জীবনের রণাঙ্গন থেকে… (ধারাবাহিক আত্মজীবনী পর্ব-১)
লেখক: ফকির এখলাসুর রহমান
তারিখ: ১২ নভেম্বর ২০১৭
বর্তমান বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার দারিয়ালা গ্রামে ১৯৫৩ সালের পহেলা আগস্ট আমার জন্ম। আমাদের বসতিটা আঠারোবাঁকি নদীর চরাঞ্চলে অবস্থিত। অজ-পাড়াগাঁয়ের কৃষিভিত্তিক অশিক্ষিত পরিবারে বেড়ে উঠা আমার শৈশব-স্মৃতি। তবে অনেক পালা পার্বণের ভেতর দিয়ে আনন্দেই কেটেছে শৈশব। লেখাপড়া জানা না থাকলে ও বাবা ছিলেন অনেক অসাম্প্রদায়িক। বাবার বহু হিন্দু বন্ধু ছিল। তাদের সব পূঁজায় বাবা নিমন্ত্রণ পেতেন এবং বেশিরভাগ জায়গায় আমাকে পাঠাতেন। বাবা মোটেই ধার্মিক ছিলেন না এবং ছোট বেলায় কখনোই ধর্ম চর্চার কথা বলতেন না। অগ্রহায়ণ মাসে ফসলাদী ঘরে তোলার পর পালা গান, জারি গান, যাত্রা, লাঠি খেলে, ঢালী খেলা, ঘোড়দৌড় সহ নানা ধরণের বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। লাঠি খেলা, ঢালী খেলায় আমি নিজে অংশগ্রহণ করেছি। আমার বাবা চাচারা ৫ ভাই। তাদের কোনো ছেলে মেয়েরা যেহেতু স্কুলে যেতো না তাই আমার বেলায় ও কোন তাড়া ছিল না। আমার মা হটাৎ করে একদিন আবিষ্কার করলেন যে আমি ঘরের মাচায় উঠে ধান চাল রাখার সব মাটির পাত্রে কাঠ পোড়ানো কয়লা দিয়ে কীসব আঁকা-ঝুঁকা করেছি। আমার এটা দেখানোর জন্য ডেকে আনলেন আমার বাবার এক চাচাতো ভাইকে যিনি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি দেখে আমাকে স্কুলে পাঠানোর সুপারিশ করলেন। বাবা বেঁকে বসলেন। আমার বড়ো দুই বোন মারা যাবার পর আমার বাবা জন্মের আগেই মানত করেছিলেন ছেলে হলে মাদ্রাসায় পড়াবেন। আমার স্কুল শিক্ষক চাচা বহু কষ্টে বাবাকে রাজী করালেন আমাকে যেন আমার বাবা পঞ্চম শ্রেণী পাস্ করা পর্যন্ত স্কুলে পড়ার অনুমতি দেন। বাবা রাজী হলেন। এভাবে আমার স্কুল জীবন শুরু।
স্কুলে ভর্তি হওয়াটা আমার জীবনের একটা মাইলফলক। লেখাপড়া জানা পরিবারে স্কুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আমার জন্য ছিল একটা উত্তেজনাকর অভিজ্ঞতা। আমিই হচ্ছি আমাদের বিশাল পরিবারের একমাত্র স্কুলগামী বালক। এই স্বাতন্ত্রবোধ থেকে মন দিয়ে পড়তাম, নিজে থেকেই। পড়ালেখা করার জন্য যেমন তাড়া দেওয়ার কেউ ছিল না তেমন পড়ালেখায় সাহায্য করারও কেউ ছিল না। প্রথম শ্রেণীর প্রথম পরীক্ষায় বিশাল নম্বরের ব্যাবধানে প্রথম স্থান অধিকার করলাম। আশেপাশের অনেক শিক্ষিত পরিবারের ছাত্র ও অভিভাবকদের চোখ বড় হয়ে গেলো। এরপর আমি পড়লাম অন্য সমস্যায়। একবার যখন প্রথমস্থান অধিকার করেছি তাতো আর ছাড়া যায় না। এটা আমাকে একটা বাড়তি চাপের ভেতর ফেললো। এই বাড়তি চাপের কারণেই হয়তো পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত কখনোই দ্বিতীয় হই নাই।
পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়ার বাইরে এমন একটা অভিজ্ঞতা হয় যা আমার সামনের পুরো জীবনটাকেই একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় একবার একা লঞ্চে করে খুলনাতে বেড়াতে যাই আমায় মেঝো খালার বাসায়। হঠাৎ করে লঞ্চের ইঞ্জিন রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ আটকে যায় ইঞ্জিনের উপর। খুলনা পৌঁছানোর আগে প্রায় ঘন্টা তিনেক ইঞ্জিনের পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে। তেমন কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু কৌতুহলটা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকলো। সেকারণে দিন দশেকের ভিতর আবারও খুলনা গেলাম মূলত লঞ্চের ইঞ্জিন দেখার জন্য। এবার ইঞ্জিনচালক আমাকে সনাক্ত করলেন যে ক’দিন