জি-৭ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনন্য উচ্চতায় বাংলাদেশ
গত ২৬ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জি-৭ সম্মেলনে অংশ নিতে জাপানের উদ্দেশে যাত্রা করেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে’র আমন্ত্রণে তিনি এই সম্মেলনে অংশ নেন। জি-৭ এর আউটরিচ প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, শ্রীলংকা, পাপুয়া নিউগিনি ও আফ্রিকার দেশ চাদ-এর রাষ্ট্রপ্রধানদের এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অন্য দেশগুলো নিজেদের আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব করলেও বাংলাদেশের আমন্ত্রণ পাওয়ার মূল কারণ চলমান উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে থাকা।
২৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপানের কাসিকজিমা দ্বীপের সিমাকানকো হোটেলে ‘জি-৭’ সম্মেলনের আউটরিচ বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে তিনি নীতি প্রণয়ন ও রাজনীতিতে নারীদের গুরুত্ব দেওয়া, সমাজে নারীদের অধিকার ও মর্যাদা তথা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য পরিসেবা বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান। উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা তৃণমূল পর্যায়ে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে তার সরকারের প্রচেষ্টার বিষয়টি তুলে ধরেন। গ্রাম পর্যায়ে বাংলাদেশের কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো বিশ্বব্যাপী একটি ‘রোল মডেল’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আউটরিচ বৈঠকের অবকাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও জার্মানের চ্যান্সেলর আ্যাঞ্জেলা মারকেল, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সাথে পৃথকভাবে আলোচনায় পারস্পরিক স্বার্থ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আলোচনা করেন। এ সময় তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
আউটরিচ বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকা-ের সাথে অংশীদারিত্বের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বৈঠকের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি অর্জনে তার সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের তথ্য তুলে ধরেন। বাংলাদেশ এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে আকাশ পথের নিরাপত্তাজনিত বিষয়ে একযোগে কাজ করার বিষয়টি উল্লেখ করে ক্যামেরন সাম্প্রতিক অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে আসার বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়েও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অভিমত জানতে চাইলে তিনি যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষেই অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত থাকলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
২৮ মে জাপানের নাগোয়াতে শিনজো আবে’র সাথে একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত ৬০০ কোটি ডলারের অংশ হিসেবে এ বছর ১৫০ কোটি ডলার দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে পদ্মার পাড়ের চর জানাজাত-এ একটি অত্যাধুনিক বিমানবন্দর তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিষয়েও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেন। একই সাথে জাপান ২০১৯ সালের মধ্যে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ করে দেওয়ার বিষয়েও ত্বড়িৎ পদক্ষেপ গ্রহণেও নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে রুলস অব অরিজিন ভবিষ্যতে আরও শিথিল করার বিষয়েও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন। জি-৭ সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অংশগ্রহণ এবং ভূমিকা জি-৭ নেতৃবৃন্দের পর্যালোচনার মাধ্যমে এই বৈঠকের মূল বিষয়বস্তু বের করে আনার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি বিনির্মাণে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ব্লু ইকোনমির জন্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন শিনজো আবে। বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক এখন থেকে কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীরা জাপানে অ্যারাইভ্যাল ভিসা পাবেন।
এরপর শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি মিরথিপালা সিরিসেনার সাথেও বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে তিনি সার্ক দেশগুলোর প্রবাসে কর্মরতদের রেমিট্যান্স দেশে পাঠানোর লক্ষ্যে এই অঞ্চলে একটি কমন প্লাটফর্ম গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন এবং শ্রীলংকাও এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় তাদের উদ্যোগ বিনিময় করতে পারে বলে তার অভিমত ব্যক্ত করেন। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টের কাছে এই অর্থনৈতিক কেন্দ্র স্থাপনের কলাকৌশল বিনিময় করার অনুরোধ করা হয়েছে। যাতে প্রয়োজনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বাংলাদেশও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীলংকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে ১০০ কোটি টাকা আর্থিক সাহায্য এবং দুর্গতদের জন্য শ্রীলংকার সরকারের প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা প্রদানের কথাও উল্লেখ করেন। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট ঢাকা-কলম্বো রুটে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট পুনরায় চালুর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান। উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেন।
২৮ মে প্রধানমন্ত্রী টোকিওতে চ্যান্সারি ভবন উদ্বোধন করেন। প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭১৪ বর্গমিটার এলাকায় টোকিও’র কেন্দ্রস্থলে কিওইচো, ছিওদা-কু এলাকায় বাংলাদেশের দূতাবাসের নতুন ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, আমরা ঐতিহাসিক টোকিও নগরীর কেন্দ্রস্থলে আমাদের নিজস্ব একটি ঠিকানা পেয়ে নিঃসন্দেহে গর্বিত। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সফরের মধ্য দিয়ে জাপানের সাথে বন্ধুত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য শেখ রাসেল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দুর্ভাগ্যের রজনীতে বঙ্গবন্ধুর সাথে নৃশংসভাবে নিহত হন। শেখ হাসিনা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে জাপানের অবদান বিশেষ করে আমাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য টিফিনের অর্থ বাঁচিয়ে জাপানি শিশুদের অর্থ সংগ্রহের কথা স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা লাভের পর জাপান যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠনে সব ধরনের সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। তিনি বলেন, জাপান সরকার এবং জাপানের প্রতিটি লোক আমাদের জন্য তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আর্থ-সামাজিক ও উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুটি দেশের মধ্যে বিদ্যমান দীর্ঘদিনের সম্পর্কের উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার সম্পর্ক জোরদার রাখার লক্ষ্যে সব সময় সচেষ্ট। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সব সময় দেশের সকল উন্নয়ন কর্মকা-ে জাপানের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, হোটেল সোনারগাঁও, যমুনা সেতু, রূপসা সেতু এবং পদ্মা সেতু নির্মাণে জাপানের ব্যাপক অবদান রয়েছে। জাপান আমাদের কক্সবাজার জেলার মহেশখালীর মাতারবাড়িতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করছে। তারা (জাপান) আমাদের মেট্রোরেল প্রকল্পসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পেও সহযোগিতা করছে। তিনি বলেন, কাজেই জাপানের সাথে বন্ধুত্বকে আমরা সব সময়ই গুরুত্ব দিয়ে থাকি এবং আমরা তাদের সহযোগিতার কথা কখনও ভুলে যাব না।
২৯ মে টোকিওতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপানের ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে মান্ডারিন ওরিয়েন্টাল হোটেলের লিন্ডেন কক্ষে একটি বৈঠকে বসেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের দরোজা জাপানের বিনিয়োগকারীদের জন্য সর্বদা উন্মুক্ত। তিনি বলেন, বাংলাদেশ উৎপাদনের নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে। আমরা শতাধিক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কিছু আইটি পার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছি। এর মধ্যে ৩৩টির কাজ এগিয়ে চলেছে। আশা করছি, আগামী চার বছরে বাংলাদেশের শিল্প উৎপাদন আরও ১ কোটি মানুষ যুক্ত হবে। জাপানকে বাংলাদেশের সবচেয়ে পরীক্ষিত বন্ধু উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, কর্মনিষ্ঠার কারণে জাপানের বিনিয়োগকারীদের সব সময়ই সবার আগে জায়গা দিয়েছে আমাদের জনগণ। সেই বিবেচনা থেকে বলছি, আমাদের দরজা আপনাদের জন্য উন্মুক্ত। আমি চাই, বাংলাদেশের এই ঊর্ধ্বমুখী সুযোগ এবং তারুণ্যদ্দীপ্ত জনশক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করুক আমাদের জাপানি বন্ধুরা।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, ইতোমধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে দুটি পাবলিক-প্রাইভেট অর্থনৈতিক সংলাপ এগিয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আমরা প্রশাসনিক প্রক্রিয়া আরও সহজতর করার জন্য সরকার কাজ করছে বলে জানান তিনি। বিনিয়োগে এগিয়ে এলে ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি। বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও অন্যান্য সংযোগ-সুবিধা প্রদান, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা এবং কিছুক্ষেত্রে করও শিথিল করার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, জাপানি সমাজ এখন ‘রোবোটিক বিবর্তনে’ চলে যাচ্ছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ঠিক এমনই কিছু খাতে সহযোগিতা করতে পারে, যার মধ্যে ‘ইমাজিনেটিভ সফটওয়্যার’, ‘শেয়ারড/ক্লাউড-বেজড প্রসেসিং’র কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি জাপানি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা আমাদের ওষুধ ও জাহাজ নির্মাণ খাতেও আগ্রহী হতে পারেন। আমাদের সমুদ্র অর্থনীতি আপনাদের সামনে তুলে ধরছে বিনিয়োগ সুযোগের বিশাল পরিধি। আপনারা নজর দিতে পারেন আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতেও।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, সরকার লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, জুট, মৎস্য আহরণ, টেক্সটাইল ম্যানুফেকচারিং খাত নিয়েও কাজ করছে। একই সাথে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোকে ‘সবুজ’ হতে উৎসাহ জোগাচ্ছে।
বৈঠকে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) ও জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেটরো) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। এই সমঝোতা স্মারককে বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরের জন্য প্রথম জাপানি স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচনা করছে এফবিসিসিআই। সংগঠনটি বলছে, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের প্রাইভেট সেক্টরে নতুন নতুন বিনিয়োগের পথ খোঁজা যাবে।