নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হলো রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী
উত্তরণ ডেস্ক: বাংলাদেশের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, গানের বুলবুল, প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি, রবীন্দ্রোত্তর বাংলার সবচেয়ে শক্তিমান কবিÑ এমন নানা ভূষণে-উপাধিতে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম। তার সৃষ্টিকর্মে মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের বাণী উচ্চারিত হয়েছে প্রবলভাবে। সেই মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে গত ২৫ মে পালিত হয়েছে বিদ্রোহী কবির ১১৬তম জন্মবার্ষিকী। রাজধানীসহ দেশের সকল জেলায় তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছে সর্বস্তরের মানুষ ও বিভিন্ন সংগঠন। এ বছর জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জয়ন্তীর প্রধান অনুষ্ঠান ছিল করিব স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লার টাউন হল মাঠে। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া ত্রিশাল, দৌলতপুর ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানেও ছিল বর্ণাঢ্য আয়োজন। কুমিল্লায় নজরুল জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা গড়ে তুলব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কবি নজরুল বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করেছেন। তার সব লেখা অসাধারণ। তার লেখা গান ও কবিতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। জাতির পিতার সাথে ছিল কবি নজরুলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে কবি নজরুলের সাথে ঘনিষ্ঠতার কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতাম সেটি বঙ্গবন্ধু কবি নজরুলের একটি কবিতা থেকে নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ১৯২১-২৪ সাল পর্যন্ত নজরুল কুমিল্লায় এসেছেন বারবার। তিনি তার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান গান-কবিতা এখানে থেকে লিখেছেন।
২৫ মে ভোর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় জমান সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ। কবির পরিবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। ভোরে শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক কবির মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল, বিভাগ এবং শিক্ষক সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। মাজারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সকালে কবির মাজার প্রাঙ্গণে অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে এক স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণ সভায় বাংলাদেশ সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দীন, কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান, বাংলা বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল বক্তব্য রাখেন। নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন। এ ছাড়াও জাতীয় কবির মাজারে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে রাজনৈতিক, সামজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবীসহ নানা সংগঠন।
এদিকে রবীন্দ্রমেলা, সংগীত, চিত্রকর্ম প্রদর্শনী, নাটক মঞ্চায়ন, অডিও সিডির মোড়ক উন্মোচনসহ নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনে গত ৯ মে দিনব্যাপী উদযাপিত হয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী। নাচ, গান, আলোচনা ও নৃত্যনাট্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৪তম জন্মজয়ন্তী উদযাপন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। এ উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের প্রথম দিনে জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে ওই দিন সন্ধ্যায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর ড. নূরুল আনোয়ার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর। এতে সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। অনুষ্ঠানে একক সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী অনিমা রায়, চঞ্চল খান, নার্গিস চৌধুরী, সাইদা হোসেন পাপড়ী, সাজেদ আকবর, অনিরুদ্ধ সেন গুপ্ত ও ইলোরা আহমেদ শুক্লা। সমবেত সংগীত পরিবেশন করে বাংলার মুখ, জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ মহানগর শাখা ও গীতাঞ্জলী। আবৃত্তি পরিবেশন করেন শিল্পী হাসান ইমাম, কৃষ্টি হেফাজ, নায়লা তারান্নুম কাকলী। সবশেষে কবিরুল ইসলাম রতনের পরিচালনায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’ পরিবেশন করে নৃত্যালোক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। নৃত্যনাট্যটিতে অভিনয় করেন কবিরুল ইসলাম রতন, সাদিয়া ইসলাম মৌ ও নৃত্যালোকের শিল্পীবৃন্দ।
কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ৯ মে সন্ধ্যায় ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে শুরু হয়েছে দুই দিনের রবীন্দ্র-উৎসব। উৎসবে ছায়ানটের পাশাপাশি সুরতীর্থ, সুরের ধারা, জাগো আর্ট সেন্টার, ভাবনাসহ বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন দলীয় পরিবেশনায় অংশ নেয়। ছিল একক গান ও পাঠ। চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে অন্যবারের মতো এবারও অনুষ্ঠিত হলো চ্যানেল আই রবীন্দ্রমেলা-২০১৫। এ বছর আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান। সকাল ১০টায় মেলার উদ্বোধন শেষে আতাউর রহমানের হাতে পুরস্কার ও সম্মাননা তুলে দেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, চ্যানেল আই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ, পরিচালক জহির উদ্দিন মাহমুদ মামুন, মুকিত মজুমদার বাবু, মেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবি ব্যাংকের ডিএমডি মশিউর রহমান, আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি ও সিইও শাহ এ সারোয়ার, কবি আসাদ চৌধুরী, সৈয়দ হাসান ইমাম, শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা প্রমুখ। মেলায় রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার একটি একক রবীন্দ্রসংগীতের সিডির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অ্যালবামের নাম ‘ভরা থাক স্মৃতিসুধায়’। মেলায় সংগীত পরিবেশন করেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, লিলি ইসলাম, সাদী মহম্মদ ও আমেনা আহমেদ, হীমাদ্রি শিখর, সালমা আকবর, সাজিদ আকবর, সরোয়ার হোসেন বাবু, ফাহিম হোসেন চৌধুরী প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ছবি আঁকেন প্রবীণ শিল্পী আবদুল মান্নান, শিল্পী তানিম ও অন্যরা। রবীন্দ্রসংগীত, কবিতা পাঠ, নৃত্য এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী উদযাপন করেছে জাতীয় জাদুঘর। বেলা ১১টায় চলচ্চিত্র ‘চোখর বালি’ প্রদর্শিত হয় জাদুঘরের কবি বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে, বিকেল ৩টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা জাদুঘর প্রাঙ্গণে প্রদর্শিত হয় চলচ্চিত্র ‘শাস্তি’। সন্ধ্যা ৭টায় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। আবৃত্তি করেন সামিউল ইসলাম। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী ও পুরস্কার
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নিয়মিত আয়োজনের ধারাবাহিকতায় গত ২৪ মে জাতীয় চিত্রশালার গ্যালারিতে শুরু হয়েছে ২১তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর উদ্বোধন এবং বিজয়ী শিল্পীদের পুরস্কার দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বছরের সেরা শিল্পী হিসেবে ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার ২০১৫’ পেয়েছেন শিল্পী রুহুল করিম রুমী। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মোট ৮টি পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের অতিথিদের উত্তরীয় পরিয়ে দেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী। পরে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও বরেণ্য চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী। বিচারকদের পক্ষ থেকে কথা বলেন সমরজিৎ রায় চৌধুরী। শিল্পকলা একাডেমির সম্মানসূচক পুরস্কার ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় পুরস্কার বিতরণ পর্ব। শিল্পী মিঠুন কুমার সাহা, রুহুল আমিন, শিমুল সাহা পেয়েছেন এই পুরস্কার। ‘দীপা হক’ পুরস্কার পান শিল্পী সানা উল্লাহ। ‘বেগম আজিজুন্নেছা পুরস্কার’ জেতেন হাবিবা আক্তার। ‘ভাষাসৈনিক গাজীউল হক পুরস্কার’ পান ইফাত রেজোয়ানা। ‘এবি ব্যাংক পুরস্কার’ পান আরিফ আল করিম ভূঁইয়া। ‘এসপিবিএ’ (স্কয়ার) পুরস্কার পেয়েছেন রাসেল কান্তি দাস। ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন পুরস্কার’ জিতেছেন শিল্পী মো. আবদুল মোমেন। সবশেষে ঘোষণা করা হয় ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার ২০১৫’ প্রাপ্ত হিসেবে রুহুল করিম রুমীর নাম। পুরস্কার দেওয়র পর অতিথিরা প্রদর্শনী কক্ষে গিয়ে ফিতা কেটে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। এবারের প্রদর্শনীতে ২৬১ শিল্পীর মোট ২৭৩টি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমের পেইন্টিং, ভাস্কর্য, ছাপচিত্র, স্থাপনা ও ভিডিও স্থাপনা। প্রদর্শনী চলবে ১৩ জুন পর্যন্ত।