চক্রান্ত এবং জঙ্গিবাদের নেত্রী খালেদা
স্বদেশ রায়: আমাদের কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিশেষ করে চৈনিক বামপন্থি এবং অতি ডানপন্থি বিশ্লেষকরা একটি বিষয় প্রায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন যে, বঙ্গবন্ধু ও জিয়ার মৃত্যুর ফলে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এসেছেন। একি সচেতনভাবে না রাজনৈতিক বিশ্লেষণ জ্ঞানের অভাবে এভাবে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে এক কাতারে আনার চেষ্টা হয়েছেÑ তা একটি বড় প্রশ্ন। সহজ চোখে তাকালেই বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত না হলেও শেখ হাসিনা রাজনীতিতে আসতেন। যেমনটি জওহর লাল নেহরুর দ্বিতীয় মেয়াদ থেকে রাজনীতিতে এসেছিলেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। নিশ্চয়ই এই সহজ সত্যটুকু সকলের বোঝা উচিত, বাংলাদেশের সব থেকে বড় মহিলা কলেজটির নির্বাচিত ভিপি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারেন না। তিনি রাজনীতিতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিজ যোগ্যতায় চলে আসতেন। নিজ যোগ্যতায় যিনি আইয়ুব শাহীর আমলে বকশিবাজারের সরকারি মহিলা কলেজের ভিপি হতে পারেন, তিনি নিজ যোগ্যতায় রাজনীতিতে স্থান করে নিতেন। আর স্থান করে নিতেন এমন একটি পরিবারের সন্তান হিসেবে যিনি তার পিতার রাজনীতির ভিতর দিয়ে একটি জাতির জন্ম দেখেছেন, নিজেও সেই সংগ্রামের অংশ। অন্যদিকে নিজ বাড়িতে ছোটবেলা থেকে সেসব রাজনীতিকদের দেখেছেন যারা নিজ নিজ অবস্থানে মহীরুহ ছিলেন। তিনি কাছের থেকে দেখেছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানীকে। এই বিশাল ব্যক্তিত্বের রাজনীতিকদের ছাড়াও তিনি অত্যন্ত কাছে থেকে দেখেছেন, আবুল মুনসুর আহম্মদ, আতাউর রহমান খান প্রমুখকে। এত বড় রাজনৈতিক পরিম-লে বেড়ে ওঠা এবং দেশের অন্যতম বড় কলেজের ভিপি ভবিষ্যতে রাজনীতিতে স্বাভাবিকভাবে নিজের জায়গা করে নিতে পারবেন না, এমনটি ভাবা মুর্খামী ছাড়া আর কি হতে পারে।
তাই এক শ্রেণির জ্ঞান পাপী না হয় রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞরা তথাকথিত বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে এমনটি দাঁড় করিয়েছেন যে এখন ইকোনমিস্ট পত্রিকার সাংবাদিকও অজ্ঞের মতো লেখেন দুই বেগম এবং সেখানে বলা হয় পিতার ও স্বামীর মৃত্যুর কারণে তাদের রাজনীতিতে আনা হয়। ইকোনমিস্ট পত্রিকার মতো পত্রিকার সাংবাদিকদের এ ধরনের মন্তব্য করার আগে একটু খোঁজখবর নেবেন এমনটিই সবাই আশা করে। তাদের অন্তত এটা জানা উচিত ছিল শেখ হাসিনাকে রাজনীতিতে আনা হয়নি, শেখ হাসিনা যেমন ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তেমনি নিজেই জাতীয় রাজনীতিতে এসেছেন। ১৯৭৫-এর পর আওয়ামী লীগ পুরুজ্জীবিত করা হলে নানাভাবে নানাজন প্রস্তাব করেন, শেখ হাসিনাকে অন্তত ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বর করা হোক। অন্যদিকে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে রাজনীতি শুরু করার পর জিয়াউর রহমান সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হলে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর লোকরা বেগম জিয়াকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে।
তাই নতুন প্রজম্মের কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার যে, শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আসা ও বেগম জিয়ার রাজনীতিতে আসার পথ পরিক্রমা এক নয়। শেখ হাসিনা রাজনীতিতে ছিলেন ছাত্রজীবন থেকে। বঙ্গবন্ধু নিহত হলে তিনি ব্রিটেন থেকে আন্দোলন শুরু করেন। তারপর ধীরে ধীরে তিনি আওয়ামী লীগের মূল নেতা হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। সেক্ষেত্রে বরং কিছু রাজনীতিক ও সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর লোকরা তার রাজনীতিতে আসার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আর স্বয়ং সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তো বাধা ছিলেনই। অন্যদিকে খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী এ কারণে যে, তারা বুঝতে পারে এরশাদ ক্ষমতা নিলেও রাজপথে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন শেখ হাসিনা শুরু করবেন। জিয়ার আমলের মালেক উকিল-রাজ্জাকের আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এক নয়। আর নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ, এরশাদ ক্ষমতা দখল করে ২২ মার্চ আর এরশাদের এই সামরিক শাসনের প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানান শেখ হাসিনা ২৬ মার্চ। ২৬ মার্চ জাতীয় স্মৃতিসৌধে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার সামনে তিনি অবিলম্বে সামরিক শাসকের পদত্যাগ দাবি করে তার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। যা ছিল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্যে প্রতিবাদ সভা।
শেখ হাসিনার এই কর্ম পদ্ধতি দেখে তৎকালীন সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী বুঝতে পারে, অবিলম্বে এরশাদের বিরুদ্ধে তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে তুলবেন শেখ হাসিনা। তারা এও বুঝতে পারে, মাঠে যদি প্রতিক্রিয়াশীল কোনো শক্তি না থাকে তা হলে গোটা মাঠ শেখ হাসিনা দখল করে নেবে। তাই মাঠে যাতে সামরিক সরকারের একটি অংশ থাকে এ জন্য তারা খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে এবং তাকে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে। শুধু যে, এরশাদ ও সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী খালেদা জিয়াকে পৃষ্ঠপোষকতা দেন তা নয়, ওই সময়ে খালেদা জিয়া যে একজন রাজনীতিক এবং তার জোট যে একটি সামরিক শাসকবিরোধী আন্দোলনের জোট এই বৈধতা দেবার জন্য প্রয়োজন ছিল শেখ হাসিনা ও খালেদ জিয়ার বৈঠক করানো। সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর এই নীল নকশা বাস্তবায়ন করার জন্য সেদিন প্রগতিশীল জোটের যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তাদের ভিতর অন্যতম ছিলেন, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহম্মেদ, সাংবাদিক ফয়েজ আহম্মেদ, রাজনীতিক সাইফ উদ্দিন আহমেদ মানিক, নির্মল সেন প্রমুখ। তারা সেদিন সে কাজে কামিয়াবও হন। যা ছিল বিরোধী রাজনীতিক হিসেবে খালেদা জিয়ার প্রথম বৈধতার সার্টিফিকেট। এসব ব্যক্তি সেদিন শেখ হাসিনাকে খালেদার সাথে বসতে বাধ্য করেছিলেন বটে, তবে তারা খালেদাকে ১৯৮৬-তে নির্বাচনে আনতে পারেন নি। খালেদাও সেদিন এরশাদের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর কথামতো নির্বাচন থেকে দূরে থাকার জন্য গাজীপুরে একটি ফ্যাক্টরিতে গিয়ে অজ্ঞাতবাসে থাকেন। অন্যদিকে এ দেশের তথাকথিত রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ঠিক একই কায়দায়, রাজনীতি বিশ্লেষণ করতে থাকেন। তারা খালেদা যে এরশাদের চক্রান্তকে সফল করেছে সে কথা না বলে উল্টো বলতে শুরু করে শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গেছেন। তাই তিনি আপসকামী আর যিনি এরশাদের কথামতো নির্বাচন থেকে দূরে থাকলেন তিনি হলেন আপসহীন।
বাংলাদেশের মিডিয়া ও বিশ্লেষকরা বেশিরভাগ বামপন্থি না হয় সামরিক শাসকপন্থি। স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি খুবই কম। তাই মিডিয়ার অন্তহীন প্রচারে খালেদা আপসহীন হয়ে ওঠে। কেউ দেখে না এরশাদের কাছ থেকে ভাতা নিয়ে, এরশাদের কথামতো রাজনীতি করছেন তিনি। এভাবেই রাজনীতিতে অজ্ঞ, রাজনৈতিক পরিবেশ যার সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং সত্যি অর্থে বঙ্গবন্ধু নিহত না হলে যিনি কোনোদিন রাজনীতিতে আসতে পারতেন না তিনিই হলেন খালেদা জিয়া। কারণ, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে জিয়াউর রহমান কোনোদিন ক্ষমতায় আসতে পারতেন না; বরং সেপ্টেম্বর মাসে হয় তাকে অবসরে পাঠানো হতো না হয় রাষ্ট্রদূত করে বিদেশে পাঠানো হতো। তাই জিয়ার পক্ষে কোনোদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়াও হতো না, আর কামড়াকামড়িতে মৃত্যুর ফলে এভাবে খালেদাও রাজনীতিতে আসতে পারতেন না।
যা হোক, ওই সব রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মুখে ছাই দিয়ে এখন বাস্তব সত্য হিসেবে সামনে এসেছে, শেখ হাসিনা। নিজ যোগ্যতায় আজ দক্ষিণ এশিয়ার সব থেকে বড় নেতা তিনি। অন্যদিকে খালেদা জঙ্গি নেত্রী। যে জঙ্গি নেত্রীর সাথে যোগাযোগ আছে আল-কায়দা, আইএস-সহ সকল আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর। এ ধরনের জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের নেতা হওয়ার পরও কেন খালেদা এখনও রাজনীতিতে আছে। কেন এখনও প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারছেন। খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারছেন তার প্রথম কারণ, শেখ হাসিনা তার পিতার রাজনীতি অনুসরণ করেন বলে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের যা যা শক্র সব কিছুই কিন্তু রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করছেন। রাজনৈতিকভাবেই নির্মূল করার কাজ করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনা জানেন, অস্ত্র দিয়ে, প্রশাসন দিয়ে জঙ্গিরা যাতে ক্ষতি করতে না পারে, মানুষ হত্যা না করতে পারে এটা প্রতিহত করা যায়। তবে সমাজ থেকে জঙ্গি নির্মূল করতে হবে রাজনৈতিকভাবে। শেখ হাসিনা তাই বাংলাদেশের মূল জঙ্গি নেত্রী খালেদাকে প্রশাসনের মাধ্যমে নয়, আইনের শাসন ও রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করছেন বলেই কিন্তু এখনও খালেদা প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারছেন। তা ছাড়া খালেদা প্রকাশ্যে রাজনীতি করার আরেকটি সুযোগ পাচ্ছেন পশ্চিমা একটি শক্তির কারণে। তারা সব সময়ই চায় মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ এই দেশটি যাতে অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো অশান্ত থাকে। তারা জানে, যদি তারা খালেদাকে রাজনৈতিকভাবে জীবিত না রাখে তা হলে এ দেশে কোনোক্রমেই অশান্তি সৃষ্টি করা যাবে না। শেখ হাসিনা এই দেশকে এশিয়ার অন্যতম শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। এ কারণে তারাও বাঁচিয়ে রাখছে নানাভাবে খালেদাকে। সর্বোপরি তাকে রাজনৈতিকভাবে বাঁচিয়ে রাখছে অঢেল অর্থ। আর এই অঢেল অর্থ দিচ্ছে পাকিস্তানি আইএসএস। সে দেশের কোর্টেও বলা হয়েছে পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী বাংলাদেশের নির্বাচনে খালেদা ও তার দলকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করে।
অবশ্য এ বিষয়টি নতুন কিছু নয়, জিয়াউর রহমান ছিলেন পাকিস্তানি আইএসআই’র একজন অফিসার। তার কাজই ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে গোলযোগ সৃষ্টি করার পক্ষে কাজ করে যাওয়া। ছাত্রনেতা এসএম ইউসুফের পাঠানো ছাত্রদের ধাওয়া ও কর্নেল অলির অস্ত্রের মুখে তিনি মুক্তিযুদ্ধে গেলেও তার সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবসময়ই যোগাযোগ ছিল। তারা বিভিন্ন সময়ে চিঠি লিখে জিয়াকে জানিয়েছে, তার স্ত্রী ও সন্তানরা নিয়মিত অর্থ সাহায্য অর্থাৎ জিয়ার বেতন-ভাতা সব পাচ্ছে। এসব খবর যুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের কাছে থাকা সত্ত্বেও বৃহত্তর স্বার্থে ওই সময় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। বরং তার পক্ষে সম্ভব হয় মুজিবনগর থেকেই চক্রান্ত শুরু করা। বঙ্গবন্ধুর বিশাল হৃদয়ের সুযোগ নিয়ে পরবর্তী চক্রান্তগুলো আরও দ্রুত করে তারা। বেগম জিয়া সেই চক্রান্তের রাজনীতির উত্তরাধিকার। তাই বাস্তবে বেগম জিয়া চক্রান্ত এবং জঙ্গিবাদের নেত্রী।