প্রতিবেদন

জঙ্গিবাদকে পরাস্ত করবেই বাংলাদেশ

সমকালীন বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যা জঙ্গিবাদ। জঙ্গিবাদের বিস্তার এখন বিশ্বশান্তির প্রধান অন্তরায়। উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হামলায় রক্তাক্ত পৃথিবীর সামনে জঙ্গিবাদ দমন প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর জন্য বিপজ্জনক এই চক্রটি ২০১৬ সালের ১ জুলাই আঘাত হানে বাংলাদেশেও। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সংঘটিত হয় ভয়াবহ জঙ্গি হামলা। নরপশু জঙ্গিদের নৃশংস হামলায় নিহত হয় দেশি-বিদেশি ২০ ব্যক্তি। প্রচ- শোকাতঙ্কে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত যৌথ অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’-এর মাধ্যমে জঙ্গিদের পরাজিত করে মুক্ত করা হয় অবরুদ্ধ হলি আর্টিজান এবং জীবিত উদ্ধার করা হয় ৫ বিদেশিসহ ৩২ জনকে।
হলি আর্টিজানের ঘটনা জঙ্গিবাদ মোকাবিলার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে বাংলাদেশকে। তদুপরি সিরিজ বোমা হামলা, উদীচী হামলা, রমনার বটমূলে হামলা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার কুশীলব ও বাংলাভাই-মুফতি হান্নানদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর উসকানি ভয়াবহ এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করে জঙ্গিবাদ দমনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞাময় সুদৃঢ় নেতৃত্বে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাফল্য আজ বিশ্ববাসীর কাছে অনুকরণীয় বিবেচিত হচ্ছে। হলি আর্টিজানের হামলার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে জঙ্গিদের ছোট-বড় আস্তানা শনাক্ত করে তা ধ্বংস করা হয়েছে। বিশ্বের বড় বড় উন্নত রাষ্ট্রগুলোও যেখানে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনে হিমশিম খাচ্ছে, জঙ্গি হামলায় আক্রান্ত হওয়ার পর জঙ্গি গ্রেফতারে ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ একের পর এক অভিযান চালিয়ে জঙ্গি আস্তানা ধ্বংস করছে। ফলে জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের সাফল্য এখন বিশ্বের কাছে রোল মডেল।
২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানের ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’-এর পর থেকে অন্তত ২৪টি আলোচিত জঙ্গিবিরোধী অপারেশন পরিচালনা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব অভিযানে নিহত হয়েছে ৫৬ জঙ্গি। অভিযান ছাড়াও পুলিশ-র‌্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে আরও অন্তত ১১ জঙ্গি। এ ছাড়া হামলার উদ্দেশে বোমা বহন করতে গিয়ে বিস্ফোরণে মৃত্যু ঘটেছে আরও তিন উগ্রপন্থির। সর্বমোট ৭০ জঙ্গি নিহত হয়েছে গত এক বছরে। এসব সফল অভিযানে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, সারোয়ার জাহান ওরফে আবদুর রহমান, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম, মাইনুল ইসলাম মুসা প্রমুখ ভয়ঙ্কর জঙ্গি নেতারা নিহত হয়েছে। অসংখ্য জঙ্গিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।
হলি আর্টিজানের ২৫ দিনের মাথায় ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরে জাহাজবাড়ি খ্যাত তাজ মঞ্জিলে ‘অপারেশন স্টর্ম-২৬’ চালায় পুলিশ। এই অপারেশনে ৯ জঙ্গি নিহত ও একজনকে গ্রেফতার করা হয়। কল্যাণপুরের অপারেশনে ৯ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রথম বড় ধরনের ধাক্কা খায় নব্য জেএমবি। এই নিহতদের সাথে হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তারা প্রায় সবাই নব্য জেএমবি আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য বা ইসাবা গ্রুপের সদস্য।
এরপর ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় সিটিটিসি ও পুলিশ সদর দফতরের এলআইসি শাখা পরিচালিত ‘অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭’-এ হলি আর্টিজান হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী তামিম, তার দুই সহচর তওসিফ হোসেন ও ফজলে রাব্বি নিহত হয়। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই ২ সেপ্টেম্বর রূপনগরের শিয়ালবাড়ীতে সিটিটিসি পরিচালিত এক অভিযানে তামিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ নব্য জেএমবি নেতা মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম নিহত হয়। ১০ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার আজিমপুরে লালবাগ রোডে পরিচালিত অপারেশনে নিহত হয় জেএমবি নেতা তানভীর কাদেরী। এ সময় জঙ্গিদের স্ত্রী-সন্তান চারজন গ্রেফতার হয়।
এরপর গত বছরের ৮ অক্টোবর গাজীপুরের নোয়াগাঁওয়ে ও হাড়িনালে দুটি, টাঙ্গাইলের কাগমারা মির্জা মাঠে একটি ও আশুলিয়ায় আরেকটি জঙ্গি আস্তানায় পৃথক অভিযান চালায় পুলিশ ও র‌্যাব। এতে ১২ জঙ্গি নিহত হয়। আশুলিয়ার অভিযানে গুরুতর আহত নব্য জেএমবির অর্থ সমন্বয়কারী সারোয়ার জাহান ওরফে আবদুর রহমান ওরফে আবু ইব্রাহীম আল হানিফের পরে হাসপাতালে মৃত্যু ঘটে। তার মৃত্যুতে জেএমবির অর্থ সংগ্রহ ও সরবরাহ চ্যানেল বড় ধরনের সংকটে পড়ে।
এরপর গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর দক্ষিণখানের আশকোনায় ‘অপারেশন রিপল-২৪’ পরিচালনা করে সিটিটিসি। ১৬ ঘণ্টার অভিযানে ওই আস্তানা থেকে রূপনগরে নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা ও মুসার স্ত্রী তৃষা মনি ওরফে উম্মে আয়েশা তাদের দুই শিশুসন্তানসহ আত্মসমর্পণ করে। ২৪ ডিসেম্বর অভিযান চলার সময় জঙ্গি সুমনের স্ত্রী নারী জঙ্গি সারিকা ওরফে সাকিনা তার শিশুসন্তান সাবিনাকে নিয়ে পুলিশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় শরীরে বেঁধে রাখা সুইসাইডাল ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে সারিকা সেখানেই মারা যায়। আহত হয় সাবিনা। ওই অপারেশনের মধ্য দিয়ে নব্য জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের কোনো নারী জঙ্গি নিহত হয়।
এরপর চলতি বছরের ১৫ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকু-ে প্রেমতলা চৌধুরীপাড়া এলাকার দোতলা বাড়ি ‘ছায়ানীড়’-এ জঙ্গি আস্তানায় ‘অপারেশন অ্যাসল্ট-১৬’ পরিচালনা করে পুলিশ। এ অভিযানে চার জঙ্গি নিহত হয়। ২৫ মার্চ সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার ‘আতিয়া মহল’-এ টানা ১১১ ঘণ্টা জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালায় সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো দল। অভিযানে চার জঙ্গি নিহত হয়। তবে অভিযানের মধ্যেই জঙ্গিদের টাইম বোমার বিস্ফোরণে পুলিশের দুই পরিদর্শক চৌধুরী মো. আবু কয়ছর ও মনিরুল ইসলাম নিহত হন। জঙ্গিদের বোমায় প্রাণ হারান আরও চারজনÑ ছাত্রলীগ নেতা জান্নাতুল ফাহিম, ছাত্রলীগ কর্মী অহিদুল ইসলাম অপু, ডেকোরেটর ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম ও আলোকসজ্জাকারী খাদিম শাহ। জঙ্গিদের বোমায় আহত হন র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদসহ অর্ধশত ব্যক্তি। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে যান র‌্যাবের চৌকস এ কর্মকর্তা।
এ ছাড়াও চলতি বছরের ২৯ মার্চ ভোরে মৌলভীবাজারের নাসিরপুরে সিটিটিসি পরিচালিত ‘অপারেশন হিট ব্যাক’-এ জঙ্গি লোকমান হাকিম ওরফে সোহেল রানা, তার স্ত্রী ও পাঁচ শিশু নিহত হয়। একই সময় মৌলভীবাজারের বড়হাটে ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’-এ নিহত হয় এক নারী জঙ্গিসহ মোট তিন জঙ্গি। তাদের মধ্যে ছিল নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মুসা ও আশরাফুল আলম নাজিম। এরপর চলতি বছরের ১০ মে রাতে পুলিশ রাজশাহীর গোদাগাড়িতে ‘অপারেশন সান ডেভিল’ চালায়। এতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী আবদুল মতিন নিহত হন। আহত হন সাত পুলিশ সদস্য। অভিযানে জঙ্গি সাজ্জাদ ও তার পরিবারের পাঁচজন নিহত হয়। এর আগে ২৭ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের ত্রিমোহনী শিবনগর এলাকায় পরিচালিত ‘অপারেশন ঈগল হান্ট’-এ জঙ্গি রফিকুল ইসলাম আবুসহ চার জঙ্গি নিহত হয়।
এ ছাড়াও হলি আর্টিজানের পর বিভিন্ন সময় বেশ কিছু এলাকায় আরও কয়েকটি জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এগুলোর মধ্যে কুমিল্লায় ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’, ঝিনাইদহে ‘অপারেশন শাটল স্পিল্গট’ ও ‘অপারেশন সাউথ প’ অন্যতম। এ ছাড়া ঢাকার অদূরে সাভার ও গাজীপুরে একাধিক দফায় অভিযান চালানো হয়।
জঙ্গি আস্তায় অভিযান ছাড়াও বছরজুড়ে পুলিশ-র‌্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা নূরুল ইসলাম মারজানসহ ১১ জন নিহত হয়। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি রাতে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় বন্দুকযুদ্ধে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মারজান তার সহযোগী সাদ্দামসহ নিহত হয়। এ ছাড়া ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ কসবায় তাজুল ইসলাম আল মাহমুদ ওরফে মামা হুজুর, একই বছরের আগস্টে জেএমবির উত্তরাঞ্চলের নেতা খালেদ হাসান ওরফে বদর মামা, ৪ আগস্ট ময়মনসিংহের নান্দাইলে শোলাকিয়ায় ঈদগাহে হামলার চেষ্টায় জড়িত শফিউল ইসলাম ওরফে মুক্কাতিল ও তার সহযোগী ওমর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। একই বছরের ৮ অক্টোবর টাঙ্গাইলের কাগমারায় র‌্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় জেএমবির আতিকুর রহমান ও সাগর হোসেন। এ ছাড়া গত বছরের আগস্টে রাজশাহীর বাগমারায় পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে আনোয়ার হোসেন নামে জেএমবির এক সদস্য নিহত হয়।

হলি আর্টিজানে নিহতদের প্রতি সর্বস্তরের শ্রদ্ধা
গুলশানের হলি আর্টিজানের ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলার এক বছর পার হয়েছে। উগ্র জঙ্গি ও ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রথম বার্ষিকীতে হলি আর্টিজান বেকারি (পুরনো) প্রাঙ্গণে গত ১ জুলাই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ছিল শোকাতুর মানুষের ঢল। শ্রদ্ধা নিবেদন করে জাপান, ইতালি ছাড়াও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতগণ। এ ছাড়া স্বজন হারানো মানুষ আর বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নিহতদের স্মরণে। শ্রদ্ধা জানাতে এসে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপে জঙ্গিবাদ নির্মূলের আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিশিষ্টজনরা। জঙ্গিবাদ রুখতে সবাইকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানান।
গত ১ জুলাই সকাল ১০টায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপির নেতৃত্বে একটি দল। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও পুলিশ যৌথভাবে জঙ্গি দমনে সফলতা পেয়েছে। প্যারিসের পুলিশ যেটা পারেনি বাংলাদেশের পুলিশ সেটা করে দেখিয়েছে। জঙ্গিবাদ দমনে সবাইকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে একটি প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াতে হবে।
এ সময় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ এমপি, জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ও এনামুল হক শামীম, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, উপ-দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়–য়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

গ্রন্থনা : রায়হান কবির

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *