প্রতিবেদন

নিজের প্রজ্বলিত আগুনে নিজেই পুড়ছে বিএনপি

শেখর দত্তঃ ‘ঘরোয়া রাজনীতি’ কথাটা প্রথম দেশবাসী শোনে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে। ১৯৭৬ সালের ৩০ জুলাই ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী করা এবং জাতীয় মূলধারার রাজনীতিকে উৎপাটন করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি ঘরোয়া রাজনীতি চালু করেন। ঘরোয়া রাজনীতির মধ্যেই তিনি একে একে রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য লাইসেন্স প্রদানের সামরিক ফরমান জারি, জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা, স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ, হ্যাঁ-না ভোটে তথাকথিত নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, নিজস্ব দল গঠন প্রভৃতি করতে থাকেন। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানি আমলে সেনাশাসক আইয়ুব খানও একই লক্ষ্যে ‘ঘরোয়া রাজনীতি’ কথাটা উচ্চারণ না করে একই কায়দায় হ্যাঁ-ভোট না-ভোট, দল গঠন প্রভৃতি করে অগ্রসর হয়েছিলেন। অদৃষ্টের পরিহাস হচ্ছে এই যে, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর আইয়ুব খানের দল কনভেশন মুসলিম লীগ এবং আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঢাকা এলেও ঘরের ভেতরেই রাজনীতি করতে বাধ্য হয়েছিল। এখনও সেই অদৃষ্টের পরিহাস। পাপ আসলে কাউকে ছাড়ে না। প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এখন জেনারেল জিয়ার দল বিএনপিকেও ঘরের ভেতরেই রাজনীতি করতে হচ্ছে।
আরও একটি পরিহাসের মধ্যে রয়েছে বিএনপি। এটা তো কারোরই অজানা নয় যে, কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের সভাপতি বা চেয়ারম্যান দলের কাজ ব্যতিরেকে দীর্ঘদিন যদি বিদেশ থাকেন, তবে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বা চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হয়। খালেদা জিয়া যেহেতু অসুস্থ বলে প্রচার করা হচ্ছে, তাই তা আরও বেশি জরুরি। কিন্তু অবাক হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে, বিএনপির এখন দেশে কার্যত কোনো সভাপতি নেই। হেডকোয়ার্টার কোথায়, ঢাকা না লন্ডন কেউ বলতে পারবেন না। একটু খেয়াল করলেই স্মরণে আসবে যে, দলটি দীর্ঘদিন পর্যন্ত চলছিল ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব দিয়ে। পরে অবশ্য ভারমুক্ত হয়ে ওই পদ পেয়েছেন বর্তমান মহাসচিব। এখন বিএনপির চেয়ারপারসন ও এক নম্বর ভাইস চেয়ারম্যান কেউ দেশে নাই। কবে কে আসবেন তাও জানা যায় না। এতদসত্ত্বেও বিএনপি কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন করতে পারছে না। এমন সব তেলেসমাতি কা- যে হচ্ছে, তা কি দলের সিনিয়র কোনো নেতার প্রতি তাদের আস্থা নাই বলে না-কি একজনকে ভারপ্রাপ্ত করলে আরেকজন বেজার বা বিক্ষোভ প্রদর্শন করবেন বলে। কে জানে কোনটা সত্য! আসলে বিএনপি দলটি যেন এখন এতিম আর তাই চলছে অদ্ভুত উটের পিঠে! জনতার ভেতর থেকে নয়, বিএনপি দলটি গঠিত হয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের মাথাকে মাথায় নিয়ে। আর এখন মনে হচ্ছে মাথাই নেই।
কোনো দলের যদি মাথা চলে যায় বিদেশের ঘরের মধ্যে, আর রাস্তায় যদি তৃণমূল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের পা না পড়ে, তবে অবস্থা যেমনটা হতে পারে, তেমনি অবস্থা হয়েছে বর্তমান দিনগুলোতে বিএনপির। যেন ধানের শীষও নেই আবার ধান গাছের গোড়াও নেই। তাই যে কোনো ইস্যুতে বিএনপির কথাবার্তা ও আচরণে টালমাতাল অবস্থা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। কে কখন কি বলেন বা বলবেন, তার যেন কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশে না থাকায় কিংবা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন না থাকায় এবং বিদেশে চেয়ারপারসন নীরব-নিশ্চুপ থাকায় বিএনপি আছে শনিরদশায়। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার ক্ষমতা এক ধমকে ছেড়ে দেওয়ার পর এমন অবস্থায় বিএনপির যে দশা হয়েছিল, এখন আবারও পড়েছে সেই অবস্থায়।
রোহিঙ্গা ইস্যুর কথাই ধরা যাক। রোহিঙ্গা প্রবেশের ইস্যু নিয়ে বিএনপির নেতারা একবাক্যে প্রথমে বলেছেন যে, রোহিঙ্গাদের প্রথমে ঢুকতে বাধা দিয়ে অমানবিক কাজ করেছে সরকার। পরে জনমতের চাপে পড়ে তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়। আর সবশেষে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ৩০ সেপ্টেম্বর হান্নান শাহের মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘যখন মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের পাঠানো শুরু করলো বাংলাদেশের ভেতরে, তখন যদি আমাদের সরকার একটা কঠিন অবস্থান নিতো যে একজন রোহিঙ্গাও ভেতরে ঢুকতে পারবে না,… তবে মিয়ানমার সরকারের সাধ্য ছিল না তাদের বাংলাদেশে পাঠানোর।’ কেমন ডিগবাজি পাঠক লক্ষ করুন। প্রথমে ছিল প্রবেশ করতে না দেওয়ার অভিযোগ আর এখন সরকারের ওপর প্রবেশের জন্য দোষ চাপাচ্ছে বিএনপি। কোনটা বিএনপির কথা কে জানে!
আরও একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেক নেতাই বলেছেন, কূটনীতিতে সরকার ব্যর্থ। জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস করাতে পারে নি। যে সব দেশ মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে, তাদের কাছে সরকার প্রতিনিধি পাঠাতে পারে নি। ইত্যাদি ইত্যাদি। এদিকে মির্জা আব্বাস ভারত সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, রোহিঙ্গা ইস্যুতে কারও আমাদের পাশে থাকার দরকার নেই। এখন ইস্যু হলো মিয়ানমার ইস্যু, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ইস্যু।’ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য বিশ্বের সব দেশের সমর্থন ও সহযোগিতার প্রয়োজন আছে না-কি নাই? বিএনপির এক মির্জা বলছেন প্রয়োজন আছে আর এক মির্জা বলছেন নাই। কোনটা বিএনপির কথা, এটা কি এখন সুস্পষ্ট করে বলতে পারবেন কেউ?
বিএনপি এখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে ‘জাতীয় ঐক্য’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২২ সেপ্টেম্বর কাজী জাফর আহমদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘সরকার রোহিঙ্গা সংকট যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। এক্ষেত্রে তারা জাতীয় ঐক্যও তৈরি করতে পারেনি।… এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে।’ একই সভায় বিএনপির থিংকট্যাঙ্কের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা বড় সমস্যা নয়। সমস্যা অন্য জায়গায়।’ তিনি ‘আটলান্টিক ও ভূমধ্যসাগরে’ বৃহৎ শক্তির শক্তি পরীক্ষা তথা ‘আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিকে’ বড় ও প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখছেন। একই সভায় ওই দুই বিপরীত প্রান্তের কথা এবং নেতাদের বিশেষত দুই মির্জার কথা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, রোহিঙ্গা নিয়ে সমস্যা সংকট কতটুকু কি, তা নিয়ে বিএনপির ভেতরেই মতদ্বৈততা রয়েছে। নিজেদের মধ্যে মতদ্বৈততা রেখে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা আর হাসির খোরাক জোগানো একই।
প্রসঙ্গত, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও বিকল্প ধারা সভাপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রমুখরাও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন। কিছু হলেই তারা জাতীয় ঐক্যের কথা তোলেন। এটাই স্বাভাবিক। বিগত নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি-জামাত জোটের সাথে মিলে যারা ভোট বয়কট করেছেন, তাদের মুখে বিএনপির শেখানো বুলি বলাই সংগত। প্রশ্ন হলো, জাতীয় ঐক্যের স্লোগান না তুলে তারা তো প্রথমে নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে পারেন। বিএনপি-জামাতের ২০-দলীয় ঐক্যজোটে যদি গণফোরাম, বিকল্প ধারা প্রভৃতি দল যোগ দেয়, তবে তো ষোলোকলা পূর্ণ হয়। বদরুদ্দোজা চৌধুরী তো আগের অপমান গায়ে না মেখে কিছুদিন আগেও বিএনপি জোটের দিকেই পা বাড়িয়েছিলেন। এখন আবার বাইরে এসে এমনটা বলার উদ্দেশ্য কি? জোটে পুরোপুরি যোগ দিলেই তো সবটা চুকে যায়। কেননা যা আছে ভেতরে ভেতরে বা পরোক্ষ, তা প্রকাশ্যে আসে। জনগণের কাছে সব পরিষ্কার হয়ে যায়। আসলে জামাতকে আবারও জাতে তোলার কতই না প্রচেষ্টা!
ভাবতে অবাক লাগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম জামাতকে সাথে নিয়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার কথা বলছেন। অথচ এটা সুস্পষ্ট যে, জামাত দলটি মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে এখনও স্বীকার করেনি। মানবতাবিরোধী যুদ্ধবিরোধী কাদের মোল্লার বিচারে ফাঁসি হওয়ার পর পাকিস্তান পার্লামেন্টের বক্তব্য এবং প্রকাশ্যে গৃহযুদ্ধ বাধানোর উসকানি থেকে প্রমাণিত হয়, পাকিস্তানি কানেকশন পূর্বাপর বিএনপি-জামাত জোটের রয়েছে। সর্বোপরি রাজখোর ও অনুপ চেটিয়া গংদের জন্য বাংলাদেশের মাটিকে অভয়ারণ্য করা হয়েছিল যে পাকিস্তানের আইএসের সাথে সংযোগ করে এটাও আজ সুস্পষ্ট। একাত্তরের পরাজিত শত্রু যারা পাকিস্তানের সাথে কানেকশন রেখে বা হাত মিলিয়ে রাজনীতি করতে চায়, যারা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক শক্তির দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়াতে মরিয়া; তারা হয় ‘পাগল’ অর্থাৎ জাতে মাতাল তালে ঠিক অথবা ‘শিশু’ অর্থাৎ এখনও সবটা বুঝে উঠতে পারে নাই। কোনটা বিএনপি তা এখন খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়াকেই ঠিক করতে হবে!
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আরও বলেছেন, এই ইস্যুতে ‘সরকার ব্যর্থ’ এবং ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান এবং ১৯৯২ সালে খালেদা জিয়া না-কি তাদের যথাযথভাবে আশ্রয় দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। এদিকে রুহুল কবির রিজভী শরণার্থী শিবির ঘুরে এসে জিয়া ও খালেদা জিয়া আমলের প্রশংসায় গদগদ হয়ে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরে বলেছেন, ‘এখনও পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে নাই। দিশেহারা রোহিঙ্গারা ছুটোছুটি করছে।’ লক্ষণীয় এই যে, সাম্প্রতিক বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসায় সারাবিশ্ব যখন পঞ্চমুখ, তখন বিএনপি এসব কথা বলছে। অথচ এরাই আবার বলছে, যেমন মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষায় ‘রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তার দল রাজনীতি করবে না।’ রাজনীতি তো তারা করছেন। নতুবা রিলিফ নিয়ে ছুটোছুটি দলের নেতারা করছেন কেন? প্রসঙ্গত, বিএনপি নেতারা জিয়া আমলে রোহিঙ্গা শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় গদগদ ভাব দেখে তথ্য-উপাত্ত খুঁজে দেখতে সচেষ্ট হই। দেখলাম ১৯৭৮ সালের ৮ মে একদিনেই কলেরায় ৫০ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছিল।
আর ২৮ মে বার্মা যখন গুনফুম সীমান্তে গুলিবর্ষণ করেছিল তখন কি করেছিলেন তখনকার সেনাশাসক জিয়া। নতজানু পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে দ্রুততার সাথে ৭ জুন রেঙ্গুন ছুটে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা তাদের সাথে আলোচনা করেছিল। আর এবার! কূটনৈতিক তৎপরতা যথাযথ হওয়াই কয়েক দিনের মাথায় ছুটে এসেছেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলের অং সান সু চি’র দফতরের মন্ত্রী কিউ টিন্ট সোয়ে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবসানের জন্য মিয়ানমারকে চুক্তির একটি খসড়া বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে। মিয়ানমার শরণার্থী ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে বলেও জানা যায়। সর্বোপরি দুই দেশের একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে। ক্ষুদ্র এ কলামে তখন কূটনৈতিক তৎপরতায় জাতিসংঘ কতটা সক্রিয় ও সরব ছিল আর এখন কতটুকু তা এখানে তুলে ধরা হলো না। সবশেষে এটুকুই বলা যায়, বিএনপির দুই আমলে যদি শরণার্থী সব ফেরত পাঠানোই হয়, তবে দেড় লাখ শরণার্থী বাংলাদেশে আগে থাকতেই ছিল কীভাবে? কীভাবে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে! বিএনপি আসলে অভিভাবক হারা হয়ে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে। আর তাই কাচের ঘরে বসে ঢিল ছুড়ছে।
বিএনপি আজ আসলেই কতটা হতচ্ছাড়া অবস্থায় আছে তা বুঝা যাবে, এবারের দুর্গাপুজোয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য বিবেচনায় নিলে। ২৯ সেপ্টেম্বর নেত্রী খালেদা জিয়ার শুভেচ্ছা বাণী বহন করে নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, দেবী দুর্গা অবির্ভূত হয়েছিলেন পৃথিবীতে অসুরকে পরাজিত করার জন্য, অন্যায়কে পরাজিত করার জন্য, সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। দেবী দুর্গা পরাজিত করেছিলেন অসুরকে, অসত্যকে, অসুন্দর ও অন্যায়কে। সেজন্য দুর্গাপূজা সকলের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পূজা।’ সেখানে উপস্থিত ছিলেন এমন একজনের কাছে শুনেছি, এমন বক্তব্যই দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। ‘বিশ্বাস করি’ ও ‘সকলের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ কথাগুলো কি তিনি মনে থেকে বলেছেন? অতীত কি বলে? এই কথাগুলো কি জামাতসহ ২০-দলীয় জোট বন্ধুদের কানে পৌঁছেছে? নেত্রী খালেদা জিয়া কি দেখেছেন পত্রিকা পড়ে কি বাণী তার মহাসচিব বহন করে নিয়ে গেছেন। উল্লিখিত কথায় সনাতন ধর্মাবলম্বী হিসেবে আমার খুশি হবারই কথা। কিন্তু খুশি হবেন কি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষেরা! জানি না। তবে এটুকু জানি, আমাদের জাতীয় অবস্থান হচ্ছে দেবী পূজা ও আরাধনার দিকটা হিন্দু সম্প্রদায়ের আর উৎসবের দিকটা সকল জনগণের। মাথা নেই, নেই পায়ের তলায় মাটি। আর তাই বক্তৃতা-বিবৃতিতে সব কিছু হ-য-ব-র-ল বানিয়ে ফেলছে দলটি। এ রকম করতে থাকলে শ্যাম ও কূল দুই-ই হারাবে বিএনপি।
প্রসঙ্গত, কাজী জাফর আহমদের ওই শোকসভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন যে, ‘বিএনপি সত্যিকার অর্থে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও দেশপ্রেমিক দল। তাই সরকার বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা চায় না। কোনো কিছুর বিনিময়ে এই দল জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেবে না।’ প্রতিনিয়ত এমন কথা বলা হয় বিএনপির পক্ষ থেকে। বারবার এমন ধরনের কথা বলার অর্থ হচ্ছে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। ঠাকুর ঘরে কে রে আমি কলা খাই না প্রবাদের মতো। আসলে বিএনপি প্রতিনিয়ত বুঝাতে চাইছে তারা সমঝোতা চায় কিন্তু সরকারি জোট সমঝোতা চায় না। বিএনপি আসলে মানুষকে বোকা ভাবে। সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি জাতীয় স্বার্থ ঊর্র্ধ্বে তুলে ধরে নির্বাচনে বিএনপিকে না আনতে চাইতেন, তবে বিগত নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করতেন না। আর টেলিফোনে খারাপ ব্যবহার করার পরও পুত্র কোকোর মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে খালেদা জিয়ার বাসার মতো অফিসে যেতেন না।
প্রকৃত বিচারে বিএনপি সমঝোতা চায় না। অস্থির ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নিজের নাক কেটে হলেও অবৈধ শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে চায়। সার্বিক বিচারে জামাত ও উগ্রবাদীদের সাথে জোট বেঁধে বিএনপি একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চায়। এটা কার না জানা যে, প্রতিশোধ স্পৃহা আর হত্যা-খুনের রাজনীতি থেকে কখনও ভালো ফল আশা করা যায় না। এমন রাজনীতির ফল হচ্ছে, আগুন নিয়ে খেলা এবং নিজের ধ্বংস ডেকে আনারই নামান্তর। সবশেষে বিগত নির্বাচনের সময়ে আর সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তিতে নির্বাচন বয়কট করে নাশকতার পথে গিয়ে, আগুন সন্ত্রাস নিয়ে নিরীহ মানুষ ও পুলিশ মেরে বিএনপি আসলে যে আগুন জ্বালিয়েছে; সেই আগুনেই এখন দ্বগ্ধ হচ্ছে দলটি। যদি তেমনটা না হতো তবে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডন গিয়ে এতদিন চিকিৎসার নামে নীরবে ঘরে বসে থাকতেন না। আর তারেক জিয়াকে পালিয়ে লন্ডন থাকতে হতো না।
সবশেষে এটাই বলি রাজনীতিকদের পালিয়ে বিদেশ চলে যাওয়া বাংলাদেশের রাজনীতির ঐতিহ্যের সাথে খাপ খায় না। ওটা পাকিস্তানি রাজনীতির ধারা। আমাদের ঐতিহ্য হচ্ছে সাহসের সাথে দেশে থেকে যৌক্তিক ও নৈতিক অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা। পাকিস্তানি আমলে আমাদের জাতীয় রাজনীতির মূলধারার নেতারা আত্মত্যাগের সেই পথই আমাদের দেখিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ১/১১-এর জরুরি আইনের আর্মি ও সুশীল সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিদেশ থেকে স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন। আর উল্টো দিকে পাকিস্তানি আমলে সেনাশাসক প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জা পালিয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি হোটেলে কাজ করতেন বলে জানা যায়। তারেক জিয়া এখন কীভাবে অর্থ জোগাড় করে বিদেশে থাকছেন, মা খালেদা জিয়াকে কীভাবে চিকিৎসা করাচ্ছেন এবং হঠাৎ নীরব হয়ে তলে তলে কি করছেন, তা নিয়ে নানা গুজব এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে। এদিকে খালেদা জিয়ার দেশে ফিরে আসা নিয়েও নানা গুজব ধূমায়িত হচ্ছে। খালেদা জিয়া দলীয় নেতা-কর্মীদের এতিম বানিয়ে বিদেশে থেকে যাবেন বলে মনে করি না। শেষ বয়সে এতটা নিষ্ঠুর হবেন বলে মনে হয় না।
কিন্তু তারেক জিয়া! ‘হাওয়া ভবন’ খ্যাত এই নেতার নৈতিকতা ও সৎ সাহস থাকলে আইনানুগভাবে দেশে ফিরে এসে সাহসের সাথে মামলা মোকাবিলা করা দরকার। যদি তিনি তা না করেন এবং খালেদা জিয়াও দেরি করতে থাকেন, তবে নিজেদের সৃষ্ট ঘরোয়া রাজনীতির ঘেরাটোপে পড়ে এতিম বিএনপির কপালে নিঃসন্দেহে আরও দুঃখ আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *