তারেকের ৭ বছর জেল : ২০ কোটি টাকা জরিমানা
মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদ- দিলেন হাইকোর্ট। সেই সাথে তাকে ২০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাত বছরের কারাদ- বহাল রাখা হয়েছে। তবে বিচারিক আদালতে মামুনকে দেওয়া ৪০ কোটি টাকার জরিমানা কমিয়ে ২০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আপিল মঞ্জুর ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের আপিল খারিজ করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, দুঃখের সাথে দেখা যায়, তারেক রহমান এমন একটি রাজনৈতিক শ্রেণির সদস্য, যাদের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে দিক-নির্দেশনা দেওয়া, অথচ তিনি সচেতনভাবে একটি আর্থিক অপরাধের সাথে যুক্ত। তিনি তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে পরামর্শ মাশুলের নামে নোংরা অর্থ অর্জন করেছেন। আর এতে তার সহযোগী ছিলেন গিয়াসউদ্দিন আল মামুন। এ ধরনের রাজনৈতিক প্রভাবপুষ্ট দুর্নীতি দেশের সুশাসন, টেকসই উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য হুমকি।
রায়ে হাইকোর্ট আরও বলেন, যেহেতু তারেক রহমান এখন পলাতক, তাই তিনি গ্রেফতার হওয়ার বা আত্মসমর্পণ করার পর দ- কার্যকর হবে। এ জন্য তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারির জন্য বিচারিক আদালতকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ২০০৭ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে কারাগারে আছেন। তিনি তারেক রহমানের বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার।
২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এর বিচারক মোতাহার হোসেন তারেক রহমানকে বেকসুর খালাসের রায় দেওয়ার পর অবসরে যান। এরপর ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। তিনি আর দেশে ফিরে আসেন নি। দুদক তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
গত ২১ জুলাই রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট জোরালোভাবে মত প্রকাশ করে বলেন, দুর্নীতি চর্চা ও রাজনৈতিক প্রভাব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে মানি লন্ডারিংয়ের মতো আর্থিক অপরাধ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এতে গোটা সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। রাজনৈতিক ঢাল ব্যবহার করে সম্পদ অর্জনের অবৈধ পন্থা ও আর্থিক অপরাধ বেড়ে চলেছে। আদালত মনে করেন, দেশের কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এই ধরনের অপরাধ বন্ধ করার এখন সময় এসেছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির অভিযোগে ১৩০টি মামলা রয়েছে। এই প্রথম কোনো মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হলেন। এর আগে তার ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকো মানি লন্ডারিংয়ের আরেকটি মামলায় দ-িত হয়েছিলেন। দ-িত অবস্থায় বিদেশে থাকাকালে গত বছর তিনি মারা যান।
এই মামলার বিচার করতে গিয়ে মানি লন্ডারিংয়ের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকায় আরও চারজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তারা হলেনÑ হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, নির্মাণ কনস্ট্রাকশনের চেয়ারম্যান খাদিজা ইসলাম এবং দুই বিদেশি মায়ের সাইরি ও মেরিনা জামান। রায়ে বলা হয়, তারাও এই মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়ার অংশ ছিলেন এবং পাচার করা অর্থ পেতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করেছিলেন।
ঘুষের টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার : ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর তারেক ও মামুনকে আসামি করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলাটি করে দুদক। মামলায় অভিযোগ করা হয়, টঙ্গীতে প্রস্তাবিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ নির্মাণ কনস্ট্রাকশন্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন মামুন। ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ওই টাকা বিভিন্ন পদ্ধতিতে সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকে মামুনের ব্যাংক হিসাবে পাচার করা হয়। ওই টাকার মধ্যে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা উত্তোলন করে খরচ করেন তারেক রহমান।
২০১১ সালের ৬ জুলাই এই মামলার বিচার শুরু হয়। রায় হয় ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর। রায়ে তারেক রহমানকে খালাস এবং গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে সাত বছর কারাদ- এবং ৪০ কোটি টাকা অর্থদ- দেওয়া হয়।
পরে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তারেক রহমানের খালাসের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন করে দুদক। ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি হাইকোর্ট দুদকের আপিল গ্রহণ করে তারেককে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। লন্ডন প্রবাসী তারেক না ফেরায় আদালত তার বিরুদ্ধে সমন জারি করে তার লন্ডনের ঠিকানায় পাঠান। কিন্তু তাতেও তারেক রহমান সাড়া দেননি। পরে তাকে পলাতক ঘোষণা করেন আদালত। এরপর দুদকের করা আপিলের সাথে কারাদ-ের বিরুদ্ধে মামুনের করা আপিল একই সাথে শুনানি শুরু হয়। গত ৪ মে হাইকোর্টে দুটি আপিলের একসাথে শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ১৬ জুন।