার সময়ই ময়েজউদ্দিন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের কুখ্যাত হামিদুর রহমান কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দেন। এরপর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পরিচালনায় অগ্রণী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধেও অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকেই বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বঙ্গবন্ধুও তাকে খুব ভালোবাসতেন। এ ছাড়া, বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে তার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। স্বৈরশাসক পাকিস্তানি গোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনায় সাহসিকতার সাথে গুরুদায়িত্ব হিসেবে পালন করেন। ময়েজউদ্দিন ছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘মুজিব তহবিল’ গঠনের আহ্বায়ক। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৭০ সালে কালিগঞ্জ নির্বাচনী এলাকা থেকে ‘প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য’ ও ১৯৭৩ সালে ‘জাতীয় সংসদ সদস্য’ নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর খন্দকার মোশতাক কর্তৃক আহূত সংসদ অধিবেশনে বিশ্বাসঘাতক স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খুনি মোশতাকের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বক্তব্য রেখে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কৈফিয়ত চেয়ে তীব্র প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করে অধিবেশনের সবাইকে হতবাক করে দেন।
১৯৭৫ সালের বিয়োগান্তক ঘটনার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন ময়েজউদ্দিন। পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্য সময় তিনি বৃহত্তম ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের প্রথমে সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্ব বেশ বিশ্বস্ততার সাথে পালন করেন। একই সময়ে তিনি ঢাকা মহানগর ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেও ছিলেন। রাজনীতি করার ফাঁকেই কর্মজীবনে প্রবেশ তার। প্রথমে ঢাকাস্থ সিদ্বেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। পরে আইনজীবী হিসেবে ঢাকা বার ও সুপ্রিমকোর্ট বারে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। কুখ্যাত আইয়ুব-মোনায়েম খানের পেটোয়া বাহিনীর প্রবল বিরোধিতার মুখেও কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদের ‘চেয়ারম্যান’ নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বও ময়েজউদ্দিন পালন করেন। রাজনীতি ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি একজন সমাজসেবক হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তোলেন। ১৯৭৭ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নির্বাচিত সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির অবৈতনিক সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান প্যারেনহুড ফেডারেশন-আইপিপিএফ সহ আইওআর-এর সদস্য ছিলেন। এর বাইরে REXCO-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের প্রেসিডেন্টও ছিলেন ময়েজউদ্দিন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে জাতির ইতিহাসকে মুছে ফেলা হয়। সেই দুর্বিষহ প্রেক্ষাপটে জাতির মুক্তির লক্ষ্যে মানুষের গণতন্ত্র, ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের অপচেষ্টা চালানো হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশব্যাপী স্বৈরাচার সামরিক শাসকবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ। সে সময় ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সারাদেশে আহূত হরতাল চলাকালে নিজ নির্বাচনী এলাকা গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জের মাটিতে সকাল ৯টা ১৫ মিনিটের সময় রাজপথে মিছিলের নেতৃত্বে থাকাকালীন থানার সন্নিকটে পুলিশের সহযোগিতায় স্বৈরশাসকের লেলিয়ে দেওয়া পেটোয়ো বাহিনী একজন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নেতাকে প্রকাশ্যে দিবালোকে নৃশংসভাবে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। সারাজীবন মানুষের সেবায় নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিলেও সেই ঘাতকরূপী মানুষের হাতেই তার মৃত্যু হয়।
Ñ মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *