দুই অর্থনীতির তত্ত্ব
স্বাভাবিক কারণেই বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা, এমনকি অনেক বিদ্বজ্জনও ‘দুই অর্থনীতি’ তত্ত্ব সম্পর্কে তেমন অবহিত নন। দুই অর্থনীতির তত্ত্ব উৎসারিত হয়েছে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি, তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু এবং পশ্চিম পাঞ্জাবকে নিয়ে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল এবং ১ হাজার মাইল দূরবর্তী বাংলাকে ভাগ করে পূর্ববঙ্গকে নিয়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল গঠিত হয়। পরে এই দুটি অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে পরিচিতি লাভ করে। নতুন রাষ্ট্রের রাজধানী স্থাপিত হয় সিন্ধু প্রদেশের করাচিতে। পরে অবশ্য রাজধানী স্থানান্তরিত হয় ইসলামাবাদে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্নের বৈশিষ্ট্য ছিল, আয়তনে পশ্চিম পাকিস্তান ছিল ৩ লাখ বর্গমাইলের ওপর। আর পূর্ব পাকিস্তানের আয়তন ছিল মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইল। পক্ষান্তরে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটি আর পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৩ কোটি। অর্থাৎ পূর্ব বাংলা ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবাসস্থল। পাকিস্তানের জন্মলগ্নে এবং পরের এক দশকজুড়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার হার বেশি ছিল। বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আয় করত পূর্ব পাকিস্তান। জিডিপি (৫২ শতাংশ) এবং মাথাপ্রতি আয়ের দিক থেকেও পূর্ব বাংলা এগিয়ে ছিল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলাকে তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে ‘নতুন ধরনের’ উপনিবেশে পরিণত করে। পূর্ব বাংলার আয় ও অর্থ দিয়ে গড়ে তোলা হয় পশ্চিম পাকিস্তান। সশস্ত্র বাহিনী, সরকারি চাকরি, বৈদেশিক বাণিজ্যের আয় এবং পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারসহ অকল্পনীয় আঞ্চলিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়।
১৯৫৬ সালে সামরিক বাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে ৬০০ জন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি এবং নি¤œপদস্থ অফিসার পদে মাত্র ৬০ জন ছিল বাঙালি। স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল যথাক্রমে ৫ শতাংশ, ১০ শতাংশ এবং ১৬ শতাংশ। অন্যদিকে ১৯৫২ সালে অসামরিক প্রশাসনে পাকিস্তানের ৯৩ সচিবের মধ্যে সবাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় চাকরিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যা ছিল ৪২ হাজার আর পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র ২ হাজার ১০০ জন। পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারি কর্মকর্তাদের মোট বেতন ছিল ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা পেত মাত্র ৬৫ লাখ টাকা। ১৯৪৯-৫০ সালে উভয় প্রদেশের বৈষম্যের মাত্রা ছিল ১৯ শতাংশ, যা ১৯৬৫-৬৬ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫৫ শতাংশে। ১৯৪৭-৬৬ সালের মধ্যে যে বৈদেশিক সাহায্য দেশের উন্নয়নে ব্যয় তার মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানের অংশ ছিল মাত্র ৩৪ শতাংশ। ব্যাংক, বীমা, শিল্প-কারখানার মালিকানা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ এককভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে ছিল। পূর্ব পাকিস্তান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাঁচামাল এবং মূলধনের জোগানদাতা।
দুটি সারণির সাহায্যে বৈষম্যের চিত্র দেখানো হয়েছে।
বঞ্চনা ও বৈষম্যের এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতা এবং পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে উপনিবেশ হিসেবে শাসন-শোষণের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নীতিই দুই অর্থনীতি তত্ত্বের জন্ম দেয়।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন যখন আওয়ামী লীগ গঠিত হয়, তখন প্রণীত দলের প্রথম কর্মসূচিতে এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট ২১-দফা দাবিতেও পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু সেসব দাবিতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি এবং মুদ্রা ব্যবস্থা কেন্দ্রের হাতে রাখার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মাথায় সকল প্রকার নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে যখন দুই অঞ্চলের মধ্যে পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য সৃষ্টি এবং পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করে পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তোলার কাজ চলতে থাকে, তখন থেকেই আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক দলগুলো এবং বুদ্ধিজীবীগণ প্রতিবাদে সোচ্চার হতে থাকেন। ষাটের দশকের শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবী এবং উচ্চপদস্থ কয়েকজন বাঙালি আমলা পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের দুই অংশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনসহ দুই অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন, বৈদেশিক বাণিজ্যের কর্তৃত্ব প্রদেশের হাতে ন্যস্ত করা এবং পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থপাচার বন্ধের দাবি উত্থাপন করেন। দুই অর্থনীতির ধারণা অনেকেই পোষণ করেছেন এবং যার যার মতো ব্যাখ্যা করেছেন। বস্তুত, দুই অর্থনীতির তত্ত্ব এককভাবে কোনো ব্যক্তি উদ্ভাবন করেন নি। সূচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স ফ্যাকাল্টির প্রফেসর এএফএম আতোয়ার রহমান, প্রফেসর নূরুল ইসলাম এবং পরে ১৯৬১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর লাহোরে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তরুণ অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহান সূত্রাকারে ‘দুই অর্থনীতি’ তত্ত্ব তুলে ধরেন। কেন্দ্রীয় সরকারের বাঙালি আমলা রুহুল কুদ্দুস, আহমদ ফজলুর রহমান ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য প্রফেসর আখলাকুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ যেমন দুই অর্থনীতির ধারণাকে স্পষ্ট করে তোলেন, তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম দুই অর্থনীতির ধারণাকে পূর্ণাঙ্গ করেন এবং সূত্রাকারে ৬-দফার দাবিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি এই দাবিকে জাতীয় দাবিতে পরিণত করেন।
১৯৬৪ সালের ৫ জুন আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদে শেখ মুজিবুর রহমান ১১-দফা দাবি উত্থাপন করেন। ১১-দফা নিয়ে দলে তুমুল বিতর্ক হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সর্বসম্মতিক্রমে ১১-দফা গৃহীত হয়। ১১-দফা হচ্ছে পরবর্তী ৬-দফা দাবির ভিত্তি। এই ১১-দফায় ১নং দাবিতে দেশে ফেডারেল পদ্ধতির সরকার চালু, ৭নং দাবিতে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন কায়েমের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থাসহ পৃথক অর্থনীতি প্রণয়ন’, ৮নং-এ সকল প্রদেশের জন্য পৃথক বৈদেশিক বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন এবং ৯নং-এ ‘বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব-নিকাশ ও আয়-ব্যয়ের পূর্ণ অধিকার প্রদেশের হাতে ন্যস্তকরণের দাবি উত্থাপন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ১১-দফা দাবিতেই প্রথম দুই অর্থনীতির ধারণাটিকে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে সামনে আনা হয়। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে বিরোধী দলগুলোর আহূত বৈঠকে তার বিখ্যাত ৬-দফা দাবি উত্থাপন করেন। ৬-দফা আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত না করায় সেই সর্বদলীয় বৈঠক ভেঙে যায়।
ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবিতে দুই অর্থনীতির ফরমুলা আরও সুনির্দিষ্ট সূত্রাকারে উত্থাপন করা হয়।
৬-দফার ২নং দফায় ফেডারেল সরকারের হাতে কেবল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি রাখা হয়। ৩, ৪ ও ৫নং দাবিগুলোতে সহজে বিনিময়যোগ্য দুটি পৃথক মুদ্রা দুই অঞ্চলে চালু করা, পৃথক রাজস্ব ও মুদ্রানীতি গ্রহণ, প্রদেশের হাতে করারোপ ও রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষমতা ন্যস্ত করা, বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য দুটি পৃথক বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রার ব্যবস্থা, যে প্রদেশ যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে, তার কর্তৃত্ব প্রদেশের হাতে ন্যস্ত করা এবং এক প্রদেশ থেকে (অর্থাৎ পূর্ব বাংলা থেকে) অন্য প্রদেশে (পশ্চিম পাকিস্তানে) মুদ্রা পাচার বন্ধের সাংবিধানিক গ্যারান্টির ব্যবস্থা করার দাবি করা।
৬-দফা একাধারে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসনের দাবি, অন্যদিকে এক দেশ দুই অর্থনীতিরও প্রবক্তা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী স্বাভাবিকভাবেই এই দাবিকে পাকিস্তানের মৃত্যু পরোয়ানা মনে করেছে। আবার পৃথক অর্থনীতি না করলে কেবল প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন পেলেও পূর্ব বাংলার ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ শাসন এবং ঔপনিবেশিক প্রভুত্বের অবসান ঘটানো সম্ভব ছিল না। বস্তুত, ৬-দফার ব্যানারে দুই অর্থনীতির তত্ত্ব, আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ম্যাগনাকার্টা। দুই অর্থনীতির মাধ্যমে যেমন পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষা অসম্ভব ছিল, তেমনি দুই অর্থনীতির লক্ষ্য অর্জনের একমাত্র পথ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা।