চলুন খুব কাছ থেকে একজন ঘাতককে দেখে আসি ২

মাহবুবুর রহমান জালাল ভাইর আরেক নাম মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত বিশ্বকোষ। ব্যক্তিগতভাবে বড়ভাই-ছোটভাই সম্পর্ক। খুবই স্নেহ করেন। খোজ রাখেন কখন কোথায় কি লিখছি। সেটা যদি গালিযুক্ত পোস্টও হয় ঠিকই মেইলবক্সে তার প্রতিক্রিয়া পেয়ে যাই। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আমার যা রেফারেন্স তার অর্ধেকেরও বেশি জালাল ভাইয়ের সৌজন্যে। এহেন কিছু নাই তার কাছে নেই। গতকাল যখন খালেক মজুমদারকে নিয়ে পোস্ট দিলাম চলুন খুব কাছ থেকে একজন ঘাতক দেখে আসি , জালাল ভাই সেটা পড়েছেন এবং কিছু জরুরী তথ্য পাঠিয়েছেন। আমার বাসায় এখন নেট নেই বলে রাতে ব্লগিং বন্ধ। নইলে খালেক মজুমদারের উপর একটা ভিডিও এভিডেন্সও ছিলো আমার কাছে যা আপলোড করা যেত। আপাতত অল্পতেই সারছি।

১৯৭২ সালের ১৮ জুলাই দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি রিপোর্ট তুলে দিচ্ছি :

শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যা মামলা : জামাত নেতা খালেকের ৭ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও দশ হাজার টাকা জরিমানা
গতকাল ১৭ জুলাই ঢাকার পঞ্চম স্পেশাল ট্রাইবুনাল পাক হানাদার বাহিনীর দোসর আলবদর বাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবি নিধন মামলায় প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যা মামলার রায় প্রদান করে বেআইনী জামাতে ইসলামীর বেতনভুক দফতর সম্পাদক এ.বি,এম আবদুল খালেককে দোষী সাব্যস্ত করে সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও দশ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছর সশ্রম কারাদন্ড দান করেন।

মাননীয় স্পেশাল জজ জনাব এফ. রহমান আসামীকে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১৬৪ নং ধারা ও দালাল আদেশের দ্বিতীয় তফসিলের কতিপয় অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করে দন্ড প্রদান করে বলেন যে আসামী হত্যা করার জন্য পাক বাহিনীর দালাল হিসেবে শহীদুল্লাহ কায়সারকে অপহরন করেছে। এই চাঞ্চল্যকর অপহরন ও হত্যা মামলায় অভিযোগ আনা হয় যে, আলবদর বাহিনীর সদ্স্য ও জামাতে ইসলামীর দফতর সম্পাদক হিসেবে আসামী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দখলদার পাক বাহিনীর অবৈধ দখল কায়েম রাখার জন্য তাদের সমর্থন ও সাহায্য করে। তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগে বলা হয় যে গত ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আসামী চার/পাঁচজন আলবদর সদস্য সাথে করে নিহত শহীদুল্লাহ কায়সারের বাড়ীর দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দোতলার একটি ঘর থেকে মরহুমকে ধরে নিয়ে যায় হত্যা করার উদ্দেশ্যে। আসামীদের হাতে স্টেনগান, রিভলবার ইত্যাদি অস্ত্র ছিল এবং বাড়ির মহিলারা চিৎকার করে বাধা দিলে তাদের ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দেওয়া হয়। তখন কারফিউ বলবৎ ছিল। দেশ শত্রুমুক্ত হবার পর বহু তল্লাশী করে মরহুমের লাশ পাওয়া যায়নি। ২০ ডিসেম্বর থানায় এজাহার দায়ের করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে গোয়েন্দা পুলিশ আসামীর বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করে।

মামলায় সরকার পক্ষে তেরোজন সাক্ষ্য প্রদান করেন। তন্মধ্যে মরহুমের স্ত্রী, বোন, ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী এরা আসামীকে সনাক্ত করে বলেন যে অপহরনকারী আলবদর বাহিনীর মধ্যে আসামীও ছিল। আসামী ছোট কাটারা মুক্তিবাহিনী কর্তৃক ধৃত হবার পর তার ছবি কাগজে ছাপা হয়েছিল। এজন্য সাক্ষীরা আসামীর ছবি দেখে সনাক্ত করেছে। আসামী পক্ষের কৌশলীর এই যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে বিজ্ঞ জজ বলেন যে সাক্ষীরা শিক্ষিত এবং তাদের অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই।

জজ সাহেব তার রায়ে আরো উল্লেখ করেন যে দখলদার আমলে আসামী রিভলবারের লাইসেন্সের জন্য যে দরখাস্তা করেছে তাতে সে নিজেই নিজেকে পাকিস্তানবাদী বলে উল্লেখ করেছে তাছাড়া সরকার পক্ষের একজন বিশ্বাসী সাক্ষী বলেছেন যে আসামী কারফিউর সময় রাতে এমনকি পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পণের পূর্বের রাতেও ঘোরাফেরা করেছে। কিন্তু জজ সাহেব প্রশ্ন রাখেন পাক বাহিনীর দালাল ছাড়া সে সময় অমনভাবে ঘোরা সম্ভব ছিল কি?

সংবাদ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ও অন্যতম সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যা মামলার রায় শোনার জন্য বিপুল দর্শকের আগমন হয়।
মামলাটি সরকার পক্ষে সিনিয়র স্পেশাল পি.পি খন্দকার মাহবুব হোসেন ও আসামী পক্ষে এডভোকেট এম, এম সাফকতা হোসেন পরিচালনা করেন।

পাদটিকা : এটি যুদ্ধের পর সবচেয়ে হাইপ্রোফাইল যুদ্ধাপরাধীর বিচার কিন্তু আইনের ফাক গলে সে ঠিকই বেরিয়ে গেছে। এতে একটা উপকার হয়েছে।সবাই বুঝে গেছে মান্ধাতা ব্রিটিশ আইন দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্ভব নয়, সম্ভব নয় আদি দালাল আইনেও যা প্রচলিত সাক্ষ্য প্রমাণ চায়। যুদ্ধাপরাধের বিচারে চাই স্পেশাল ট্রাইবুনাল। সেই দিনটির অপেক্ষাতেই আপাতত বাঁচি।

Leave a Reply

%d bloggers like this: