গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগর
এইচ টি ইমামঃ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত এবং পাকিস্তান গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ এমএনএ ও এমপিএ-গণ ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা (Proclamation of Independence) নামে পঠিত হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণাপত্রেই লেখা আছে সুস্পষ্টভাবে যে, যেহেতু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, সেহেতু ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা কার্যকর হবে। এই সাথে আরেকটি আইন প্রণয়ন করা হয়। আইনের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য যেটি Laws Continuance In Force Order নামে পরিচিত। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়োগ করা হয়। ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ এবং ওই দিনই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যাত্রা শুরু। প্রধানমন্ত্রী ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিসভা গঠনের ঘোষণা দেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভা ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আ¤্রকাননে শপথ গ্রহণ করেন। এই স্থানটির নামকরণ করা হয় ‘মুজিবনগর’।
যেহেতু এই সরকার মুজিবনগরে তার প্রধান দফতর স্থাপন করেছিল, তাই এর ব্যাপক পরিচিতি হলো ‘মুজিবনগর সরকার’ রূপে। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এই সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতায় স্থাপন করা হয় প্রধানত নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে নির্বিঘœ নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে। আমাদের সরকারের বিভিন্ন কার্যাবলি পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে কত ব্যাপক এবং সুসংগঠিত ছিল সরকারের কর্মসূচি এবং গঠন-কাঠামো।
এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা বিশেষ প্রয়োজন যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে কেবলই ‘মুজিবনগর সরকার’ নামে আখ্যায়িত করে (যেহেতু তার প্রধান কার্যালয় ভারতে অবস্থিত ছিল তাই) তাকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার অনেক অপচেষ্টা হয়েছে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সরকারের মাত্র সাড়ে তিন বছর এবং শেখ হাসিনা সরকারের পাঁচ বছর এবং ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল মেয়াদি সরকারের প্রথম তিন বছর বাদে সুদীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে। স্বাধীনতাবিরোধীরা নানাভাবে চেষ্টা করেছে একে ‘পুতুল সরকার’ বলে পরিচয় দেওয়ার। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর থেকে ১৯৯৬ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত এবং ২০০১ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ইতিহাস বিকৃত করে লেখায়, আলোচনায়, টিভি, রেডিও ও সব প্রচারযন্ত্রকে ব্যবহার করে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ছোট করার চেষ্টা করেছে এবং তাদের সে অপচেষ্টা অব্যাহত আছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার আকারে বিশাল না হলেও অত্যন্ত সুসংগঠিত ছিল। প্রচ- প্রতিকূলতার মধ্যে এই সরকার গঠন করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একদিকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব, অন্যদিকে ১ কোটির ওপর শরণার্থীর জন্য ত্রাণ ব্যবস্থা; দেশের অভ্যন্তর থেকে লক্ষ লক্ষ মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতা যুবাদের যুবশিবিরে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানিদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি; স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ রাখা এবং সাথে সাথে সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিÑ এসবই ছিল প্রবাসী সরকারের অবিস্মরণীয় কীর্তি যা সমকালীন ইতিহাসের বিচারে অতুলনীয়।
একটি স্বাধীন দেশের সরকারের বৈশিষ্ট্য কী, সে সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ করলেই মুজিবনগরের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যথার্থ চরিত্র ও রূপ পরিষ্কার হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রচলিত সংজ্ঞায় গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতি দুই রকমের হতে পারেÑ
(ক) রাষ্ট্রপতি শাসিত এবং (খ) সংসদীয়। আওয়ামী লীগের মতাদর্শ এবং নির্বাচনী ঘোষণা (মেনিফেস্টো) অনুসারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার গঠন করা হয় সংসদীয় পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলীয় নেতার হাতে। তিনি হলেন সরকারপ্রধান। রাষ্ট্রপ্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি। সংসদীয় পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপ্রধান নিজে কোনো নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না, দুয়েকটি বিষয় ব্যতীত।
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামকরণেই বোঝা যায় এটা প্রজাতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অবিসংবাদিত নেতা। তার অনুপস্থিতিতে দলনেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ। মুজিবনগরে তিনি গঠন করেছিলেন মন্ত্রিসভা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম নির্বাচিত হয়েছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি রূপে। কর্নেল ওসমানী সশস্ত্র বাহিনীপ্রধান নিযুক্ত হন (১৭.০৪.১৯৭১)। অধিকন্তু তাকে মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হয়। এত ছোট আকৃতির মন্ত্রিসভা এবং সরকারি দফতর নিয়ে সরকারের কাজকর্ম চালানো এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার অনুপ্রেরণা ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণ এবং বাংলার আপামর জনগণের স্বাধীনতার চেতনা যেটি বঙ্গবন্ধু বপন করেছিলেন।
সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি-পদ্ধতি অনুসরণ করে যেভাবে রাষ্ট্রের শাসনকাজ পরিচালিত হয়ে থাকে তা থেকে যুদ্ধকালীন অস্বাভাবিক অবস্থায় দুটো বিষয়ে ব্যত্যয় করা হলো। এক. অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রতিটি মন্ত্রিসভা-বৈঠকে উপস্থিত থেকে সভাপতিত্ব করতেন। দুই. যেহেতু অধিকাংশ বৈঠকে প্রতিরক্ষা এবং যুদ্ধ পরিচালনা বিষয়সমূহ মুখ্য আলোচ্য বিষয় থাকত, তাই কর্নেল ওসমানী প্রায় প্রত্যেক বৈঠকেই যোগদান করতেন।
মূলত প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরেই সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হতো। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ, শিক্ষা, স্থানীয় প্রশাসন, শ্রম, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিকল্পনা। খন্দকার মোশতাক আহমেদকে দেওয়া হয়েছিল পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদীয় বিষয়। ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর ওপর দায়িত্ব ছিল অর্থ, জাতীয় রাজস্ব, বাণিজ্য ও শিল্প, পরিবহন। এএইচএম কামারুজ্জামান ছিলেন স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অন্য তিন মন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতি এরাই ছিলেন সরকার-পরিচালনায়। নীতি-নির্ধারণের সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল তাদের। প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্দেশনায় আমরা, অর্থাৎ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিববৃন্দ সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতাম। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রধান সেনাপতি মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকা- পরিচালনা করতেন সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গঠন
মন্ত্রণালয় ও দফতরসমূহ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নি¤œলিখিত মন্ত্রণালয়/বিভাগে সংগঠিত হয়েছিল।
১. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ২. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩. অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৪. মন্ত্রিসভা সচিবালয় ৫. সাধারণ প্রশাসন বিভাগ ৬. স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৭. তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় ৮. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৯. ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় ১০. সংসদ বিষয়ক বিভাগ ১১. কৃষি বিভাগ ১২. প্রকৌশল বিভাগ।
মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরও কয়েকটি সংস্থা ছিল, যারা সরাসরি মন্ত্রিসভার কর্তৃত্বাধীনে কাজ করত, যেমনÑ
১. পরিকল্পনা কমিশন ২. শিল্প ও বাণিজ্য বোর্ড ৩. নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির ৪. ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি ৫. শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড।
এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক হিসেবে নি¤œলিখিত বেসরকারি সংস্থা, দল, গোষ্ঠী, সমিতি, বাহিনী ইত্যাদি ভূমিকা পালন করেছে। নি¤œবর্ণিত সংগঠনগুলোর নাম থেকেই বোঝা যাবে তাদের ভূমিকা কী প্রকৃতির ছিল।
বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন
যুব নিয়ন্ত্রণ পরিষদ ও প্রশিক্ষণ বোর্ড, বাংলাদেশ হাসপাতাল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, জয় বাংলা পত্রিকা, বাঙলাদেশ বুলেটিন, বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী সংগঠন, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল, বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি, বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ, নিউইয়র্ক বাংলাদেশ লীগ, বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি; লন্ডন, লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া।
আঞ্চলিক প্রশাসন
আঞ্চলিক প্রশাসন স্থাপন ও পরিচালনা ছিল একটি সম্পূর্ণ নতুন চিন্তাধারার ফসল। পূর্ণাঙ্গ একটি সরকার প্রতিষ্ঠা, যার অধীনে আঞ্চলিক প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগীয় কার্যক্রম চালু থাকবে, যার ভিত্তি হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মূল লক্ষ্য হবে যুদ্ধে নিয়োজিত সেক্টর কমান্ড এবং মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য এবং সহযোগিতাÑ এই ছিল আমাদের ভাবনা। এই লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ১১টি আঞ্চলিক পরিষদ (Zonal Council) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই পরিষদগুলোতে নির্দিষ্ট এলাকার নির্বাচিত এমএনএ/এমপিএ-রা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সদস্য ছিলেন। তাদের মধ্য থেকে আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এই কাউন্সিলকে প্রশাসনিক সাহায্য দেওয়ার জন্য একজন করে আঞ্চলিক প্রশানসিক কর্মকর্তা (Zonal Administrative Officer) নিয়োগ করা হয়। সেই সাথে নিযুক্ত হন বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর শাসনভার গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত এই প্রশাসনিক কাঠামো কার্যকর ছিল।
আঞ্চলিক পরিষদ এবং দফতরগুলো থাকার ফলে দেশ সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হওয়ার আগেই আমাদের নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। সে কারণে ১৬ ডিসেম্বরেই (কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার আগেই) আমাদের নিয়োজিত সকল জেলা প্রশাসক/পুলিশ সুপার ও অন্যান্য কর্মকর্তা স্ব-স্ব পদে যোগদান করে কালবিলম্ব না করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত করেন।
উপদেষ্টা পরিষদ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি বিশেষ প্রচেষ্টা ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে ধর্ম-দল-মত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের সমর্থনে যুদ্ধ পরিচালনা করা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সব কয়টি আসনে জয়লাভ করলেও, স্বাধীনতাযুদ্ধে ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফফর), কমিউনিস্ট পার্টি এবং কংগ্রেস ইত্যাদি দলও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। এই কারণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তাদের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের আন্তরিক চেষ্টায় সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা সম্ভব হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, প্রফেসর মোজাফফর আহমদ, মণি সিং, শ্রী মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ ছিলেন এই উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচার
পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ
মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার প্রায় সব সভা এবং বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গ উঠত। পাকিস্তানি দস্যুদের কবল থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ সরকার। সরকারের মন্ত্রিসভার দুটি সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে তুলে ধরলেই এ কথা বুঝা সহজ হবে যে, বঙ্গবন্ধুর জন্য সরকারও কত উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৭১ সালের ২ মে গৃহীত একটি সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে চাপ সৃষ্টির ওপর জোর দেওয়া হয়। যখন সরকার বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারে যে, পাকিস্তানি কারাগারে বঙ্গবন্ধু বন্দী আছেন এবং তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার প্রহসনমূলক বিচার করার আয়োজন করা হয়েছে তখন উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সভায় নি¤œলিখিত সিদ্ধান্ত নেনÑ
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সকল পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হলো। আবার ৫ মে সংবাদ-মাধ্যম, গোয়েন্দা মাধ্যম ও কূটনৈতিক মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে মন্ত্রিসভার সভায় নি¤œলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়Ñ
মন্ত্রিসভা এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। পাকিস্তান সরকারের দাবি অনুযায়ী মহান নেতার গ্রেফতারের খবর সত্যি হলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ওপরের সিদ্ধান্তে বঙ্গবন্ধুকে ‘মহান নেতা’ হিসেবে উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে সরকারের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। সরকারের দায়িত্বশীল পদে কাজ করাকালে আমার অনুভূতিতে এমন অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটতে আর কখনও দেখিনি। বঙ্গবন্ধুর বিচার-প্রহসন বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নিবিড় কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়াও প্রচার মাধ্যমেরও সহায়তা নেওয়া হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন সরকার, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, ব্রিটেন ইত্যাদি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এবং রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এ কথা তো সবারই জানা যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদগর্নি ব্যক্তিগত পর্যায়ে পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এসবই বাংলাদেশ সরকারের কর্মতৎপরতার ফল ছিল।
বৈদেশিক নীতি ও স্বীকৃতি আদায়
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ কেন? এটা বহির্বিশ্বে প্রচার করা এবং এর প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি এবং সম্ভব হলে স্বীকৃতি আদায় করাও ছিল আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রতি, বাঙালির প্রতি যে সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা আমাদের সরকারের বিভিন্নমুখী প্রচেষ্টার ফলেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার যে সে দেশের একমাত্র বৈধ সরকার, তা অধিকাংশ দেশ ও সরকারের কাছে স্পষ্ট হতে বেশি সময় লাগেনি। তার কারণ আমাদের নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি এবং পাকিস্তানিদের গণহত্যা। পাকিস্তান ও তার দোসরদের ব্যাপক অপপ্রচার সত্ত্বেও আমাদের সরকারের প্রতি সহানুভূতি ও নৈতিক সমর্থন বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছিল, তার প্রধানতম কারণ ছিল আমাদের সরকারের স্বাধীন ও সার্বভৌম নীতিসমূহ এবং কার্যকলাপ।
সেনাবাহিনী পুনর্গঠন, শক্তি বৃদ্ধি, সশস্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠা
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যে কয়টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়ন ছিল তাদের পাকিস্তানিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন ও শক্তিহীন করে ফেলার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। ওই কঠিন সময়ে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে আমাদের বাঙালি অধিনায়করা যে যেখানে পেরেছেন সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন অধীনস্থ সেনাদের নিয়ে। অন্যান্য পাকিস্তানি ইউনিটে যেসব বাঙালি অফিসার ও সেনা ছিলেন তারাও হাতিয়ার তুলে নিয়ে সুবিধামতো স্থানে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। এ ছাড়াও ছিলেন মুক্তিবাহিনীতে ইপিআর, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্য। বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীও পিছিয়ে ছিল না। এই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাহিনীকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন কর্নেল এমএজি ওসমানী। তাকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সাহায্য করেন গ্রুপ-ক্যাপ্টেন একে খন্দকার। কর্নেল রবও ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ছিলেন, কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি তেমন ভূমিকা রাখতে পারেন নি। মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সিনিয়র অফিসার, পরবর্তীতে যারা সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন যোগ্যতা এবং বীরত্বের সাথে, তারা প্রথমে বিচ্ছিন্ন থাকলেও অতি সত্বর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্থ সেনা-কমান্ডের নেতৃত্বে চমৎকার শৃঙ্খলার সাথে চেইন অব কমান্ড স্থাপন করেন। পারস্পরিক সমঝোতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন আমাদের কমান্ডারবৃন্দ। মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন রফিক, মেজর মঞ্জুর, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর সিআর দত্ত, মেজর নূরুজ্জামান (অব.), মেজর তাহের, উইং কমান্ডার বশর, মেজর জলিল, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহÑ এদের সবার নামই করতে হয় একসাথে। এই সেক্টর কমান্ডারদের সাথে অনেক সাব-সেক্টর কমান্ডারও তাদের বীরত্ব, সাহস আর দক্ষতার সাক্ষর রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধে। এদের মধ্যে তৎকালীন ক্যাপ্টেন শাফায়ত জামিল, মেজর হায়দার, ক্যাপ্টেন মতিন, মেজর মইনুল, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, মেজর শামসুদ্দিন, ক্যাপ্টেন ভূইঞা, লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান, স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন, ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ, মেজর জাফর ইমাম, ক্যাপ্টেন মাহফুজ, ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম, ক্যাপ্টেন আবদুস সালেক চৌধুরী, মেজর আমিনুল হক, ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন এমএ গাফফার, মেজর জিয়াউদ্দীন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এদের পাশাপাশি নৌ-কমান্ডে অফিসারদের কথাও অবশ্যই মনে রাখতে হবে। আরও অনেক অনেক সেনানায়ক ছিলেন যাদের স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধে স্মরণীয়। এসব বীরের স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো সকল সেনানায়কই কেন্দ্রীয় কমান্ডের নির্দেশ এবং পরিকল্পনামতো যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এবং নীতি নির্ধারণ করতেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এদের মূল প্রেরণা ছিলেন বঙ্গবন্ধু : তার নামে, তাকে হৃদয়ে ধারণ করেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। কেউই কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশ/নির্দেশ অমান্য করেন নি। শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে যে দু-একজনের শাস্তি হয়েছে তা তারা মাথা পেতে নিয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকারের আরেকটি সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ ছিল সামরিক বাহিনী গঠনের জন্য নিজস্ব ‘অফিসার কোর (corps) তৈরি করা। এই লক্ষে মুক্তিবাহিনী থেকে বাছাই করে প্রথম অফিসার ক্যাডেট নিয়োগ করা হয়। মুর্তী নামক একটি জায়গায় অস্থায়ী মিলিটারি কলেজ স্থাপন করা হয়। নভেম্বর মাসের কোনো একসময় প্রথম ব্যাচের পাসিং আউট প্যারেড (Passing out parade) অনুষ্ঠিত হয়। সালাম গ্রহণ করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সাথে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমিও সেখানে উপস্থিত থেকে অফিসার ক্যাডেটদের সনদপত্রে (Certificae-এ) দস্তখত করি। ওই ব্যাচ একাডেমি থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে। এদের মধ্যে কোনো কোনো ক্যাডেট শাহাদাতবরণ করেন। আজও ওই ব্যাচের কোনো কোনো অফিসার (কেউ জেনারেল, কেউ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বা কর্নেল) আমার কাছে এসে পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘আমি ১৯৭১ সালের কোর্স করেছি। আপনি আমার সনদে দস্তখত করেছিলেন।’
২১ নভেম্বর ১৯৭১ ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিষ্ঠা। আজও আমরা গর্বের সাথে, আনন্দের সাথে এবং সাড়ম্বরে এই দিনটি উৎসবের মতো পালন করি। কারও কি একবারও মনে হয় ২১ নভেম্বর, ১৯৭১ সশস্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সামরিক বাহিনী সদর দফতর (Head Quarter) দ্বারা; এককভাবে কোনো ব্যক্তি বা কমান্ডারের কৃতিত্ব দাবি করেন না। সমষ্টিগতভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ (প্রতিরক্ষা মন্ত্রীও), প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী, ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার এবং প্রতিরক্ষা সচিব এমএ সামাদের নাম উল্লেখ করতে হয় শ্রদ্ধাভরে।
পরাধীন পাকিস্তানি আমলের সুদীর্ঘ ২৩ বছরের লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠা বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় এই মানচিত্রের জনগণ তথা আমাদের পূর্ব পুরুষরা জীবন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যে আশা-আকাক্সক্ষাকে বিকশিত করেছিল; ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত, মা বোনের ইজ্জত ও দেশবাসীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে সেই আশা-আকাক্সক্ষাই স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে বাস্তবে রূপ নেয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার হচ্ছে সেই আশা-আকাক্সক্ষারই প্রত্যক্ষ ফসল, মহত্তম রূপ। যত দিন যাবে, বাংলাদেশ যতই বিশ্বের বুকে মাথা তুলে গৌরব নিয়ে দাঁড়াবে, ততই মহিমান্বিত হতে থাকবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত প্রথম বাংলাদেশ সরকার। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার বর্তমান দিনগুলোতে বাংলাদেশকে সেই গৌরবময় স্থানে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামই চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিক্রিয়া যত জিঘাংসা ও বীভৎস্য রূপ নিয়েই ছোবল দিক না কেন, জাতির শুভ প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ কখনও ব্যর্থ হবে না।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক।