থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে
অথৈ পানিতে জীবন বাঁচাতে সংগত কারণেই খড়কুটার আশ্রয় নেওয়া হয়। তাতে চেষ্টা থাকলেও জীবন কখনও রক্ষা পায় বলে শুনি নি। তবে ওই অবস্থায় কেউ কল্পনায় যদি সাহায্যকারী জাহাজ ধরতে চায়, তবে তাকে কি বলা হবে? শিশু না-কি পাগল! কোনটা জানি না। তবে অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে, পাগল আর শিশু নিয়ে পরিহাস করা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সংগত না হলেও বিএনপি-জামাতের ২০-দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া তাদের নিয়ে যা বলেছিলেন, তা এখন তারই নামের সাথে যুক্ত হয়ে বিদ্রƒপ রূপে প্রতিভাত হচ্ছে। একেই বলে ঢিল দিলে পাটকিল খেতে হয়। এমন কথাগুলো বলা হতো না, যদি তিনি সখাত সলিলে থাকা সত্ত্বেও বারবার কল্পনার রাজত্বে বিচরণ না করতেন।
কিছুদিন আগে জাতীয় ঐক্যের স্লোগান তিনি দিয়েছিলেন। চারদিকে তার সাঙ্গোপাঙ্গরা হৈ হৈ রব তুলেছিল। থিংকট্যাংক রূপী বুদ্ধিজীবীরা বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন, এবারে কিছু একটা করে ছাড়বেন খালেদা জিয়া। সমদূরত্বের নীতি নিয়ে চলা নিরপেক্ষবাদীরাও ইনিয়ে-বিনিয়ে বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে নানাধর্মী ছবক দিতে শুরু করেছিলেন। দুই নম্বরি নেতা তারেক জিয়া নিশ্চুপ থাকলেও এক নম্বর নেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত বিএনপি নামক নিমজ্জমান জাহাজটা তখন এমন হাবভাব দেখাতে থাকল যে, এবার পাওয়া গেছে মোক্ষম অস্ত্র। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোট সরকারকে বেকায়দায় ফেলে আইসোলেট বা গণবিচ্ছিন্ন করা যাবে। দল ও জোটকে করা যাবে সজীব ও সচল। জনগণকে নামানো যাবে সরকারবিরোধী অন্দোলনের মাঠে। বিদেশিরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে পক্ষে দাঁড়াবে। তারপর আর কি? ক্ষমতা হাতের মুঠোয় চলে আসবে। কিন্তু হায় হতোস্মি! কল্পনার ফানুস ফুটো হয়ে গেল। জামাত বুক ও পেটের ভেতরে থাকায় শীতকালের মুলা নাকের আগায়ই রয়ে গেল। বরং জামাতসহ ২০-দলের মধ্যে আরও কনফিউশন কিংবা ডিসটেন্স সৃষ্টি হলো। তাতে আরও অথৈ জলে হাবুডুবু খেতে লাগল বিএনপি।
এবার আরও একটি ইস্যু ধরতে ভীষণ উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন বিএনপির কল্পনাবিলাসী কা-ারি ও বিদ্রƒপের আঘাতে জর্জরিত খালেদা জিয়া। ইস্যুটি হচ্ছে মেয়াদ শেষে নির্বাচন কমিশন গঠন। নিজের জাহাজে (পাঠকরা! জাহাজ শব্দটা দিয়ে পায়ে শব্দটাকে পরিবর্তন করলাম। ক্ষমা করবেন। Ñ লেখক) নিজে কুড়াল মেরে এখন ডুবন্ত হলেও বিএনপি নিঃসন্দেহে একটি বড় দল। বড় জিনিসেব ভার বেশি। একবার ডুবন্ত হলে আবার ভাসানো কঠিন। তারপর আবার নিত্যনতুন ইস্যু ও দাবি নিয়ে কল্পসর্গে বিচরণ করা বোঝার ওপর শাকের আঁটি নয়, আরও ভারী কিছু। প্রসঙ্গত বলি, পাকিস্তানি মদদে জামাতকে সাথে রেখে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে জনগণের ওপর আগুন সন্ত্রাস চাপিয়ে দেওয়াও কিন্তু ছিল কল্পনায় ক্ষমতার মুলা দেখারই নামান্তর। কেননা বর্তমান বিশ্ব ও উপমহাদেশের বাস্তব অবস্থায় মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা কিংবা সংবিধানের বাইরে গিয়ে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করা কিংবা অসাংবিধানিক অবৈধ সরকার কায়েম করা অসম্ভব। প্রকৃত বিচারে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার অপচেষ্টার কারণেই বিএনপি দলটি ডুবছে তো ডুবছেই।
এই অবস্থায় বিএনপি-জামাত জোট নেত্রী খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রসঙ্গ নিয়ে যে ফর্মুলা তুলে ধরলেন, তাতে ভারটা আরও বাড়লো বৈ কমলো না। এখানে উল্লেখ্য, একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে খালেদা জিয়া বিভিন্ন সময়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে দাবি তুলতে পারঙ্গম। কিন্তু ওই দাবি বাস্তবায়িত করার কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তিনি তুলে ধরতে অপারগ থাকেন। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, বিগত নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় এবং নিজেদের ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’-সহ বহু তিক্ত ও ক্ষতিকর ঘটনা থাকার পরও তিনি যখন ওই দাবি তুলে ধরলেন, তখন বলা হলো আপনি ফর্মুলা দিন কীভাবে সরকার গঠন হবে।
প্রথমে তিনি মামার বাড়ির আবদারের মতো গো ধরে বললেন, সরকার সংবিধান সংশোধন করেছে, সরকারকেই ফর্মুলা দিতে হবে। তারপর চাপে পড়ে দিলেন ফর্মুলা। তারপর কী কা-টা ঘটেছিল সবারই জানা। হাস্যোস্পদভাবে নীরব হয়ে গিয়ে তিনি আগুন সন্ত্রাসের পথ ধরেছিলেন। এবারে নির্বাচন কমিশন গঠনের ফর্মুলা নিয়েও হয়েছে একই দশা। প্রবাদ অনুযায়ী একেই বলে শনিরদশা। যা কর্ম দোষে কখনও খালেদা জিয়ার পিছু ছাড়ে না। কি কি কারণে নির্বাচন কমিশন গঠনের রূপরেখা তুলে ধরে ডুবন্ত দল ও জোট শনিরদশার মধ্যে পড়েছে, তা অনুধাবন করা সম্ভব হবে, যদি ওই বক্তব্যগুলো কি এবং কি উদ্দেশে তুলে ধরা হলো, তা নিয়ে আলোচনা করা যায়।
ডুবন্ত থেকেও বিএনপি আসলে পারে বটে, যেমন পারে জাতে মাতাল তালে ঠিক ব্যক্তিরা। এমন যারা তারা চরমে বিপদে পড়েও কিচ্ছু শেখে না, অঙ্গারের মতো শতবার ধুলেও তাদের স্বভাবের কালিমা যায় না। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রস্তাবগুলোকে অবশ্য ডুবন্ত অবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত আবোল-তাবোল হাত-পা নাড়ানো বলা যাবে না, এর পিছনে রয়েছে গূঢ় সব উদ্দেশ্য, যা মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট রাখারই নামান্তর। আসলে কথা বলার কী অসামান্য ধরন! তিনি কতটুকু কী বুঝেন জানি না, তবে তার থিংকট্যাংকবৃন্দ মনে করেন, দেশবাসী হয়তো বা কেউ অবুঝ শিশু, কিছু বুঝবে না। অথবা কেউ দলীয়ভাবে অন্ধ বিধায় পাগল। প্রকৃত বিচারে এমনটা মনে না করলে এমন রূপরেখা তুলে ধরা আদৌ সম্ভব হতো না। একে একে হীন উদ্দেশ্যগুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করলেই উপরিল্লিখিত কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে।
প্রথমত; নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া বিষয়ে প্রস্তাবনা উত্থাপন করতে গিয়ে অন্তত সাতবার পরোক্ষভাবে এতে জামাতকে যুক্ত রাখার বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতে নিবন্ধিত দল ছাড়াও প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের কথা যুক্ত আছে। এ কথার ভেতর দিয়ে জামাতকে প্রক্রিয়ায় রাখার কথাই কেবল বলা হয় নি; নিবন্ধিত দলগুলোর কথাও বলা হয়েছে। নিবন্ধিত দল যতটুকু জানি চল্লিশের ওপরে। প্রশ্ন হলোÑ এক. যদি নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কে বিএনপি সত্যিকারের আলোচনা চায় তবে কি জামাতকে সাথে রাখার বিষয়টা যুক্ত করতে পারে? দুই. ৪০টির বেশি দলের সাথে আলোচনা করে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করা আদৌ কি সম্ভব? উনিশ পিঁপে নস্যি কেন একশ পিঁপে নস্যিতেও এর সমাধান হবে না। এক কথায় এ দুয়ের কোনোটাই যে সম্ভব নয় এবং প্রয়োজনও নেই, তা বুঝে নিতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
