ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার
লেখক: রুদ্র সাইফুল (অনুবাদ ও শ্রুতিলিখন)
তারিখ: ৩ ডিসেম্বর ২০১৬
(১৯৭২ সালের জানুয়ারি, ঢাকা। ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্টস’-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের শ্রুতিলিখন সন্নিবেশিত হয়। পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ঢাকায় এই সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টেলিভিশনের ‘ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন্ বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকারটি প্রদর্শিত হয়। পুরো সাক্ষাৎকারটির শ্রুতিলিখন এখানে তুলে ধরা হলো।)
ডেভিড ফ্রস্ট: সে রাতের কথা আপনি বলুন। সেই রাত, যে রাতে একদিকে আপনার সঙ্গে যখন চলছিল আলোচনা এবং যখন সেই আলোচনার আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছিল, সেই রাতের কথা বলুন। সেই ২৫শে মার্চ, রাত ৮টা। আপনি আপনার বাড়িতে ছিলেন। সেই বাড়িতেই পাকিস্তান বাহিনী আপনাকে গ্রেফতার করেছিল। আমরা শুনেছিলাম, টেলিফোনে আপনাকে সাবধান করা হয়েছিল, সামরিক বাহিনী অগ্রসর হতে শুরু করেছে। কিন্তু তবু আপনি আপনার বাড়ি পরিত্যাগ করলেন না। আপনি গ্রেফতার হলেন। কেন আপনি নিজের বাড়ি ছেড়ে অপর কোথাও গেলেন না এবং গ্রেফতার বরণ করলেন? কেন এই সিদ্ধান্ত? তার কথা বলুন।
শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যাঁ, সে এক কাহিনি। তা বলা প্রয়োজন। সে সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, তারা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপসের আলোচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে না বেরুনো নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তান বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি জানতাম, আমি আত্মগোপন করলে, ওরা দেশের সমস্ত মানুষকেই হত্যা করবে। এক হত্যাযজ্ঞ ওরা সমাধা করবে। আমি স্থির করলাম, আমি মরি, তাও ভালো তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।
ফ্রস্ট: আপনি হয়তো কলকাতা চলে যেতে পারতেন।
শেখ মুজিব: আমি ইচ্ছা করলে যে কোনো জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা। আমি সংগ্রাম করব। মৃত্যুবরণ করব। পালিয়ে কেন যাব? দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান ছিল, তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোল।
ফ্রস্ট: আপনার সিদ্ধান্ত অবশ্যই সঠিক ছিল। কারণ এ ঘটনাই বিগত ন’মাস ধরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আপনাকে তাদের একটি বিশ্বাসের প্রতীকে পরিণত করেছে। আপনি তো এখন তাদের কাছে প্রায় ঈশ্বরবৎ।
শেখ মুজিব: আমি তা বলিনে। কিন্তু এ কথা সত্য, তারা আমাকে ভালোবাসে। আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছিলাম। আমি তাদের জীবনকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হানাদার বর্বর বাহিনী আমাকে সে রাতে আমার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করল। ওরা আমার নিজের বাড়ি ধ্বংস করে দিল। আমার গ্রামের বাড়ি, যেখানে ৯০ বছরের বৃদ্ধ পিতা এবং ৮০ বছরের বৃদ্ধা জননী ছিলেন, গ্রামের সে বাড়িও ধ্বংস করে দিল। ওরা গ্রামে ফৌজ পাঠিয়ে আমার বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে তাদের চোখের সামনে সে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। বাবা-মার আর কোনো আশ্রয় রইল না। ওরা সব কিছুই জ্বালিয়ে দিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে পেলে ওরা আমার হতভাগ্য মানুষদের হত্যা করবে না। কিন্তু আমি জানতাম, আমাদের সংগঠনের শক্তি আছে। আমি একটি শক্তিশালী সংগঠনকে জীবনব্যাপী গড়ে তুলেছিলাম। জনগণ তার ভিত্তি। আমি জানতাম, তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রতি ইঞ্চিতে তোমরা লড়াই করবে। আমি বলেছিলাম, হয়তো এটাই আমার শেষ নির্দেশ। কিন্তু মুক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত তাদের লড়াই করতে হবে। লড়াই তাদের চালিয়ে যেতে হবে।
ফ্রস্ট: আপনাকে ওরা ঠিক কী ভাবে গ্রেফতার করেছিল? তখন তো রাত ১-৩০ ছিল? তাই নয় কি? তখন কী ঘটল?
শেখ মুজিব: ওরা প্রথমে আমার বাড়ির ওপর মেশিনগানের গুলি চালিয়েছিল।
ফ্রস্ট: ওরা যখন এলো, তখন আপনি বাড়ির কোনখানটাতে ছিলেন?
শেখ মুজিব: এই যেটা দেখছেন, এটা আমার শোবার ঘর। আমি এই শোবার ঘরেই তখন বসেছিলাম। এদিক থেকে ওরা মেশিনগান চালাতে আরম্ভ করে। তারপরে এদিক, ওদিক সব দিক থেকে গুলি ছুড়তে আরম্ভ করে। জানালার ওপর গুলি চালায়।
ফ্রস্ট: এগুলো সব তখন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, সব ধ্বংস করেছিল। আমি তখন আমার পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে ছিলাম। একটা গুলি আমার শোবার ঘরে এসে পড়ে। আমার ছ’বছরের ছোট ছেলেটি বিছানার ওপর তখন শোয়া ছিল। আমার স্ত্রী এই শোবার ঘরে দুটি সন্তানকে নিয়ে বসেছিলেন।
ফ্রস্ট: পাকিস্তান বাহিনী কোন দিক দিয়ে ঢুকেছিল?
শেখ মুজিব: সব দিক দিয়ে। ওরা এবার জানালার মধ্যদিয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে। আমি আমার স্ত্রীকে দুটি সন্তানকে নিয়ে বসে থাকতে বলি। তারপর তার কাছ থেকে উঠে আমি বাইরে বেরিয়ে আসি।
ফ্রস্ট: আপনার স্ত্রী কিছু বলেছিলেন?
শেখ মুজিব: না, কোনো শব্দ উচ্চারণের তখন অবস্থা নয়। আমি শুধু তাকে একটি বিদায় সম্বোধন জানিয়েছিলাম। আমি দুয়ার খুলে বাইরে ওদের গুলি বন্ধ করতে বলেছিলাম। আমি বললাম, ‘তোমরা গুলি বন্ধ কর। আমি তো এখানে দাঁড়িয়ে আছি। তোমরা গুলি করছো কেন? কী তোমরা চাও?’ তখন চারদিক থেকে ওরা আমার দিকে ছুটে এলো, বেয়নেট উদ্যত করে। ওদের একটা অফিসার আমাকে ধরল। ওই অফিসারই বলল, ‘এই! ওকে মেরে ফেল না।’
ফ্রস্ট: একটা অফিসারই ওদের থামিয়েছিল?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, ওই অফিসারটি থামিয়েছিল। ওরা তখন আমাকে এখান থেকে টেনে নামাল। ওরা পেছন থেকে আমার গায়ে, পায়ে বন্দুকের কুদো দিয়ে মারতে লাগল। অফিসারটা আমাকে ধরেছিল। তবু ওরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে টেনে নামাতে লাগল। আমি বললাম, ‘তোমরা আমাকে টানছ কেন? আমি তো যাচ্ছি।’ আমি বললাম, ‘আমার তামাকের পাইপটা নিতে দাও।’ ওরা একটু থামল। আমি ওপরে গিয়ে আমার তামাকের পাইপটা নিয়ে এলাম। আমার স্ত্রী তখন দুটি ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাকে কিছু কাপড়-চোপড়সহ একটি ছোট স্যুটকেস দিলেন। তাই নিয়ে আমি নেমে এলাম। চারদিকে তখন আগুন জ্বলছিল। আজ এই যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এখান থেকে ওরা আমায় নিয়ে গেল।
ফ্রস্ট: আপনার ৩২নং ধানমন্ডি বাড়ি থেকে সেদিন যখন আপনি বেরিয়ে এলেন, তখন কি ভেবেছিলেন, আর কোনোদিন এখানে ফিরে আসতে পারবেন?
শেখ মুজিব: না, আমি তা কল্পনা করতে পারি নি। আমি ভেবেছি, এই-ই শেষ। কিন্তু আমার মনের কথা ছিল, আজ আমি যদি আমার দেশের নেতা হিসেবে মাথা উঁচু রেখে মরতে পারি, তা হলে আমার দেশের মানুষের অন্তত লজ্জার কোনো কারণ থাকবে না। কিন্তু আমি ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে, আমার দেশবাসী পৃথিবীর সামনে আর মুখ তুলে তাকাতে পারবে না। আমি মরি, তা-ও ভালো। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার কোনো হানি না ঘটে।
ফ্রস্ট: শেখ সাহেব, আপনি একবার বলেছিলেন, ‘যে মানুষ মরতে রাজি, তুমি তাকে মারতে পার না।’ কথাটি কি এমনই ছিল না?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সে তো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না, তা কেউ পারে না।
এটাই আমার বিশ্বাস। আমি একজন মুসলমান। এবং একজন মুসলমান একবারই মাত্র মরে, দু’বার নয়। আমি মানুষ। আমি মনুষ্যত্বকে ভালোবাসি। আমি আমার জাতির নেতা। আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আজ তাদের কাছে আমার আর কিছু দাবি নেই। তারা আমাকে ভালোবেসেছে। সব কিছু বিসর্জন দিয়েছে। কারণ, আমি আমার সব কিছুকে তাদের জন্য দিবার অঙ্গীকার করেছি। আজ আমি তাদের মুখে হাসি দেখতে চাই। আমি যখন আমার প্রতি আমার দেশবাসীর স্নেহ-ভালোবাসার কথা ভাবি, তখন আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই।
ফ্রস্ট: পাকিস্তান বাহিনী আপনার বাড়ির সব কিছুই লুট করে নিয়েছিল?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, আমার সব কিছুই ওরা লুট করেছে। আমার ঘরের বিছানাপত্র, আলমারী, কাপড়-চোপড় সব কিছুই লুণ্ঠিত হয়েছে। মিস্টার ফ্রস্ট, আপনি দেখতে পাচ্ছেন, এ বাড়ির কোনো কিছুই আজ নেই।
ফ্রস্ট: আপনার বাড়ি যখন মেরামত হয়, তখন এসব জিনিস লুণ্ঠিত হয়েছে, না পাকিস্তানিরা সব লুণ্ঠন করেছে?
শেখ মুজিব: পাকিস্তানি ফৌজ আমার সব কিছু লুণ্ঠন করেছে। কিন্তু এই বর্বর বাহিনী আমার আসবাবপত্র, কাপড়-চোপড়, আমার সন্তানদের দ্রব্যসামগ্রী লুণ্ঠন করেছে, তাতে আমার দুঃখ নেই। আমার দুঃখ, ওরা আমার জীবনের ইতিহাসকে লুণ্ঠন করেছে। আমার ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের দিনলিপি ছিল। আমার একটি সুন্দর লাইব্রেরি ছিল। বর্বররা আমার প্রত্যেকটি বই আর মূল্যবান দলিলপত্র লুণ্ঠন করেছে। সব কিছুই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়ে গেছে।
ফ্রস্ট: তাই আবার সেই প্রশ্নটা আমাদের সামনে আসে কেন ওরা সব কিছু লুণ্ঠন করল?
শেখ মুজিব: এর কী জবাব দেব? আসলে ওরা মানুষ নয়। কতগুলো ঠগ, দস্যু, উন্মাদ, অমানুষ আর সভ্য জানোয়ার। আমার নিজের কথা ছেড়ে দিন। তা নিয়ে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন, ২ বছর ৫ বছরের শিশু, মেয়েরা কেউ রেহাই পেল না। সব নিরীহ মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। আমি আপনাকে দেখিয়েছি সব জ্বালিয়ে দেয়া, পোড়া বাড়ি, বস্তি। একেবারে গরিব, না-খাওয়া মানুষ সব বাস করত এই বস্তিতে। বস্তির মানুষ জীবন নিয়ে পালাতে চেয়েছে। আর সেইসব মানুষের ওপর চারদিক থেকে মেশিনগান চালিয়ে হাজার হাজার হত্যা করা হয়েছে।
ফ্রস্ট: কী আশ্চর্য! আপনি বলেছেন, ওদের ঘরে আগুন দিয়ে ঘর থেকে বার করে, খোলা জায়গায় পলায়মান মানুষকে মেশিনগান চালিয়ে হত্যা করেছে?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, এমনিভাবে গুলি করে তাদের হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট: কোন্ মানুষকে মারল, তার কোনো পরোয়া করল না?
শেখ মুজিব: না, তার বিন্দুমাত্র পরোয়া করেনি।
ফ্রস্ট: কেবল হত্যার জন্য হত্যা যাকে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। ওরা ভেবেছে প্রত্যেকেই শেখ মুজিবের মানুষ। তাই প্রত্যেককেই হত্যা করতে হবে।
ফ্রস্ট: আপনি যখন দেখেন, মানুষ মানুষকে এমনিভাবে হত্যা করছে, তখন আপনার কী মনে হয়? আপনি কি মনে করেন, মানুষ আসলে ভালো? কিংবা মনে করেন মানুষ আসলেই খারাপ?
শেখ মুজিব: ভালো-মন্দ সর্বত্রই আছে। মনুষ্যত্ব আছে, এমন মানুষও আমি দেখেছি। কিন্তু আমি মনে করি, পশ্চিম পাকিস্তানের এই ফৌজ এগুলো মানুষ নয়। এগুলো পশুরও অধম। মানুষের যে পাশবিক চরিত্র না থাকতে পারে, তা নয়। কিন্তু যে মানুষ, সে পশুর অধম হয় কী প্রকারে? কিন্তু এই বাহিনী তো পশুরও অধম। কারণ একটা পশু আক্রান্ত হলেই মাত্র আক্রমণ করে। তা নইলে নয়। পশু যদি মানুষকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে, তবু সে তাকে অত্যাচার করে না। কিন্তু এই বর্বরের দল আমার দেশবাসীকে কেবল হত্যা করে নি। দিনের পর দিন বন্দি মানুষকে অত্যাচার করেছে। ৫ দিন, ৭ দিন, ১৫ দিন নির্মম অত্যাচার করেছে, আর হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট: পাকিস্তানে বন্দি থাকাকালে ওরা আপনার বিচার করেছিল। সেই বিচার সম্পর্কে কিছু বলুন।
শেখ মুজিব: ওরা একটা কোর্ট মার্শাল তৈরি করেছিল। তাতে পাঁচজন ছিল সামরিক অফিসার। বাকি কয়েকজন বেসামরিক অফিসার।
ফ্রস্ট: আপনার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনল ওরা?
শেখ মুজিব: অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহিতা, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র আরও কত কী!
ফ্রস্ট: আপনার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন? আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো উপায় ছিল?
শেখ মুজিব: সরকারের তরফ থেকে গোড়ায় এক উকিল দিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন দেখলাম, অবস্থাটা এম্নি যে, যুক্তির কোনো দাম নেই; দেখলাম, এ হচ্ছে বিচারের এক প্রহসন মাত্র, তখন আমি কোর্টে নিজে দাঁড়িয়ে বললাম, জনাব বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবদের যেতে বলুন। আপনারা বিলক্ষণ জানেন, এ হচ্ছে এক গোপন বিচার। আমি বেসামরিক লোক। আমি সামরিক কোনো লোক নই। আর এরা করছে আমার কোর্ট মার্শাল। ইয়াহিয়া খান কেবল যে প্রেসিডেন্ট, তা-ই নয়। তিনি প্রধান সামরিক শাসকও। এ বিচারের রায়কে অনুমোদনের কর্তা তিনি। এই আদালতকে গঠন করেছেন তিনি।
ফ্রস্ট: তার মানে, তার হাতেই ছিল সব?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, সে ছিল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তার ইচ্ছাই ইচ্ছা।
ফ্রস্ট: তার মানে, আপনি আদালতে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন?
শেখ মুজিব: তার তো কোনো উপায় ছিল না। আমি তো বন্দি।
ফ্রস্ট: হ্যাঁ, তা তো বটেই। আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার তো কোনো উপায় ছিল না। ওরা কি বিচার শেষ করে, সরকারিভাবে কোনো রায় তৈরি করেছিল?
শেখ মুজিব: ৪ঠা ডিসেম্বর (’৭১) ওরা আদালতের কাজ শেষ করে। সাথে সাথে ইয়াহিয়া খান সব বিচারক, যথা লেফটেন্যান্ট, কর্নেল, বিগ্রেডিয়ার এদের সব রাওয়ালপিন্ডি ডেকে পাঠাল রায় তৈরি করার জন্য। সেখানে ঠিক করল, ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে।
ফ্রস্ট: আর তাই সেলের পাশে কবর খোঁড়া দেখে আপনি বুঝতে পেরেছিলেন, ওরা ওখানেই আপনাকে কবর দিবে?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, আমার সেলের পাশেই ওরা কবর খুঁড়ল। আমার চোখের সামনে।
ফ্রস্ট: আপনি নিজের চোখে তাই দেখলেন?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, আমি নিজের চোখে দেখলাম ওরা কবর খুঁড়ছে। আমি নিজের কাছে নিজে বললাম, ‘আমি জানি, এ কবর আমার কবর। ঠিক আছে। কোনো পরোয়া নেই। আমি তৈরি আছি।’
ফ্রস্ট: ওরা কি আপনাকে বলেছিল, ‘এ তো তোমার কবর?’
শেখ মুজিব: না, ওরা তা বলেনি।
ফ্রস্ট: কী বলেছিল ওরা?
শেখ মুজিব: ওরা বলল, ‘না, না। তোমার কবর নয়। ধর যদি বোম্বিং হয়, তা হলে তুমি এখানে শেলটার নিতে পারবে।’
ফ্রস্ট: সেই সময়ে আপনার মনের চিন্তা কী ছিল? আপনি কি এই সারাটা সময়, ন’মাস নিজের মৃত্যুর কথা চিন্তা করেছেন?
শেখ মুজিব: আমি জানতাম, যে কোনো দিন ওরা আমায় শেষ করে দিতে পারে। কারণ, ওরা অসভ্য, বর্বর।
ফ্রস্ট: এমন অবস্থায় আপনার কেমন করে কাটত? আপনি কি প্রার্থনা করতেন?
শেখ মুজিব: এমন অবস্থায় আমার নির্ভর ছিল আমার বিশ্বাস, আমার নীতি, আমার পৌনে আট কোটি মানুষের প্রতি আমার বিশ্বাস। তারা আমায় ভালোবেসেছে ভাইয়ের মতো, পিতার মতো। আমাকে তাদের নেতা বানিয়েছে।
ফ্রস্ট: আপনি যখন দেখলেন, ওরা কবর খনন করেছে, তখন আপনার মনে কার কথা আগে জাগল? আপনার দেশের কথা? না, আপনার স্ত্রী-পুত্র পরিজনের কথা?
শেখ মুজিব: আমার প্রথম চিন্তা আমার দেশের জন্য। আমার আত্মীয়-স্বজনদের চাইতেও আমার ভালোবাসা আমার দেশের জন্য। আমার যা কিছু দুঃখ ভোগ, সে তো আমার দেশেরই জন্য। আপনি তো দেখেছেন, আমাকে তারা কী গভীরভাবে ভালোবাসে।
ফ্রস্ট: হ্যাঁ, এ কথা আমি বুঝি। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত বাংলাদেশের আপনি নেতা। আপনার প্রথম চিন্তা অবশ্যই আপনার দেশের চিন্তা। পারিবারিক চিন্তা পরের চিন্তা।
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, জনতার প্রতিই আমার প্রথম ভালোবাসা। আমি তো জানি, আমি অমর নই। আজ কিংবা কাল, কিংবা পরশু আমাকে মরতে হবে। মানুষ মাত্রই মরতে হয়। কাজেই আমার বিশ্বাস, মানুষ মৃত্যুবরণ করবে সাহসের সঙ্গে।
ফ্রস্ট: কিন্তু ওরা তো আপনাকে কবর দিতে পারে নি। কে আপনাকে রক্ষা করেছিল সেদিন আপনার ভবিতব্য থেকে?
শেখ মুজিব: আমার বিশ্বাস সর্বশক্তিমান আল্লাহই আমাকে রক্ষা করেছেন।
ফ্রস্ট: আমি একটা বিবরণে দেখলাম, আপনাকে নাকি জেইলার একসময়ে সরিয়ে রেখেছিল। ইয়াহিয়া খান যখন আপনাকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিল তখন আপনাকে স্থানান্তরে নিয়ে গিয়েছিল। এ কি যথার্থ?
শেখ মুজিব: ওরা জেলখানায় একটা অবস্থা তৈরি করেছিল মনে হচ্ছিল, কতগুলো কয়েদীকে ওরা সংগঠিত করেছিল যেন সকালের দিকে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা আমাকে হত্যা করে ফেলতে পারে। আমার মনে হয়, আমাকে তত্ত্বাবধানের ভার যে অফিসারের ওপর পড়েছিল, আমার প্রতি তার কিছুটা সহানুভূতি জেগেছিল। হয়তো বা সে অফিসার এমনও বুঝতে পেরেছিল যে, ইয়াহিয়া খানের দিন শেষ হয়ে আসছে। আমি দেখলাম, হঠাৎ রাত ৩টার সময়ে সে এসে আমাকে সেল থেকে সরিয়ে নিয়ে তার নিজের বাংলাতে দু’দিন যাবৎ রক্ষা করল। এ দু’দিন আমার ওপর কোনো সামরিক পাহারা ছিল না। দু’দিন পরে এই অফিসার আমাকে আবার একটা আবাসিক কলোনির নির্জন এলাকায় সরিয়ে নিল। সেখানে আমাকে হয়তো চার-পাঁচ কিংবা ছ’দিন রাখা হয়েছিল। এই সময়টাতে আমার অবস্থান সম্পর্কে নিম্নপদস্থ কিছু অফিসার বাদে আর কেউ জ্ঞাত ছিল না।
ফ্রস্ট: এ তাদের সাহসেরই কাজ। এখন তাদের কী হয়েছে, তাই ভাবছি।
শেখ মুজিব: আমিও জানিনে। ওদের ওপর কোনো আঘাত হানতে ওরা পারবে বলে মনে হয় না। ওদের জন্য যথার্থ শুভ কামনা রয়েছে।
ফ্রস্ট: এমন কি শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়, তখনো না কি সে ভুট্টোর কাছে আপনার ফাঁসির কথা বলেছিল? এটা কি ঠিক?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, ঠিক। ভুট্টো আমাকে সে কাহিনিটা বলেছিল। ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেবার সময়ে ইয়াহিয়া বলেছিল, ‘মিস্টার ভুট্টো, আমার জীবনের সব চাইতে বড় ভুল হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি না দেয়া।’
ফ্রস্ট: ইয়াহিয়া এমন কথা বলেছিল!
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, ভুট্টো এ কথা আমায় বলে তার পরে বলেছিল, ‘ইয়াহিয়ার দাবি ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে সে পেছনের তারিখ দিয়ে আমাকে ফাঁসি দিবে।’ কিন্তু ভুট্টো তার এ প্রস্তাবে রাজি হয় নি।
ফ্রস্ট: ভুট্টো কী জবাব দিয়েছিল? তার জবাবের কথা কি ভুট্টো আপনাকে কিছু বলেছিল?
শেখ মুজিব: ভুট্টো, ইয়াহিয়াকে বলেছিল: ‘না, আমি তা হতে দিতে পারিনে। তা হলে তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটবে। বাংলাদেশে এখন আমাদের এক লাখ তিন হাজার সামরিক বাহিনীর লোক আর বেসামরিক লোক বাংলাদেশ আর ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দি রয়েছে। তা ছাড়া পাঁচ থেকে দশ লাখ অবাঙালি বাংলাদেশে আছে। মিস্টার ইয়াহিয়া, এমন অবস্থায় আপনি যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি, তা হলে একটি লোকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত আসতে সক্ষম হবে না। তার প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও ঘটবে। তখন আমার অবস্থা হবে সংকটজনক।’ ভুট্টো এ কথা আমাকে বলেছিল। ভুট্টোর নিকট আমি অবশ্যই এ জন্য কৃতজ্ঞ।
ফ্রস্ট: শেখ সাহেব, আজ যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ ঘটে, আপনি তা হলে তাকে কী বলবেন?
শেখ মুজিব: ইয়াহিয়া খান একটা জঘন্য খুনি। তার ছবি দেখতেও আমি রাজি নই। তার বর্বর ফৌজ দিয়ে সে আমার ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট: ভুট্টো এখন তাকে গৃহবন্দি করেছে। ভুট্টো তাকে নিয়ে এখন কী করবে? আপনার কী মনে হয়?
শেখ মুজিব: মিস্টার ফ্রস্ট, আপনি জানেন, আমার বাংলাদেশে কী ঘটেছে? শিশু, মেয়ে, বুদ্ধিজীবী, কৃষক শ্রমিক ছাত্র সকলকে ওরা হত্যা করেছে। ৩০ লাখ বাঙালিকে ওরা হত্যা করেছে। অন্ততপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ঘরবাড়ি ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং তারপর সব কিছুকে ওরা লুট করেছে। খাদ্যের গুদামগুলিকে ওরা ধ্বংস করেছে।
ফ্রস্ট: নিহতদের সংখ্যা ৩০ লাখ, এ কথা আপনি সঠিকভাবে জানেন?
শেখ মুজিব: আমার লোকজন তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে। এখনও আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসি নি। সংখ্যা হয়তো একেও ছাড়িয়ে যাবে। ত্রিশ লক্ষের কম তো নয়ই।
ফ্রস্ট: কিন্তু এমন হত্যাকাণ্ড তো নিরর্থক। মানুষকে ঘর থেকে টেনে এনে এনে হত্যা করা।
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, কাদের ওরা হত্যা করেছে? একেবারে নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষকে। গ্রামের মানুষকে যে গ্রামের মানুষ পৃথিবীর কথাই হয়তো কিছু জানত না, সে গ্রামে পাকিস্তানি ফৌজ ঢুকে পাখি মারার মতো গুলি করে এই মানুষকে ওরা হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট: আমার মনেও প্রশ্ন, আহা! কেন এমন হলো?
শেখ মুজিব: না, আমিও জানিনে। আমিও বুঝিনে। এ রকম পৃথিবীতে আর ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।
ফ্রস্ট: আর এ তো ছিল মুসলমানের হাতেই মুসলমানের হত্যা?
শেখ মুজিব: ওরা নিজেরা নিজেদের মুসলমান বলে। অথচ ওরা হত্যা করেছে মুসলমান মেয়েদের। আমরা অনেককে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। আমাদের ত্রাণশিবিরে এখনও অনেকে রয়েছে। এদের স্বামী, পিতা সকলকে হত্যা করা হয়েছে। মা আর বাবার সামনে ওরা মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। পুত্রের সামনে মাকে ধর্ষণ করেছে। আপনি চিন্তা করুন। আমি এ কথা চিন্তা করে চোখের অশ্রুকে রোধ করতে পারিনে। এরা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করে কিভাবে? এরা তো পশুরও অধম। মনে করুন আমার বন্ধু মশিউর রহমানের কথা। আমাদের দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন তিনি। আমাদের সরকারের একজন প্রাক্তন মন্ত্রী ছিলেন তিনি। তাকে নির্যাতন করে করে হত্যা করা হয়েছে। ২৪ দিন ধরে তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। প্রথমে তার এক হাত কেটেছে। তারপরে তার আর একটা হাত কেটেছে। তারপরে তার একটা কানকে কেটেছে। তার পা কেটেছে। ২৪ দিনব্যাপী চলেছে এমন নির্যাতন (শেখ মুজিব কান্নায় ভেঙে পড়েন) কিন্তু এ তো একটা কাহিনি। আমাদের কত নেতা আর কর্মীকে, বুদ্ধিজীবী আর সরকারি কর্মচারীকে, জেলখানায় আটক করে সেখানে থেকে নিয়ে দিনের পর দিন অত্যাচার করে হত্যা করেছে। এমন অমানুষিক নির্যাতনের কাহিনী আমি ইতিহাসে কোথাও শুনি নি। একটা পশু, একটা বাঘও তো মানুষকে হত্যা করলে এমনভাবে হত্যা করে না।
ফ্রস্ট: ওরা কী চেয়েছিল?
শেখ মুজিব: ওরা চেয়েছিল, আমাদের এই বাংলাদেশকে একেবারে উপনিবেশ করে রাখতে। আপনি তো জানেন, মিস্টার ফ্রস্ট, ওরা বাঙালি পুলিশ বাহিনীর লোককে, বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে। ওরা বাঙালি শিক্ষক, অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ার, বাঙালি ডাক্তার, যুবক, ছাত্র সবাইকে হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট: আমি শুনেছি, যুদ্ধের শেষ অবস্থাতেও ঢাকাতে ওরা ১৩০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে।
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, সারেন্ডারের মাত্র একদিন আগে। কেবল ঢাকাতেই ১৩০ নয়, ৩০০ মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে, মেডিকেল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে। কারফিউ দিয়ে মানুষকে বাড়ির মধ্যে আটক করেছে। আর তারপর বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে এইসব মানুষকে হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট: তার মানে, কারফিউ জারি করে সকল খবরাখবর বন্ধ করে হত্যা করেছে।
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, তাই করেছে।
ফ্রস্ট: শেখ সাহেব, আপনার কী মনে হয়? ইয়াহিয়া খান কি দুর্বল চরিত্রের লোক, যাকে অন্য লোকে খারাপ করেছে, না, সে নিজেই একটা দস্তুরমত খারাপ লোক?
শেখ মুজিব: আমি মনে করি, ও নিজেই একটা নরাধম। ও একটা সাংঘাতিক লোক। ইয়াহিয়া খান যখন প্রেসিডেন্ট, তখন আমার জনসাধারণের নেতা হিসেবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনার সময়েই আমি দেখেছি…।
ফ্রস্ট: আমাদের আজকের এই আলাপে আপনি নেতা এবং নেতৃত্বের কথা তুলেছেন। যথার্থ নেতৃত্বের আপনি কী সংজ্ঞা দিবেন?
শেখ মুজিব: আমি বলব, যথার্থ নেতৃত্ব আসে সংগ্রামের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কেউ আকস্মিকভাবে একদিনে নেতা হতে পারে না। তাকে সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আসতে হবে। তাকে মানুষের মঙ্গলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। নেতার আদর্শ থাকতে হবে, নীতি থাকতে হবে। এই সব গুণ যার থাকে, সেই মাত্র নেতা হতে পারে।
ফ্রস্ট: ইতিহাসের কোন নেতাদের আপনি স্মরণ করেন, তাদের প্রশংসা করেন?
শেখ মুজিব: অনেকেই স্মরণীয়। বর্তমানের নেতাদের কথা বলছিলেন…।
ফ্রস্ট: না, বর্তমানের নয়। কিন্তু ইতিহাসের কারা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছেন?
শেখ মুজিব: আমি আব্রাহাম লিংকনকে স্মরণ করি। স্মরণ করি মাও সে-তুং, লেনিন, চার্চিলকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট জন কেনেডিকেও আমি শ্রদ্ধা করতাম…।
ফ্রস্ট: মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
শেখ মুজিব: মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জহরলাল নেহরু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, কামাল আতাতুর্ক এদের জন্য আমার মনে গভীর শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। আমি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামী নেতা ড. সুকর্ণকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতাম। এই সকল নেতাই তো সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নেতা হয়েছিলেন।
ফ্রস্ট: আজ এই মুহূর্তে অতীতের দিকে তাকিয়ে আপনি কোন দিনটিকে আপনার জীবনের সব চাইতে সুখের দিন বলে গণ্য করবেন? কোন মুহূর্তটি আপনাকে সব চাইতে সুখি করেছিল?
শেখ মুজিব: আমি যেদিন শুনলাম, আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সে দিনটিই ছিল আমার জীবনের সব চাইতে সুখের দিন।
ফ্রস্ট: আপনার জীবনের সব চাইতে সুখের দিন?
শেখ মুজিব: সমগ্র জীবনের সব চাইতে সুখের দিন।
ফ্রস্ট: এমন দিনের স্বপ্ন আপনি কবে থেকে দেখতে শুরু করেন?
শেখ মুজিব: বহুদিন যাবত আমি এই স্বপ্ন দেখে আসছি।
ফ্রস্ট: স্বাধীনতার সংগ্রামে আপনি কবে প্রথম কারাগারে যান?
শেখ মুজিব: আমার জেল গমন শুরু হয়, বোধহয়, সেই ১৯৪৮ সনে। আমি তারপরে ১৯৪৯ সনে গ্রেফতার হয়ে জেলে যাই এবং ১৯৫২ সাল পর্যন্ত জেলে থাকি। ১৯৫৪ সালে আমি একজন মন্ত্রী হই। আবার ১৯৫৪ সালেই গ্রেফতার হই এবং ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত জেলে থাকি। আবার ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান আমাকে জেলে পাঠায় এবং তখন পাঁচ বছর অন্তরীণ থাকি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ নানা মামলায় আমাকে সরকার পক্ষ বিচার করেছে। ১৯৬৬ সালে আবার আমাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তিন বছর যাবৎ আটক রাখা হয়। তারপর আবার ইয়াহিয়া খান গ্রেফতার করে। এমন দীর্ঘ সংগ্রাম কেবল ব্যক্তিগতভাবে আমার নয়। আমার বহু সহকর্মীর জীবনই এই ইতিহাস…।
ফ্রস্ট: মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, পৃথিবীর মানুষের জন্য কী বাণী আমি আপনার কাছ থেকে বহন করে নিয়ে যেতে পারি?
শেখ মুজিব: আমার একমাত্র প্রার্থনা বিশ্ব আমার দেশের মানুষের সাহায্যে অগ্রসর হয়ে আসুক। আমার হতভাগ্য স্বদেশবাসীর পাশে এসে বিশ্বের মানুষ দাঁড়াক। আমার দেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য যেমন দুঃখ ভোগ করেছে, এমন আত্মত্যাগ পৃথিবীর খুব কম দেশের মানুষকেই করতে হয়েছে। মিস্টার ফ্রস্ট, আপনাকে আমি আমার একজন বন্ধু বলে গণ্য করি। আমি আপনাকে বলেছিলাম, আপনি আসুন। নিজের চোখে দেখুন। আপনি নিজের চোখে অনেক দৃশ্য দেখেছেন। আরও দেখুন। আপনি আমার এই বাণী বহন করুন সকলের জন্যই আমার শুভেচ্ছা। আমি বিশ্বাস করি, আমার দেশের কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে এসে বিশ্ব দাঁড়াবে। আপনি আমার দেশের বন্ধু। আপনাকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ্ আপনার মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।
ফ্রস্ট: জয় বাংলা! আমিও বিশ্বাস করি, বিশ্ববাসী আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। আপনাদের পাশে এসে আমাদের দাঁড়াতে হবে। নয়তো ঈশ্বর আমাদের কোনো দিন ক্ষমা করবেন না।
অনুবাদ ও শ্রুতিলিখন : রুদ্র সাইফুল