আগেও এভাবে আমি ইঞ্জিনের পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছি। তিনি আমার কুশলাদী জিজ্ঞাসা করাতে সাহস পেয়ে প্রশ্ন করলাম এই ইঞ্জিন কারা বানায়। ইঞ্জিন চালক শুধু বললেন ইঞ্জিনিয়াররা বানায়। এভাবে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত অনেকবার এই ইঞ্জিন দেখার নেশায় লঞ্চে করে খুলনায় গিয়েছি। এরপর আমাকে খুব যত্ন করে ইঞ্জিনের পাশে বসার ব্যাবস্থা করে দিতেন সেই ইঞ্জিনচালক। একবার কৌতুলবশে প্রশ্ন করলাম, ‘এই ইঞ্জিন কোন ইঞ্জিনিয়াররা বানায়?’ ইঞ্জিনচালক বললেন, ‘মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা বানায়I’ সেই মুহূর্তে ঠিক করে ফেললাম আমি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হব।
ছাত্রজীবনের পরবর্তী ধাপগুলোতে অসম্ভব সব বাঁধার মোকাবিলা করেছি। কিন্তু এক মুহূর্তও আমি লক্ষ্যচ্যুত হই নাই। আমার বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্কুল শিক্ষা চালিয়ে যাবার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম। বাবার সাথে আমার স্কুল শিক্ষক চাচার সমঝোতা ছিল আমাকে যেন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুলে পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর কথামত বাবা আমাকে কওমি মাদ্রাসায় যেতে বললেন। আবার গিয়ে ধরলাম আমার চাচাকে। এখন আমার ভয় স্কুলে না পড়লে তো মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবো না। আমার বাবাকে অনেক বুঝিয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা চালিয়ে যেতে অনুমতি পেলাম।
গ্রামের হাইস্কুলেই ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। এই হাইস্কুলের প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও বাইরে থেকে আরো তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ভর্তি হয়েছে ষষ্ঠ শ্রেণীতে। আমি এসেছিলাম নতুন প্রতিষ্ঠিত অখ্যাত একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এই পরিস্থিতিতে আমার মাথায় একটা চিন্তাই কাজ করছিলো। তা হলো এতদিন তো ক্লাসে প্রথম হয়ে এসেছি। এবার এতগুলো ভালো স্কুলের ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে কিভাবে পরীক্ষায় প্রথম স্থানটা ধরে রাখবো। হাইস্কুলের শিক্ষকদের সাথে পূর্ব পরিচয় ছিল না। ষষ্ঠ শ্রেণীর প্রথম পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে প্রত্যেক বিষয়ের শিক্ষকরা ক্লাসে এসে প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত ছাত্রদের নাম ডাকা শুরু করলেন। এত প্রতিযোগিতার ভেতরও সব বিষয়ে আমার নামই প্রথমে ডাকা হয়েছিল। আমি নিজেও এতটা আশা করি নাই। ফলাফলের একই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে অষ্টম শ্রেণী শেষ করলাম এই হাইস্কুল থেকে। আমার বাবা যাই বলুক না কেন আমি তখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই প্রচলিত স্কুল শিক্ষা চালিয়ে যেতে। এখন আমার শক্ত অবস্থানের কারণ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হবার অদম্য বাসনা। কিন্তু সমস্যা হলো গ্রামের স্কুলে নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগ ছিল না তখন। আমার চাচা বাবার সাথে কোন আলাপ না করে আমাকে বাড়ি ছেড়ে খুলনায় গিয়ে কোন ভালো স্কুলে ভর্তি হতে বললেন যেখানে বিজ্ঞান বিভাগ আছে। উপায়ন্তর না দেখে আপাতত গ্রামের হাইস্কুলেই নবম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। চাচা খুলনায় যেতে বললেও তিনি আমাকে কোন সরাসরি সাহায্যে আসতে চাইলেন না আমার বাবার ভয়ে। আমার তখন সবথেকে বড় দুঃশ্চিন্তা আর বুঝি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে পারলাম না।
১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে আসা যাওয়ার লঞ্চ ভাড়া জোগাড় করে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম যদি কোন ভালো স্কুলে ভর্তি হতে পারি। খুলনার স্কুলগুলো সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। আমাদের গ্রামের কিছু ছাত্র খুলনার বিভিন্ন কলেজে পড়তো। তাদের তিনজনকে পেলাম লঞ্চে। তাদের কাছে জানতে চাইলাম খুলনার সব থেকে ভালো স্কুলের নাম। তারা জানালো সেন্ট জোসেফস হাইস্কুলের নাম। সেটাই নাকি খুলনার সেরা স্কুল। কেন সেরা স্কুলের নাম জানতে চাচ্ছি সেটার উত্তরে যখন বললাম আমি সেখানে ভর্তি হতে চাই, তখন তিনজনই শব্দ করে হাসা শুরু করলো। তারা বললো এসব স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য হাজার হাজার ছাত্র ডিসেম্বর মাসে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমি সেসব স্কুলে ভর্তির চিন্তা করছি এটাই তাদের হাসির কারণ। তাদের হাসি আমাকে দমাতে পারলো না।
লঞ্চ থেকে নেমে লোকদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে পায়ে হেঁটে গিয়ে সকাল এগারোটা নাগাদ সেন্ট জোসেফস হাইস্কুলের বিশাল গেটের সামনে হাজির। শুনশান নীরবতা। ক্লাস চলছে বলে একটা ছাত্রও বাইরে নাই। গেটের সামনে একা আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক বিদেশি ভদ্রলোক এগিয়ে আসলেন আমার কাছে। এটা রোমান ক্যাথলিকদের পরিচালিত একটি স্কুল। আমাকে ভাঙা বাংলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কি চাও?’ তিনি ভীষণ অবাক হলেন যখন বললাম আমি এখানে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হতে এসেছি। তিনি আরও জানতে চাইলেন বিশেষভাবে এই স্কুল কেন বেছে নিলাম। লঞ্চের তিনজন কলেজ ছাত্রের কথা বললাম যারা আমাকে বলেছে সেন্ট জোসেফস স্কুলই খুলনার সেরা স্কুল। লোহার গেটের দুইপাশে দাঁড়িয়েই এতক্ষণ আলাপ চলছিল। তিনি সেই কলেজ ছাত্রদের মত করেই বললেন যে ভর্তি পরীক্ষা ডিসেম্বর মাসেই শেষ। তিনি আরও জানালেন যে, এই বছর অষ্টম শ্রেণী থেকে এত বেশী ছাত্র রয়ে গেছে যে বাইরে থেকে নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগে কোন ছাত্র নেওয়া হয় নাই। এসব শুনে কিছুটা হতাশ হয়ে আমি শুধু বললাম, ‘আমি এত কিছু তো জানি না। আমি শুধু জানি বিজ্ঞান বিভাগে না পড়লে আমার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া হবে না। আমি যেখানে অষ্টম শ্রেণীতে পড়েছি সেখানে বিজ্ঞান বিভাগ নাই।’ আমার কথা শুনে মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে নিজেই গেট খুলে দিলেন। তখনও তাঁর পরিচয় জানি না। আমাকে তাঁর অফিসে নিয়ে পরিচয় দিলেন তিনিই এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এ জি ব্রুনো। আমার অষ্টম শ্রেণীর মার্কশিট দেখে জানতে চাইলেন, ‘তোমার কাছে কি ভর্তির টাকা আছে?’ তাঁর প্রশ্নটা বুঝতে আমার একটু সময় লেগেছিল। এটা ছিল শুক্রবার। কাছে টাকা নাই শুনে আমাকে সময় দিলেন সোমবার টাকাসহ ভর্তির জন্য তাঁর সাথে দেখা করতে। লঞ্চে করে বাড়ি ফেরার পথে সকালে দেখা হওয়া ছাত্রদের সাথে আবার দেখা। ওরা তামাশা করে জানতে চাইলো আমি ভর্তি হয়েছি কিনা। ওরা কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে চায় না যে আমি ভর্তির টাকা আনতে বাড়িতে যাচ্ছি। এ জি ব্রুনোর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার স্বপ্ন পূরণে সব থেকে বড় সহায়তাকারী তিনি, আমার জীবনের অন্যতম সেরা শিক্ষকও তিনি।
চলবে…