‘গ্রামীণফোনের ৩০ শতাংশ জনগণকে দিয়েছিলাম, সেটা নিজে নিয়ে নেন’
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, গরিবের হাড়-মাংস ও রক্ত ঝরানো টাকা দিয়ে যিনি বড়লোকিপনা করেন তার আবার দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকবে কোথা থেকে? দেশপ্রেম থাকবে কীভাবে? গরিব-দুঃখী মানুষের কাছ থেকে সুদ নিয়ে তার এখন অনেক টাকা। কিন্তু সরকারকে কোনো ট্যাক্স দেন না। ওই ব্যক্তির ফিক্সড ডিপোজিডে থাকা বিপুল অর্থ কীভাবে এলো তারও কোনো হিসাব উনি দিতে পারেন নি। আমি আশা করি, অর্থমন্ত্রী বিষয়টি দেখবেন এবং ব্যবস্থা নেবেন।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে গত ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত ৩০ মিনিটের প্রশ্নোত্তর পর্বে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য একেএম মাঈদুল ইসলামের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এমন কিছু লোক আছে তারা হাজার পাপ করুক, তাদের দোষ যেন দোষই না। এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য। অথচ আমাদের পান থেকে চুন খসলে কত কথা, কত লেখা হয়। জানি না, তাদের বাচনভঙ্গি বা কার্যক্রমের মধ্যে কী ম্যাজিক আছে? কিন্তু উনি সেই কথামালা দিয়ে অর্থ-সম্পদ নিজের করে একটা অবস্থান করে নিয়েছেন।
ওয়ান-ইলেভেনের সময় একটি জাতীয় পত্রিকার সম্পাদককে সাথে নিয়ে নতুন দল গঠনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুদখোরের ডাকে দেশের জনগণ সাড়া দেয়নি। জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, ওনাদের এখন অনেক টাকা। এই টাকা আমার গরিব-দুঃখী মানুষের সপ্তাহে সপ্তাহে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত টাকা। তারা (ঋণ গ্রহীতা) ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে টাকা কামাই করেছে, সেখান থেকে বিশাল অঙ্কের সুদ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই মানুষগুলোর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সরকার থেকে তাকে (ড. ইউনূস) গ্রামীণব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরানো হয়নি। উনি নিজেই আদালতে মামলা করে হেরে গিয়ে এমডি পদ খুইয়েছেন। আর মামলায় হেরে যাওয়ার পর তার যত ক্ষোভ যেন আমার ওপর। লবিস্টের মাধ্যমে বিদেশের অনেকের মাধ্যমে আমাদের বিরুদ্ধে অনেক কিছু করলেন। এমনকি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়েও আমাকের ফোন করিয়েছিলেন। তাকে বলেছি, উনি আইন ভঙ্গ করে পদে ছিলেন এবং নিজে মামলা করে পদ খুইয়েছেন। এখানে সরকার কিছু করেনি। ড. ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, উনি কী আমাকে এক কাপ চা খাইয়ে গ্রামীণফোনের লাইসেন্স নিয়েছিলেন, নাকি আমি নিজে তাকে চা খাইয়ে লাইসেন্স দিয়েছিলামÑ তা দেশবাসীকে বলুন।
গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ড. ইউনূস ‘ধোঁকাবাজি ও চিটিংবাজি’ করেছেন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের লাইসেন্স নেওয়ার সময় উনি বলেছিলেন, লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ গ্রামীণ ব্যাংকে যাবে, সেই টাকা দিয়ে জনগণের কল্যাণ করা হবে। আমরা তার কথায় বিশ্বাস করে লাইসেন্স দিলাম। কিন্তু পরে তিনি গ্রামীণফোনকে নিজের সম্পত্তি বানালেন। ৩০ শতাংশ শেয়ার নিজের নামে রেখে বাকি শেয়ার উনি বেচে দিয়েছেন। তিনি বলেন, গ্রামীণফোনের লাইসেন্স তার (ড. ইউনূস) পাওয়ার কথা ছিল না। টেন্ডারে তৃতীয় স্থানে ছিলেন। তারপরও আমরা দিয়েছিলাম লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ জনগণ পাবেন। সেটি তো দেনই নি, উল্টো এই প্রতিষ্ঠানকে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে নিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ তার ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা, অথচ একটি টাকা উনি সুদ দেননি। গ্রামীণ ব্যাংক সুদমুক্ত ছিল এটা ঠিক; কিন্তু এই ব্যাংকের নাম ব্যবহার করে উনি যে আরও প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো তো আর সুদমুক্ত না। সেই সুদ কেন সরকার পাবে না? সেসব প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স তারা কেন দেবে না? সেই প্রতিবেদনও আছে এনবিআরের কাছে। আর ফিক্সড ডিপোজিটে থাকা এত টাকা কোথা থেকে এসেছে সে হিসাবও তো দিতে পারেন নি। এখানে অর্থমন্ত্রী আছেন, উনিই দেখবেন এবং ব্যবস্থা নেবেন। আমি বলতে গেলেই তো আমার বিরুদ্ধে শুরু হবে নানা কথা।
দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, গ্রামীণব্যাংকের আইনেই রয়েছে ৬০ বছরের বেশি কেউ এমডি পদে থাকতে পারবে না। উনি (ড. ইউনূস) ৭০ বছর বয়সেও এমডি পদে বহাল ছিলেন। আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও আমার উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী তার কাছে গিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যেহেতু বয়সের কারণে এমডি পদে থাকতে পারেন না, তাই ওই পদ ছেড়ে দিন; আমরা আপনাকে ওই ব্যাংকের ‘অ্যাডভাইজার ইমেরিটাস’ করব। উনি না মেনে ড. কামাল হোসেনের পরামর্শে আদালতে গিয়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করলেন। মামলায় হেরে গিয়ে এমডি পদ হারালেন। আর সেই ক্ষোভ পড়ল আমাদের ওপর, পদ্মা সেতুর ওপর।
তিনি বলেন, পদ হারানোর পর উনি দেশে-বিদেশে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করলেন। একটি স্বনামধন্য পত্রিকার সম্পাদককে নিয়ে উনি (ড. ইউনূস) বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করলেন। হিলারি ক্লিনটনের সাথে লবি করলেন। এরপর কোনো অর্থ ছাড় না করেই পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র এনে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দিল। এরপর নানাভাবে আমাদের হেনস্থা করার চেষ্টা হলো। মার্কিন গোয়েন্দা দিয়ে আমাকেসহ আমার ছেলে-মেয়ে, বোন, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের বিষয়ে নানাভাবে তদন্ত করা হলো; এতটুকু দুর্বলতা খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। এত কিছু করেও তারা কোনো প্রমাণ করতে পারেনি।
সংসদ নেতা বলেন, আমি রাজনীতি করি জনগণের কল্যাণের স্বার্থে, ব্যক্তিস্বার্থে নয়। আর জনগণের টাকা লুট করে নিজেদের ভাগ্য গড়ব এ ধরনের আকাক্সক্ষা বা মানসিকতা আমাদের নেই। পারলে জনগণকে বিলিয়ে দিয়েছি, সেটাই আমরা শিখেছি। আর আমাদের মনের জোর ও সততা ছিল বলেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে বলেছিলাম, বিশ্বব্যাংকের টাকায় আর পদ্মা সেতু করব না; যারা কান কথা শুনে একটা উন্নয়নের প্রকল্পের টাকা বন্ধ করে দেয়। পদ্মা সেতু বন্ধ হওয়ায় তারা তো মহাখুশি। কিন্তু আমরা সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। এখন আমরা নিজের অর্থেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি।