প্রতিবেদন

তিনি একজন নোবেলিস্ট!

ব্যক্তি তার কর্মের দ্বারা সুনাম, পুরস্কার বা খেতাব অর্জন করে এবং মর্যাদার আসনে আসীন হয়। স্বদেশের মানুষ তাকে নিয়ে গর্ববোধ করে এবং মৃত্যুতেও তিনি অমরত্ব লাভ করেন। পৃথিবীতে এসব মহৎ ও মহান মানুষের সংখ্যা কম নয়, যাদের অনেকেই প্রাতঃস্মরণীয়। আমাদের এই উপমহাদেশে বিগত একশ-দেড়শ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সমাজসেবা, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ওইসব গুণী মানুষের মুখাবয়ব/মুখচ্ছবি। এরা একেকজন মহামানব এবং এই পৃথিবীতে এদের আগমন শুধু নিজ দেশ বা দেশের মানুষ নয়; বরং দুনিয়ার সব মানুষের তথা সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের জন্য। এরা সমুদ্রের ন্যায় বিশাল অন্তরের অধিকারী এবং আকাশের মতো উদার। এরা বায়ু সমতুল্যÑ কারণ বায়ু যখন প্রবাহিত হয় তখন ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাত, আস্তিক-নাস্তিক, ভেদাভেদ না করে সবাইকে সমানভাবে তার উপকরণ বিলিয়ে দেয়। ‘পরের জন্য স্বার্থ দিয়া বলি, এ জীবন মন সকলি দাও, তার মত সুখ কোথাও কি আছে, আপনার কথা ভুলিয়া যাও’Ñ কবির এই চরণগুলো কেবল ওইসব মহামানবের বেলায় প্রযোজ্য।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিষয়টি বিরাট। যিনি এই পুরস্কারে ভূষিত তিনি আরও বড়। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের পর আজ পর্যন্ত যারা এই পুরস্কার পেয়েছেন তাদের কারও কারও বেলায় বিতর্ক আছে।
নোবেল পুরস্কারের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর যে কোনোটিতে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি যেমন গর্বিত, দেশবাসীও তেমনি গর্বিত হয়। বাংলাদেশের সামনেও এরকম একটি মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছিল। আমরাও গর্ব অনুভব করেছিলামÑ যখন এ দেশে ক্ষুদ্র ঋণের প্রবর্তক গ্রামীণ ব্যাংকের কর্ণধার যৌথভাবে প্রতিষ্ঠানের সাথে শান্তিতে নোবেল খেতাবে ভূষিত হলেন।
আলোচ্য শান্তির খেতাবধারী ড. মোহাম্মদ ইউনূস অর্থশাস্ত্রের মানুষ। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করেছেন। অধ্যাপনা ছেড়ে দিলেও অর্থনীতির ‘অর্থ’ ছাড়েন নি। এটি অবশ্য দোষের কিছু নয়। কিন্তু প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য মোচনে সরকারের আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত প্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে চড়া সুদে মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্র ঋণ নামের যে প্রকল্প চালু করলেন সেই ঋণ গ্রহণ করে হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্যের কোনোই পরিবর্তন হয়নি; বরং সুদে-আসলে ক্ষুদ্র ঋণ বৃহৎ ঋণে পরিণত হতে থাকল। আর ঋণের বোঝা পরিশোধে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, ঘরের চালার টিন এমনকি বাস্তুভিটাও বিক্রি করতে হয়েছে। শোনা যায়, কেউ কেউ ঋণ পরিশোধ করতে শরীরের অঙ্গ পর্যন্ত বিক্রি করেছে। ঋণ শোধ করতে না পারায় পালিয়ে বেড়াতে হয়েছেÑ এমনকি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে মাইক্রোক্রেডিট প্রকল্প প্রণেতা বিরাট ব্যবসায়ী তথা পুঁজিপতি বনে গেছেনÑ অর্থাৎ মানি বিগেটস মানিÑ এই তত্ত্বের একজন শতভাগ সফল প্রয়োগকারী। আর এরই বদৌলতে নোবেল কমিটি তাকে শান্তির খেতাবে ভূষিত করলেন অর্থাৎ, শান্তিতে নোবেল লরেট।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায় ফি-বছরই হয়। ব্যাংক, বীমা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ এমনকি প্রায় সব স্তরের চাকরিজীবী নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী দুর্যোগকবলিত দুস্থ অসহায় মানুষদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান-অনুদান প্রদান করে। কিন্তু ড. ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অনুদান দিয়েছেন অথবা ব্যক্তিগতভাবে ওইসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেনÑ এমন কথা কখনও শোনা যায়নি। অথচ তিনি ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে ৩ লাখ ডলার অনুদান দিয়েছেন। ওই যে প্রবাদ আছে ‘টাকায় টাকা আনে’Ñ ওই ৩ লাখ ডলার তিনি বিনিয়োগ করেছেন, ঝানু ব্যবসায়ী যাকে বলে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর শাইলক আর কী।
ধরে নেওয়া যাক, শত্রুতার উদ্দেশ্য সেতুটি যেন শেখ হাসিনার আমলে না হয়Ñ শান্তির দেবতার পছন্দের দল (২০১৪ সালে) ক্ষমতায় এসে সেতুটি নির্মাণ করবে। আরও ধরে নিচ্ছি যে, তার দল ক্ষমতায় এলো কিন্তু সে পর্যন্ত তো সেতু নির্মাণ কয়েক বছর পিছিয়ে গেল অর্থাৎ, দেশের উন্নয়ন কয়েক বছর থেমে থাকল। শুধু তাই না, নির্মাণ ব্যয়ও কয়েক গুণ বেড়ে যেত এবং তাতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হতো। অবশ্য ক্ষতি যা হওয়ার ইতোমধ্যে তা হয়ে গেছে। কারণ ২০১০ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণ শুরু করার কথাÑ শত ষড়যন্ত্র ও বিশ্বব্যাংকের হঠকারিতা নির্মাণ বন্ধ করতে পারেনি শুধু জননেত্রীর দৃঢ়তা, সাহসিকতা এবং দূরদর্শিতার কারণে, তবে পিছিয়ে দিয়েছে।
ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেনÑ কীভাবে পেয়েছেন বা পাওয়া যথার্থ হয়েছে কি-না সে প্রশ্ন কখনই উঠত না, যদি না পুরস্কার প্রাপ্তির পর উপর্যুক্ত অনভিপ্রেত কর্মকা-ে নিজেকে জড়িত করতেন।

লেখক : প্রফেসর ড. এম আব্দুস সোবহান, সাবেক উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *