চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর দেখতে চায় শহিদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানেরা
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্বজনরা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে গলিত ও ক্ষতবিক্ষত লাশ খুঁজে পান। স্বজনদের বয়ানে ফিরে পাওয়া বুদ্ধিজীবীদের লাশে ছিলো অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। চোখ, হাত-পা ছিলো বাঁধা। কারও কারও শরীরে ছিলো একাধিক গুলি। অনেককে হত্যা করা হয়েছিলো ধারালো অস্ত্র দিয়ে। লাশের ক্ষতচিহ্নের কারণে অনেকেই প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেননি।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর প্রিয়জন হারানো বেদনা স্বজনদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ালেও এখন অনেকটা ভারমুক্ত নিশ্বাস নিতে পারছেন বলে জানিয়েছেন তারা। কারণ, যাদের পাশবিকতায় নিমিষে তারা অনিশ্চিত জীবনের পথে চলে গিয়েছিলেন, বিজয়ের চরম সময়ে পাননি বিন্দুমাত্র আনন্দ, করতে পারেননি বিজয় উদযাপন; সেই খুনীদের বিচার নিশ্চিত করা গেছে। ইতোমধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। যারা এখনও বাকি আছে তাদের দণ্ড কার্যকরেও দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের কাছে দাবি শহিদ বুদ্ধিজীবী পরিবারগুলোর।
একাত্তরের ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে পরাজয় নিশ্চিত জেনে দেশের মেধা বিনাশের ভয়ঙ্কর চক্রান্ত বাস্তবায়নে নামে পাকিস্তান বাহিনী। সঙ্গে এ দেশের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস। ২৫ মার্চ থেকে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা শুরু করলেও শেষ কামড় দেয় ১৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ১৯৭২ সালে জাতীয় পর্যায়ে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলনে আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজ উইকের সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহিদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট এক হাজার ৭০।
শহিদ ডাঃ আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শহিদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের চোখ ভেসে গেছে জলে, বুকে নামে কষ্টের পাথর। আজ ৪৫ বছর পর যখন সেই খুনীদের একের পর এক বিচার সম্পন্ন হচ্ছে তখন আমাদের পাথর নামতে শুরু করেছে। সর্বশেষ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম হোতা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে সেই চোখে এবারের বিজয় অন্যরকম। এবার আমরা উদযাপনের স্বপ্ন দেখতে পারি। এতদিন যে কষ্ট বুকে বয়ে বেড়িয়েছি সে কষ্ট লাঘব হয়েছে।
তার মেয়ে ডাঃ নূজহাত চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হয়েছে। অনেকের দণ্ড কার্যকর হতেও আমরা দেখেছি। তবে এখনও অনেকেই বাকি আছে। তিনি বলেন, আলবদর বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ যেমন- চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানকে দণ্ড দেয়া হয়েছে, তবে বিদেশে পলাতক থাকায় তাদের দণ্ড কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা শহরে আমাদের বাবাদের খুঁজে খুঁজে তুলে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে এই দুই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী দায়ী। এদের দেশে এনে সাজা কার্যকর করতে পারলে যুদ্ধাপরাধের বিচারে বড় সাফল্য হবে।
তিনি আরও বলেন, চৌধুরী মঈনুদ্দিন যুক্তরাজ্য এবং আশরাফুজ্জামার যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তাদের দেশে আনার জন্য সরকার জোরালো ব্যবস্থা নেয় আর সে ব্যবস্থা গ্রহণের পদ্ধতি যেন দৃশ্যমান হয় সে প্রত্যাশাই এই শহিদ বুদ্ধিজীবীর কন্যার। বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম হোতাদের মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ায় এবারের বিজয় দিবসে একটু ভারমুক্ত নিশ্বাস নিতে পারছেন বলেও জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নূজহাত চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং বিচার করছে। তবে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করাই আমাদের মূল কাজ, যা বাকি রয়ে গেছে। জামায়াতকে বিচারের মুখোমুখি করে সংগঠন হিসেবে তাদের শাস্তির ব্যবস্থাও করতে হবে।
শহিদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূর জনকণ্ঠকে বলেন, একজন শহিদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান হিসেবে এ বছরের শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস আমাদের জন্য অনেকটাই অন্যরকম। একটু স্বস্তির। কারণ এর মধ্যে আমরা অনেক বাস্তব পদক্ষেপ সরকারকে নিতে দেখেছি এবং বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘদিন স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি এ দেশের ক্ষমতায় ছিলো। যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন করার কাজও তারা করেছে। এ দেশে তারাই যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী পর্যন্ত বানিয়েছিলো। জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরিয়ে নেয়ার সম্পূর্ণ অপচেষ্টাই ছিলো। তিনি বলেন, পরবর্তীতে ’৯০-এর দশকে শহিদ জননী জাহানার ইমামের নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে উঠল, তাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং ঘাতক-দালালদের বিচারের বিষয়টি সামনে চলে এলো। কিন্তু তার বাস্তব রূপ পাওয়ার জন্য আমাদের আরও বেশকিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচন আমাদের জন্য বড় ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ওই নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইশতেহার দিয়েই জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তিনি ক্ষমতা নেয়ার পরপরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেন এবং দৃঢ়তার সঙ্গে বিচারকাজও চালিয়ে নিচ্ছেন।
শহিদ বুদ্ধিজীবীর এই সন্তান বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বেশ কয়েকজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় হয়েছে এবং তাদের সাজাও কার্যকর হয়েছে। তিনি বলেন, এই যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড কার্যকর বন্ধ করতে অনেক চাপ এসেছে, তার পরেও পিছপা হননি আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তবে আলবদর বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মঈদুদ্দিন ও তার সঙ্গী আশরাফুজ্জামানের দণ্ড আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হয়েছে। দেশের বাইরে থাকায় এদের দণ্ড কার্যকর হয়নি। শহিদ সন্তান হিসেবে আমি দাবি জানাব, তারা যে দেশে আছে ওই দেশের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ বছর অনেকটা ভারমুক্তভাবে বিজয় দিবস উদযাপন করতে পারবেন উল্লেখ করে তিনি জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে অনেক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে এবং তাদের দণ্ডও কার্যকর হয়েছে। বিষয়টি আমাদের ও জাতির জন্য স্বস্তির। এজন্য নিজেকে অনেকটা ভারমুক্ত ভাবছি। কোন প্রতিহিংসার কারণে তাদের শাস্তি দেয়া হয়নি, বরং ’৭১ সালের জঘন্য অপরাধের জন্য তাদের শাস্তি দেয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য এই বুদ্ধিজীবীর সন্তানেরা।
শহিদ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার সন্তান মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মধ্য দিয়ে শহিদদের আত্মা শান্তি পেয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয় এই প্রেরণা থেকে যে, তারা যে মুক্তবুদ্ধিচর্চার মাধ্যমে স্বাধীনতা স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে যাচ্ছিলেন সেটা দমনের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। আজ যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করছে তাদের ওপর একই কায়দায় হামলা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে আমি একটা ধারাবাহিকতা দেখি এবং তার জন্য আমাদের এ বিজয় দিবসটাকে ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন মুক্তবুদ্ধির চর্চা নির্বিঘ্নে করতে পারে এ রকম সমাজের লক্ষ্যে এগোতে হবে।
শহিদ বুদ্ধিজীবী আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল হাসান বললেন, বিহারিরা আমার বাবাকে ওই কাদের মোল্লার হাতেই তুলে দিয়েছিলো। আমার বাবাকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিলো। কাদের মোল্লার পর মুজাহিদ, এরপর নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। এতে আমি সান্ত্বনা পেয়েছি।