তাই এই প্রস্তাবের লক্ষ্য আলোচনা করে সমস্যার সমাধান নয়Ñ সমস্যা জিইয়ে রাখা। কেননা বিএনপি এটা বোঝে যে, জনগণের মনোভাব, দলের অবস্থা, ক্ষমতার ভারসাম্য কোনো বিচারেই নির্বাচন করে বিএনপির পক্ষে বর্তমানে ক্ষমতায় আসা সম্ভব নয়। তাই সময় নিতে চাইছে বিএনপি। কালক্ষেপণের সাথে সাথে তাই রূপরেখার মুলা ঝুলিয়ে দলীয় হাইকমান্ড দুটো কাজ করতে চায়। এক. ইতোপূর্বে জাতীয় ঐক্যের মুভ দিতে গিয়ে জামাতকে যতটুকু বেজার ও ক্ষুব্ধ করা হয়েছিল তা মেরামত করা। এটা জামাতকে বুঝানো যে, আমরা আছি তোমারই সাথে বুকে বুক মিলিয়ে। দুই. দলে নেতাকর্মীসহ বিদেশিদের এটা বুঝ দেওয়া যে, আমরা প্রস্তাব দিচ্ছি সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা করার জন্য জাতীয় ঐক্যমত্যের। কিন্তু সরকারি দলÑ জোট তো আসছে না। এটা বোঝানোর জন্য খোলা কলাম ইত্যাদিতে বিএনপির দিকে ইনিয়ে-বিনিয়ে ঝুঁকে থাকা সুশীলরা বলতে শুরু করেছেন, ‘কিছু সমালোচনা থাকলেও প্রস্তাব তোলাটাই পজেটিভ। জাতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে তিনি আনুষ্ঠানিক আলোচনার সূত্রপাত করেছেন। তার রূপরেখা সম্পূর্ণ গ্রহণ করতে হবে এমন নয়।’
জামাত নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ায় থাকা কি ‘কিছু সমালোচনা’ কিংবা ‘পজেটিভ’? জাতীয় জীবনের বিষফোঁড়া জামাতকে সাথে রাখলে কি তা কিছু সমালোচনাযোগ্য? আসলে জামাত নামক নেগেটিভকে পজেটিভ করার কতই না অপচেষ্টা! জামাত থাকা মানেই তো পাকিস্তানি ধারা জিইয়ে রাখা, আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া। জন্মলগ্নের চেতনাকে পদদলিত করা। প্রসঙ্গত, পাকিস্তানি আমলের শেষ দিকে যখন ৬-দফাভিত্তিক ১১-দফার গণ-অভ্যুত্থানে দেশ ভাসছে, তখন পরোক্ষভাবে যারা আইয়ুব ও পরে ইয়াহিয়া খানকে টিকিয়ে রেখে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, তারা প্রায়শই সব কিছুতে সব দলের ঐক্যের প্রসঙ্গটা টেনে আনত। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্রের নামাবলী গায়ে দিয়ে জুজুর ভয় দেখিয়ে জাতীয় জাগরণের প্রাণভোমরা অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সুকৌশলে পাথরচাপা দেওয়া। বাঙালি জাতির মহানায়ক তো তাই নবজাত দেশে পাকিস্তানের বন্দী জীবন ও ফাঁসিকাষ্ঠের দোরগোড়া থেকে ফিরে এসে এমনি এমনি জাতীয় মূলনীতি হিসেবে ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি যুক্ত করেন নি; কিংবা বলেন নি যে, যেদিন বাঙালি জাতীয়তাবাদ ভুলে যাব সেদিন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব থাকবে না! বিএনপির কাছে জাতীয়তাবাদ হচ্ছে, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। জামাতের সঙ্গ তাই ছাড়তে পারছে না বিএনপি। এ অবস্থায় বিএনপির যে কোনো বিষয়ে সমঝোতার প্রস্তাব আদৌ তাই কোনোভাবে আলোচনার সূত্রপাতের প্রস্তাব নয়। নানা ধরনের ফন্দিমাত্র! আইওয়াশ বিশেষ!
দ্বিতীয়ত; বিএনপি-জামাত জোট নেত্রী খালেদা জিয়া প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়ে যা বলেছেন, তাও হীন উদ্দেশ্য প্রণোদিত। সেনাবাহিনী রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ফলাফল দেশ-জাতি-জনগণের জন্য কখনও শুভ হয় নি। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের ধারা পাকিস্তানি আইয়ুব-মোনায়েমী ধারা। হত্যা-ক্যু-পাল্টা ক্যুয়ের রাজনীতির অনুষঙ্গ। সামরিক বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক আইনের শাসন আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা ও বিকাশকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। একটু খেয়াল করলেই স্মরণে আসবে যে, ক্ষমতার বাইরে থাকলে বিএনপি-জামাত জোট নেত্রী খালেদা জিয়া প্রায়শই সেনাবাহিনীকে উসকানি দিয়ে থাকেন। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে আগুন সন্ত্রাস দিয়ে ভয়াবহ পরিবেশ করার উদ্দেশ্যই ছিল, রাষ্ট্রক্ষমতায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের পরিবেশ সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকার করা। বলাই বাহুল্য সেনাবাহিনীর বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার অর্থও কিন্তু তেমন উসকানি দেওয়ারই নামান্তর।
তৃতীয়ত; খালেদা জিয়া বাছাই কমিটি গঠন থেকে শুরু করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, কমিশনারবৃন্দ নিয়োগ প্রভৃতি বিষয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা সহজেই ইলাস্টিসিটির মতো টেনে টেনে অশ্বডিম্ব প্রসবের মতো ঘটনায় পর্যবসিত করা যেতে পারে। ‘বিতর্কিত নন’ এমন ব্যক্তিদের খুঁজে নিতে ‘ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত’ নাম দেওয়া ও আলোচনা ‘অব্যাহত রাখার’ প্রস্তাব শুনতে মধুর; গণতান্ত্রিকও। কিন্তু কার্যকর করা দুঃসাধ্য হতে বাধ্য। যদি তখন নির্বাচন না করে ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকারে ইচ্ছুক কোনো বড় দল কেবলই নিজ দলীয় লোকের নাম বলতে থাকে, তবে তখন কি হবে? কি হবে যদি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কোনো ব্যক্তি পদ নিতে অস্বীকার করে। রাজনীতির অঙ্গনকে ডিবেটিং ক্লাব বা লটারির মধ্যে কি কখনও নিয়ে আসা শুভ বুদ্ধির লক্ষণ! আর জনগণের ভোট ছাড়া কোনো ব্যক্তি ও সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া কি সংবিধান ও গণতন্ত্রসম্মত!
প্রবাদ বলে, দুধের মধ্যে একটু চনা পড়লে দুধ যায় পচে। আর চনার মধ্যে যদি কয়েক ফোটা দুধ পড়ে তবে কি হয়? দুধ না হয়ে তা চনা হয়ে দাঁড়ায়। উল্লিখিত মূল তিন কারণে বিএনপি-জামাত নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রস্তাবনাটা হচ্ছে চনা-বিশেষ। এর মধ্যে ভালো কিছু যদি থাকে, তবে তা হবে অমাবশ্যার ঘোর অন্ধকারে সুই খুঁজে বেড়ানোরই নামান্তর। প্রকৃত বিচারে দল-গোষ্ঠী-ব্যক্তি যারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এক পাল্লায় তুলে সমদূরত্বের নীতি নিয়ে চলেন, তারাই কেবল এতে ভালো কিছু খুঁজতে চাইবেন। কালক্ষেপণের সাথে সাথে যেখানে জামাতের সাথে ভুল বুঝাবুঝি দূর ও মৈত্রীবন্ধন দৃঢ় করা, ছোট দলগুলোকে আলোচনা টেবিলে রাখার টোপ দিয়ে সাথে রাখা, নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীলদের নির্বাচলকালীন সরকারের কথা বলে পক্ষে টানা আর প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে যদি কোনো ক্ষমতালোভী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী থাকে তবে তাদের উসকানি দেওয়া প্রভৃতি হচ্ছে এই রূপরেখা ঘোষণার অসৎ উদ্দেশ্য, সেখানে এর মধ্যে ভালো কিছু থাকতে পারে না। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, নির্বাচন কমিশন গঠন কেন, সংস্কারের মাধ্যমে ক্রমে গণতন্ত্রের অগ্রগতি ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়া কেবল সম্ভব গণতন্ত্র প্রক্রিয়া চালু রাখার ভেতর দিয়েই সম্ভব। খালেদা জিয়া উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভ্রান্ত পথে দেশবাসীকে ঠেলে দিতে চাইছেন।
প্রসঙ্গত, বিএনপিঘেঁষা বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ বলতে চাইছেন, বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাধায়ক সরকারের দাবি থেকে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিতে ‘সরে এসেছে’। আগের দাবিতে বিএনপি আর ‘অটল নেই’। আরও বলা হচ্ছে, ‘এই সহায়ক সরকারের গঠন প্রকৃতি কেমন হবে সে ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট প্রস্তাব রূপরেখায় না থাকলেও তা দুর্বোধ্য নয়। বোঝা যাচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে এবার কোনো বিভেদ থাকবে না।’ কীভাবে যা খালেদা জিয়া বলেন নি তা জানতে পারা গেল, তা বুঝে উঠতে পারা দুষ্কর। এতকাল জানতাম, দুরভিসন্ধি থাকলেই রাজনীতিতে অস্পষ্ট কথা বলা হয়। আর যা সুস্পষ্ট নয় তার মধ্যে দুর্বোধ্যতা থাকবেই। ভাবলে বিস্ময় জাগে, বিভেদ থাকবে না এমন ভবিষ্যৎবক্তা তারা হনই বা কি করে? নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি যে আবার নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি হবে না, এমন গ্যারান্টি তারা পান কোথা থেকে? এসব তাদের হতে হয় কিংবা গ্যারান্টি খুঁজে বেড়ান, কারণ তারা নিরপেক্ষ সেজে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চান। নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে বিএনপি-জামাত নেত্রী খালেদা জিয়াকে ডুবন্ত থেকে ভাসন্ত করতে চান।
বলাই বাহুল্য, উল্লিখিতভাবে খালেদা জিয়ার নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কিত রূপরেখা হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ায় দেশের বিশিষ্টজনদের কাছে যেমন গ্রহণযোগ্য হয় নি, তেমনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাথে সাথেই তা প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে বলেছেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেওয়া ফর্মুলা অন্তঃসারশূন্য, চর্বিতচর্বন এবং জাতির সাথে তামাশা ভিন্ন আর কিছুই নয়। সংবিধান মোতাবেক চলাটাকেই তিনি সংগত ও স্বাভাবিক মনে করেছেন। অবস্থাদৃষ্টে এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, ইতোপূর্বে বিএনপি-জামাত নেত্রী খালেদা জিয়া উত্থাপিত জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টার মতোই এবারের নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টাও বুদবুদের মতো বাতাসে মিলিয়ে যাবে। যার ফলাফল হবে বিএনপি দলটির আরও অতলে ডুবে যাওয়া।