‘টাকার অভাবে রেহানার বিয়েতে যেতে পারিনি’
বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানাকে লন্ডনে একাই বিয়ে করতে হয়েছে বলে জানালেন তার বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, দুটি সন্তান নিয়ে টিকিট কেটে লন্ডনে যাওয়ার মতো টাকা তখন আমার ছিল না। ছেলে-মেয়ে নিয়ে সেখানে কোথায় থাকব, কি খাবÑ এটিই ছিল বড় প্রশ্ন।
গত ৭ জুলাই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিন নারীÑ রুশনারা আলী, রূপা হক ও টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দীক ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সের সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে তাদের ধন্যবাদ জানানোর জন্য আনীত প্রস্তাবের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে এ তথ্য দেন শেখ হাসিনা। এ কথা বলার সময় তার কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে। তার ২০ মিনিটের বক্তব্যের পুরোটাই ছিল আবেগঘন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে চলা অধিবেশনে এ সময় ছিল পিনপতন নীরবতা।
স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার এখনও মনে আছেÑ জন্মের সময় টিউলিপ ছিল ছোট্ট ফুলের কুড়ির মতো। সেই ছোট্ট টিউলিপ এখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। এমপি হওয়ার পর হাউস অব কমন্সে তার বক্তব্য শোনার জন্য লন্ডন গিয়েছিলাম। অল্প সময়ে এত চমৎকার ও সাবলীলভাবে সে বক্তব্য রেখেছিল, দেখে গর্বে আমার বুক ভরে গিয়েছিল। আসলে রক্ত কথা বলে। টিউলিপের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সেটি আবারও প্রমাণ হলো।
তিনি বলেন, ১৯৭৫-এর ৩০ জুলাই রেহানাকে নিয়ে আমি জার্মানিতে যাই। আমি বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী ছিলাম। চেয়েছিলাম রেহানাও সেখানে পড়বে। সেজন্য জার্মানি যাওয়ার আগে আমি নিজে কলেজে গিয়ে রেহানার ফরম পূরণ করে দিই। রেহেনা ফিরে সেখানে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি আর হয়নি। মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে আমরা সব হারালাম। দেশে আসতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু আসতে দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে। নানা ধরনের কথা আর গুজবের ছড়াছড়ি, কেউ কেউ বলল মা আর রাসেল বেঁচে আছে। সঠিক কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। দেশে ফিরে আসার জন্য আমরা ব্যাকুল ছিলাম। ভাবলাম দেশে ফিরলে জানতে পারব কী ঘটেছে। দিল্লিতে যখন নামলাম, সেখানে মিসেস গান্ধীর সাথে দেখা হলো। জার্মানিতে আমরা সেখানে তখনকার রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, তিনিই জানালেন কেউ বেঁচে নেই। সেই খবর সেদিন আমি রেহানাকে জানাতে পারিনি। মিসেস গান্ধী আমাদের দিল্লিতে থাকার ব্যবস্থা করেন।
ঘটনার বর্ণনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি দেশে ফিরতে চাই, আর রেহানা সিদ্ধান্ত নিল সে লন্ডনে যাবে। আমার বাবা সৎ রাজনীতি করেছেন। বিদেশে রেহানার পড়াশোনা করার মতো আর্থিক সংগতি আমাদের ছিল না। রেহানার বিয়ের বিষয়ে জিল্লুর রহমান (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) আগেই প্রস্তাব দিয়ে রেখেছিলেন আইভি চাচীর পরিবারের একজনের সাথে। তখন আমাদের কেউ নেই, কিছু নেই, কোথায় যাব! এই অবস্থা। এ সময় জহুরুল ইসলাম চাচা আমাদের খবর পাঠালেন। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে রেহানা লন্ডনে গিয়ে চাচার বাসায় উঠল। বাবার একজন বন্ধু, যিনি নিজেও নির্বাসিত ছিলেন, তিনি রেহানাকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। এভাবে রেহানা সেখানে থাকল, তার বিয়ে হলো। আমরা সম্পূর্ণ একা, মা-বাবা-ভাইহারা। সে সময় লন্ডনে অনেকেই রেহানার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আবার অনেকে আমাদের খবর নেয়নি।
শেখ রেহানার জীবন সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে বড় বোন বলেন, নিজে চাকরি করে, কত কষ্ট করেছে রেহানা। ’৮২ সালে টিউলিপের জন্ম হয়। আমি তখন পাশে ছিলাম। ছোট্ট টিউলিপ, পড়াশোনা শিখেছে, চাকরিও করেছে। টিউলিপের বাবাও ভালো ছাত্র ছিলেন, রেহানার ছেলেরাও পড়াশোনায় বেশ ভালো। পড়াশোনার সাথে টিউলিপ লেবার পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত হয়। একটা ছোট্ট মেয়ে, কী যে কষ্ট করতে পারেÑ দেখে সত্যিই বিস্মিত হয়ে যাই। সে তার নির্বাচনী এলাকার মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। প্রতিটি ঘরে ঘরে সে যায়।
আমার বাবাও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। রেহানাও প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে ছিল। আমি তিনবার প্রধানমন্ত্রী। অথচ আমার বোন আগে যেমন ছিল, এখনও তেমনই। এখনও সে বাসে চড়ে, বাসে ঝুলে অফিসে যায়। শুধু নিজের ছেলে-মেয়েকে নয়, আমার ছেলে-মেয়েকেও রেহানাই দেখাশোনা করেছে। আমাদের পাঁচ বাচ্চার অভিভাবক রেহানাই ছিল। কত কষ্ট করে যে ওদের মানুষ করেছে!
শেখ হাসিনা বলেন, টিউলিপ যেই আসনে জিতেছে, সেটি লেবার পার্টির আসন নয়। সেখানে এবার ১ হাজার ১০০-এর বেশি ভোটের ব্যবধানে টিউলিপ জিতেছে। তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে থাকা খালেদা জিয়ার ছেলে (তারেক রহমান) সব চেষ্টাই করেছে টিউলিপ যেন জিততে না পারে। বাংলাদেশের একটি মেয়ে নির্বাচন করছে, সেটিও তাদের সহ্য হয় না। কারণ তারা তো বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। তারপরও আমি কৃতজ্ঞতা জানাই প্রবাসী বাঙালিদের প্রতি, তারা টিউলিপের পাশে দাঁড়িয়েছে। কৃতজ্ঞতা জানাই এদেশের মানুষের প্রতি। আমরা তো সব হারিয়েছি। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেই পিতা-মাতা-ভাই-স্বজন হারানোর স্মৃতি ফিরে পেয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। জাতির পিতা আমাদের যে আদর্শ দিয়ে গেছেন, সেই আদর্শেই সন্তানদের মানুষ করেছি। টিউলিপের যে যাত্রা শুরু, জীবনে যেন আরও সাফল্য পায়। তার জীবন যেন সুখী হয়, সবার কাছে সেই দোয়া চাই।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, তিন বঙ্গকন্যার নির্বাচিত হওয়া দেশের জন্যই গৌরবের। এই ব্রিটিশরাই ২০০ বছর আমাদের শাসন করেছিল। কাজেই এই তিন কন্যাই আমাদের গৌরব। তিন কন্যার জন্য দোয়া করি। বঙ্গবন্ধু আমাদের শিখিয়ে গেছেন, ত্যাগ ছাড়া মহৎ কিছু অর্জন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মানুষ উন্নত জীবন পাক, বিজয়ের মুকুট সব সময় বাঙালি জাতির মাথায় শোভিত হোক।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস করতে সবার কাছে অনুরোধ রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।