নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ খুন মামলার রায় : ২৬ জনের ফাঁসি
নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদ- দিয়েছেন আদালত। দুই মামলায় ৩৫ আসামির মধ্যে বাকি ৯ জনকে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদ-। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন গত ১৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা ৫ মিনিটে জনাকীর্ণ আদালতে এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিহতদের স্বজনরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। উচ্চ আদালতেও এই রায় বহাল থাকবে বলে আশা রাষ্ট্রপক্ষের। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তু আমরা চাই, এই রায় দ্রুত কার্যকর হোক। হাইকোর্টে যাতে এই রায় বহাল থাকে। চন্দন সরকারের মেয়ে সুস্মিতা সরকারও রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও বলেন, আসামিদের সাজা দ্রুত কার্যকর হোকÑ এটাই তাদের চাওয়া।
তিন বছর আগে নারায়ণগঞ্জে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর নৃশংসভাবে হত্যার পর লাশ শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে দেওয়ার ওই ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেয়।
আসামিদের অপরাধের বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ অংশ বাদ দিয়ে কেবল সাজাপ্রাপ্তদের নাম ও দ-ের পরিমাণ পড়ে শোনান তিনি। রায় ঘোষণা শুরুর আগে বিচারক বলেন, সাত খুনের ঘটনায় দুটি মামলা হলেও রায়ের ফলাফল এক ও অভিন্ন। কেবল একটি মামলায় রায় ঘোষণা করা হলে ‘স্বাভাবিকভাবে’ অন্যটি চলে আসবে। বিচারক বলেন, সাতজনকে অপহরণ, খুন, লাশ গুম, ষড়যন্ত্র ও আলামত নষ্টের অভিযোগ ‘সন্দেহাতীতভাবে’ প্রমাণিত হওয়ায় এই রায় দেওয়া হচ্ছে।
দ-প্রাপ্ত উপস্থিত ২৩ আসামি হলেন : মামলার প্রধান আসামি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি নূর হোসেন (মৃত্যুদ-), র্যাব-১১ এর সাবেক ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ (মৃত্যুদ-), মেজর আরিফ হোসেন (মৃত্যুদ-), লে. কমান্ডার মাসুদ রানা (মৃত্যুদ-), এসআই পূর্ণেন্দু বালা (মৃত্যুদ-), হাবিলদার এমদাদুল হক (মৃত্যুদ-) কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন (মৃত্যুদ-), আরওজি-১ আরিফ হোসেন (মৃত্যুদ-), ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া (মৃত্যুদ-), ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন (মৃত্যুদ-), সিপাহী আবু তৈয়ব (মৃত্যুদ-), আসাদুজ্জামান নূর (মৃত্যুদ-), নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল (মৃত্যুদ-), আলী মোহাম্মদ (মৃত্যুদ-), মিজানুর রহমান দীপ (মৃত্যুদ-), রহম আলী (মৃত্যুদ-), আবুল বাশার (মৃত্যুদ-), কনস্টেবল বাবুল হাসান (১০ বছর), ল্যান্স কর্পোরাল রুহুল আমিন (১০ বছর), সৈনিক নুরুজ্জামান (১০ বছর), আবুল কালাম আজাদ (১০ বছর), এএসআই বজলুর রহমান (৭ বছর) ও হাবিলদার নাসির উদ্দিন (৭ বছর)।
দ-প্রাপ্ত পলাতক ১২ আসামিরা হলেন : নূর হোসেনের সহযোগী বর্তমানে ভারতের কারাগারে আটক সেলিম (মৃত্যুদ-), সানাউল্লাহ ওরফে সানা (মৃত্যুদ-), নূর হোসেনের ম্যানেজার শাহ্জাহান (মৃত্যুদ-), জামাল উদ্দিন (মৃত্যুদ-), সার্জেন্ট এনামুল কবীর (মৃত্যুদ-), সৈনিক আবদুল আলিম (মৃত্যুদ-), সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী (মৃত্যুদ-), সৈনিক আল আমিন শরীফ (মৃত্যুদ-), সৈনিক তাজুল ইসলাম (মৃত্যুদ-), কর্পোরাল মোখলেছুর রহমান (১০ বছর), কনস্টেবল হাবিবুর রহমান (১০ বছর), এএসআই কামাল হোসেন (১০ বছর)।
জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন ২০১৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই মামলার আসামিদের বিচার শুরু করেন। ৩৮টি কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে মোট ১৬৪ জনের সাক্ষ্য শুনে আদালত, যাদের মধ্যে ৬০ জন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে জবানবন্দি দেন। দুপক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে গত ৩০ নভেম্বর বিচারক ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি রায়ের জন্য দিন ঠিক করে দেন।
সাত খুন : ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে অপহরণ করা হয়। একই সময়ে একই স্থানে আরেকটি গাড়িতে থাকা নারায়ণগঞ্জ আদালতের প্রবীণ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার চালককে অপহরণ করা হয়। ঘটনার তিন দিন পর বন্দর উপজেলা শান্তির চর এলাকায় শীতলক্ষ্যা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সাতজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রত্যেকের পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন; প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
নিহত ৭ জন : নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম।