গাইবান্ধার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেপথ্য নায়ক আজিজুর রহমান
আজ ৩০ অক্টোবর, ২০০০ সালের এই দিনে আমাদের আব্বা গাইবান্ধার নিজ বাস ভবনে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর কাছে ছিল সুদুর আমেরিকা থেকে দেখতে আসা বোন রীতা আনাম ও ছোট ভাই ওয়াজিউর রহমান র্যা ফেল। একজন সহজ সরল ও সৎ চরিত্রের মানুষ আমাদের পিতা আজিজুর রহমান ১৯০৫ সালের গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার ১ নম্বর পদুম শহর ইউনিয়নে জন্ম গ্রহণ করেন। আমার দাদা আব্দুল কুদ্দুস মিয়ার সাত পুত্র ও পাঁচ কন্যার মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। দাদা আব্দুল কুদ্দুস মিয়া তদানীন্তন গাইবান্ধা মহাকুমার প্রভাবশালী ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি আজীবন পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন।
আব্বা প্রাথমিক শিক্ষা নিজ ইউনিয়নে গ্রহণ করেন। গাইবান্ধা মহাকুমা শহরে তখন তাদের কোন বাড়ীঘর ছিল না। ছেলেদের লেখাপড়া করার জন্য দাদা গাইবান্ধা শহরের মধ্য পাড়ায় জায়গা কিনে বাসা বানিয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ করে দেন। আব্বা গাইবান্ধা ইসলামিয়া হাই স্কুলে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রংপুর কারমাইকেল কলেজে আইএ ও বিএ পাশ করেন। উনি কারমাইকেল কলেজে সিএম হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতেন। সেসময় প্রবেশিকা ও বিএ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ ছিল। কলেজ জীবনে তার কয়েকজন বন্ধু ছিলেন তাদের মধ্যে পরবর্তীতে অনেকের সাথে আমাদের পরিবারের আত্মীয়তা হয়। যেমন বিখ্যাত সাংবাদিক মরহুম কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস আমাদের মেজ মামা। রংপুরের গঙ্গাচড়া থানার গজঘন্টা ইউনিয়নের আজীবন চেয়ারম্যান মরহুম এমদাদ আলী বিএ আমাদের ফুপা । গাইবান্ধা তদানিন্তন বেসরকারি গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মরহুম আব্দুল আজিজও আমাদের ফুপা ছিলেন। অপর বন্ধু কুড়িগ্রামের বিখ্যাত উকিল মরহুম ফখরুদ্দিন আহম্মেদ আমাদের আত্মীয় ছিলেন।
আমার আব্বা রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইন বিষয়ে পড়ার জন্য কলিকাতায় যান। কলিকাতায় সেন্ট্রাল এভিন্যুতে এভিন্যু ক্লাব হোস্টেলে থেকে আইন পড়তেন। কয়েক বছর আগে কলিকাতায় গিয়ে খোঁজ করে দেখি সেই হোস্টেল এখন এভিন্যু হোটেল নামে একটি বড় হোটেল হয়েছে। তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন কিন্তু চুড়ান্ত পরীক্ষা দেননি।
তিনি বৃটিশ সরকারের আমলে আপার ডিভিশন চাকুরি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও আমার দাদার নির্দেশে চাকুরী করেন নাই। তিনি কলিকাতায় রিপন কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ঐ স্কুলের হোস্টেল সুপারেনটেন্টডেন্ট হিসাবে ঐ হোস্টেলে থাকতেন। ইতিমধ্যে দাদা মৃত্যুবরণ করেন। দাদী ও বড় চাচার নির্দেশে আমার আব্বা বাড়িতে ফিরে আসেন।
১৯৪২ সালে তিনি গাইবান্ধা ইসলামিয়া হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন এবং গাইবান্ধা শহরে বাসা নির্মাণ শুরু করেন। তিনি তদানীন্তন মুসলিম লীগের কোষাধ্যক্ষ ও মুসলিম লীগের প্রাদেশিক কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। আব্বা বঙ্গীয় মুসলিম লীগের প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাসেম গ্রুপের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৬ সালে রংপুর ডিষ্ট্রিক বোর্ডের সাঘাটা এলাকা হতে সরাসরি ভোটে মেম্বার নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান জন্ম লাভের পর থেকেই তিনি মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করে একজন নির্দলীয় শিক্ষক থাকার পথ বেছে নেন। এ ব্যাপারে আমি অনেক পরে আব্বাকে পদত্যাগের কারন জিঙ্গাসা করেছিলাম। উত্তরে তিনি বলেন যে এই অবস্থায় একজন শিক্ষক হিসাবে আমি কোন দলের থেকে রাজনীতির প্রভাব বিস্তার করতে চাই না।
তিনি ১৯৪৬ সালে গাইবান্ধা ইসলামিয়া হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং ১৯৪৮ সালে একই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তিনি একটানা ২৬ বছর ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি বৃহত্তর রংপুর জেলার শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। আমরা গর্বিত এই বিদ্যালয়ের তাঁর প্রিয় তিন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্বে নিয়োজিত (মরহুম মতিউর রহমান, মরহুম লুৎফর রহমান ও ওয়ালিউর রহমান) ছিলেন। আমরা আরও গর্বিত তাঁর প্রিয় চার ছাত্র (মরহুম মতিউর রহমান, মরহুম লুৎফর রহমান, ওয়ালিউর রহমান ও জাহাঙ্গীর কবীর) ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর প্রিয়তম ছাত্র মরহুম মতিউর রহমান বঙ্গবন্ধু সরকারের পুর্ন মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর খুব প্রিয় ছাত্র এস, সেন ভারতের আই এ এস কর্মচারী হিসাবে ভারত সরকারের সচিব ছিলেন।
তিনি গাইবান্ধা ইসলামিয়া হাই স্কুলকে খুব ভালোবাসতেন, স্কুল ছুটির দিনেও স্কুলে যেয়ে বসে থাকতেন। স্কুলের চারিদিকে অনেক গাছ লাগিয়েছিলেন। যেমন মেহগনি, রেইনট্রি। সেই গুলি এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। তাঁর প্রচেষ্টায় মহকুমা প্রশসকের সহায়তায় স্টেট রিলিফের টাকায় পাকিস্তান আমলে দোতলা ভবন নির্মিত হয়।
১৯৬১ সালে তাঁর তৃতীয় পুত্র রুজের (মরহুম ওয়াদুদুর রহমান ) মৃত্যুতে তিনি মানসিক ও দৈহিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। তিনি ছিলেন সুঠাম দেহের অথিকারী। ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন আত্মনির্ভশীল। বাসায় কাজের লোক থাকা সত্বেও তিনি নিজের ব্যক্তিগত কাজ নিজেই করতে পছন্দ করতেন। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি ধুতি, সাদা ফুল শার্ট ও পাম্প সু পরতেন। পরে উনি পায়জামা, পাঞ্জাবিও পাম্প সু পরতেন। বাসায় পরতেন বৈলাআলা খড়ম। তিনি খুব সাদামাটা খাবার পছন্দ করতেন। সারাজীবন তিনি রাতে দুধ রুটি খেতেন। তিনি তাঁর নিজের সন্তানদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নিরহংকারী, অসাম্প্রদায়িক ও অধুমপায়ী। তিনি শুধু পান খেতেন।
ছাত্র জীবনে আব্বা আমাকে গল্প বলছেলিনে, স্কুলজীবনে তিনি একদিন দোকান থেকে পানের খিলি কিনছিলেন সেসময় উচুঁ ক্লাসের ছাত্র তাকে বল্লেন এই বয়সে দোকান থেকে পানের খিলি কিনে খেতে নেই। পরর্বতীকালে সেই ছাত্র ছিলেন তদানীন্তন পূবর্বাংলার মূখ্য মন্ত্রী আবু হোসনে সরকার । এই ঘটনার পর তিনি আর দোকান থেকে পানের খিলি কিনে খাননি।
তিনি আদর্শবাদী ও সৎ রাজনীতিবিদের প্রতিশ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাদের কথা আব্বা আমাদের সাথে আলোচনা করতেন। বিশেষ করে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবু হোসেন সরকার, অভিবক্ত বাংলার মন্ত্রী আহম্মদ হোসেন, কমিউনিষ্ট পার্টির মনি সিংহ, রংপুরের কমিউনিষ্ট নেতা মনিকৃষ্ণ সেন। বৃহত্তর রংপুর জেলা আওয়ামী লীগ ও পরবর্তীতে ন্যাপ সভাপতি নিলফামারীর দবীর উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। তিনি কোন রাজনীতি দলের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল তার অগাধ আস্থা ও ভালবাসা। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি।
১৯৭০ সালে দেশে সামরিক আইন চলছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গাইবান্ধায় একটি জনসভা করবেন বলে দিন তারিখ ঠিক করে জানিয়েছেন। আমরা গাইবান্ধা মহকুমার আওয়ামী লীগের নেতারা জনসভা করার জন্য শহরে কোন মাঠ পাচ্ছিলাম না।স্টেডিয়াম, এসডিও মাঠ , সরকারী হাই স্কুলের মাঠের জন্য চেষ্টা করেও কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়া যায়নি। আব্বার ছাত্র মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি লুতফর রহমান, আরেক ছাত্র শহর আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মোহাম্মদ খালেদ ও আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ওয়ালিউর রহমান, তাঁর সাথে দেখা করে সবকিছু খুলে বললাম। উনি শুনে বল্লেন যে এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদধীকার বলে স্কুল কমিটির সেক্রেটারী হিসাবে এই মাঠে জনসভা করার অনুমতি দিব। তোমরা আবেদন পত্র দাও। এই মাঠে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করতে আসলেন। জনগণের চাপে স্কুলের র্পূবমুখী লম্বা ঘরটি ভেঙ্গে পড়ে। জনসভাটি সফলতা লাভ করে। আব্বা অপর বারান্দায় দাড়িয়ে বক্তৃতা শুনছিলেন। লুৎফর রহমান সাহেব বঙ্গবন্ধুকে সব খুলে বলায় সভা শেষে বঙ্গবন্ধু আব্বার সঙ্গে দেখা করে দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং বললেন যদি সুযোগ হয় আমরা এখানে একটি ভাল ঘর নির্মাণ করে দেবো। স্বাধীনতার পরে ঐখানে সরকার নতুন করে পাকা দালান নির্মাণ করে দিয়েছেন।
এই স্কুলের বেশ কয়েকজন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নবীজল এই স্কুলে আব্বার ছাত্র। তিনি ১৯৭৪ সালে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পরে তিনি আমাদের গ্রামে জমিজমার দেখাশুনা করতেন।
১৯৯৭ সালের শেষ দিকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরবর্তীকে শয্যাশায়ী হন। আম্মা, আমরা চার ভাই ও তিন বোনসহ বন্ধু আত্মীয় স্বজন রেখে ২০০০ সালের ৩০ শে অক্টোবর তিনি ইন্তেকাল করেন। গাইবান্ধার পৌর কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর আত্মার মাগফেরাতের জন্য আপনাদের সকলের কাছে দোয়া চাইছি।
লেখক: ওয়ালিউর রহমান, সত্তরের গণপরিষদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন; বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রাক্তন সংসদ সদস্য।