নির্বাচন কমিশনে আওয়ামী লীগের প্রস্তাব
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সৃজন করতে শুরু করেন। মাত্র ৯ মাসের মধ্যে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’ প্রণয়ন করে দেশ পরিচালনা ও মানুষের অধিকার সংরক্ষণের সকল বিষয়ের সুস্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত বিধান নিশ্চিত করেন। এই সংবিধানে Executive, Legislative I Judiciary এমন কী বর্তমান সময়ের Media I Civil Society–সহ প্রতিটি বিভাগের জন্য সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা সন্নিবেশিত হয়, যার আলোকে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সকল সংস্থা গঠিত ও পরিচালিত হতে থাকে।
ক্স বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ই ১৯৭২ সালে প্রণীত The Representation of the People Order-সহ নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, যার অধীনে ১৯৭৩ সালে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এই সময়ের মধ্যেই ধারাবাহিকভাবে দেশের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান সুসংগঠিত হয়ে উঠতে শুরু করে। গণতন্ত্র, সুশাসন ও উন্নয়নের প্রতিটি পর্যায়ে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিত অপশক্তি ও তাদের এ দেশীয় দোসররা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ রাতের আঁধারে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্তব্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা। খুনিচক্রের এই ভয়াবহতম নৃশংসতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী সকল মানুষ বাকরুদ্ধ ও হতভম্ব হয়ে পড়েন।
ক্স এই হত্যাকা-ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই, হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের হোতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ও সেনা আইন লঙ্ঘন করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের সংবিধান ও সকল প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ধ্বংস করে দেন। শুরু হয় স্বৈরশাসনের।
এই স্বৈরশাসক তার অবৈধ ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেয়ার অভিপ্রায়ে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে হ্যাঁ/না ভোটের আয়োজন করেন এবং তার পক্ষে হ্যাঁ ভোট প্রদানের সকল আয়োজন সম্পন্ন করেন। জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে তার নিয়োজিত সন্ত্রাসী বাহিনী নির্বিচারে ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে তোলে। প্রহসনের এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ যেমন তাদের ভোটাধিকার হারিয়ে ফেলেন অপরদিকে সকল গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়ে যায়। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যখন জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ক্ষমতা দখলকারী অপর স্বৈরশাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসনকালের অবসান ঘটে।
১৯৮১-৯১ সাল পর্যন্ত জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ও প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার যে সংগ্রাম করে আসছিলেন স্বৈরশাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে তার প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়। জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রত্যাবর্তন ঘটে। ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শুরু হলেও এর কার্যকর প্রতিফলন ঘটতে শুরু করে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় হতে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের পর সাবেক স্বৈরাচারের রাজনৈতিক দল বিএনপি, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সক্ষম হয়। জনমানুষের নির্বিঘœ ও নিরাপদে ভোটাধিকার প্রয়োগের পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তারা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই বেগম খালেদা জিয়া তার স্বামী স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আবারও কলুষিত করে তোলেন। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়।
ক্স ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ঢাকা (মিরপুর ও তেজগাঁও) ও মাগুরার উপনির্বাচনে এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সকল রাজনৈতিক দল কর্তৃক বর্জিত ও ভোটারবিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে নজিরবিহীন কারচুপি ও অন্যায় সংঘটিত হয় তা বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা করে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল কর্তৃক বর্জিত ও ভোটারবিহীন এই অবৈধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা দখল করে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনিদের রাজনৈতিক দল (যা বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত) ‘ফ্রিডম পার্টি’কে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের আসনে বসায়। এই অবস্থার মধ্য দিয়ে বিএনপি নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সকল কিছুই ধ্বংস করে দেয়। ফুঁসে ওঠে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণ। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত আন্দোলনের ফলে বেগম খালেদা জিয়া ৩০ মার্চ ১৯৯৬ ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়ে পুনরায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর এই প্রথম দেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল স্তরের কার্যকর পুনর্গঠন শুরু হয়।
একটি স্থায়ী ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থাপনার গুণগত পরিবর্তন আনয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের অপশাসনের প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে সম্মুখ পথে অগ্রসর হওয়া ছিল খুবই কষ্টকর। স্বাধীনতা-বিরোধী পরাজিত শক্তির যড়যন্ত্রের ফলে ২০০১-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক গৃহীত সকল উদ্যোগ বন্ধ করে দিয়ে দেশকে আবারও পিছন দিকে ঠেলে দেয়।
২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে পরাজিত করার জন্য পরিকল্পিত উপায়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থাকে ব্যবহার করে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। এ সময় নির্বিচারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে এমন সকল ভোটার বিশেষত ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এক নারকীয় তা-ব চালানো হয়। বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় তাদের নির্বাচনী এলাকা থেকে বিতাড়িত করা হয়। অনেক নেতাকর্মীকে পঙ্গু এবং মারাত্মকভাবে জখম ও হত্যা করা হয়। অন্যায়ভাবে গ্রেফতার ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন জনমনে ব্যাপক ভীতির সঞ্চার করা হয়, অপরদিকে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে এমন ব্যক্তিদের ভোটকেন্দ্রে যেতে নিষেধ করা হয়।
নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে কেবলমাত্র ‘নৌকা’ প্রতীকে ভোট দেয়ার অপরাধে, ক্ষেত্রবিশেষে শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় গিয়ে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, রাজশাহী, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী এবং সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, যশোর, খুলনাসহ দেশের প্রায় সকল জেলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যসহ আওয়ামী নেতা-কর্মীদের ওপর এক বিভীষিকাময় সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করে।
ক্স এ সময় শিশু পূর্ণিমা, রাজুফা, ফাতেমা, মাহিমাসহ অগণিত নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করা হয়। ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’-এর নামে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে এমন জনমানুষের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার ও অনেককে বিনাবিচারে হত্যা করা হয়।
২০১০ সালে মহামান্য আদালতের নির্দেশনায় বিএনপি-জামাত কর্তৃক পরিচালিত নারকীয় তা-বের বিষয়ে তদন্ত করে দেখার জন্য একটি বিশেষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়Ñ
ক্স ২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামাতের চারদলীয় জোটের সন্ত্রাসী দ্বারা ৪৩ জেলায় ৬২টি স্থানে ৩৪২ জন শিশুকে ধর্ষণ, নির্বিচারে গণধর্ষণ, লুণ্ঠন, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। অধিকাংশ জায়গায় নারী ও শিশু কন্যাদের টার্গেট করে হামলা চালানো হয় এবং জমি, বসতবাড়ি ও দোকানসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয়া হয়।
ক্স বাগেরহাটের ফকিরহাটে বাবা-মা’র সামনে ১৩ বছরের একটি মেয়েকে ২২ জন ধর্ষণ করে হত্যা করে। কত বীভৎস ও পাশবিক হতে পারে তাদের নির্মমতা, তা এই একটি ঘটনার মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে।
তদন্ত কমিশন অনুসন্ধানকালে ৩ হাজার ৬২৫টি ঘটনার সত্যতা পায়, যার মধ্যে ৩৫৫টি খুন এবং ৩ হাজারের ওপর ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটের ঘটনা রয়েছে। বিএনপি-জামাতের এই বর্বরতা তাদের অবশিষ্ট শাসনকালেও অব্যাহত থাকে। ২০০৩-০৬ পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে সীমাহীন কারচুপি ও নির্বাচন-পরবর্তী পৈশাচিকতার বিষয়ে “A Rigged Election and an Illegitimate Government (Bangladesh Election 2001)Ó Ges ” এবং “Valley of Death”-সহ অনেক গ্রন্থে এর মর্মস্পর্শী বিবরণ রয়েছে, যা ঐ সময়কার বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারিত হয়।
ক্স কার্যত প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা না থাকায় তৎকালীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে জনমানুষকে এই নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়।
ক্স ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামাত জোটের শাসনকালে একদিকে যেমন সারাদেশে ‘বাংলাভাই’-এর নেতৃত্বে জঙ্গিবাদ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতা তার স্বরূপে আবির্ভূত হয়, অপরদিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক জিয়ার নেতৃত্বাধীন হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক দুর্নীতি ও দুঃশাসনের কালো ছায়ায় বাংলাদেশ প্রায় একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ২০০১ সালের ন্যায় কারচুপির মাধ্যমে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার জন্য প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার দিয়ে বিএনপি-জামাত জোট যে ভোটার তালিকা তৈরি করে তা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নিকৃষ্ট প্রহসন।
ক্স এমনকি মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিশেষ উদ্দেশে জেলা ও উপজেলা নির্বাচন অফিসার হিসেবে নিয়োগ প্রদানসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের চরম অপব্যবহার করে বাংলাদেশের সামগ্রিক নির্বাচন ব্যবস্থাকেই বিনষ্ট করে দেয়া হয়।
কিন্তু, আবারও ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামাত জোটের পতন ঘটে এবং সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বিএনপি-জামাত জোটের শাসনকালে (২০০১-০৬) নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল এবং মহাজোটের অন্যান্য শরিক দল নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে একটি অভিন্ন রূপরেখা ঘোষণা করেন। এই রূপরেখায় নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা এবং নির্বাচনী আইন ও বিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে মোট ৩০ দফা সুপারিশ করা হয়।
এই সব প্রস্তাব সকল প্রচার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত ও আলোচিত হয়। প্রস্তাবসমূহের প্রতি দেশপ্রেমিক সকল নাগরিক ও সুশীল সমাজ অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। জনগণের দাবির মুখে তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকার, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলকে জাতীয় সংসদে প্রস্তাব পেশ করতে আহ্বান জানান। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে প্রস্তাবগুলি উত্থাপন করেন। তারপর সুদীর্ঘ সময় সরকার নানা কূটকৌশলের মাধ্যমে কালক্ষেপণ করতে থাকে এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, বিএনপির মহাসচিব এবং তাদের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সময়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দিয়ে জনমতকে বিভ্রান্ত করার সব রকম প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু দেশি-বিদেশি সকল চাপ উপেক্ষা করতে না পেরে একপর্যায়ে তারা আলোচনায় বসতে সম্মত হলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল কর্তৃক উপস্থাপিত দাবিসমূহের প্রতি কোনোরূপ ভ্রুক্ষেপই করেন নি। কারণ তারা জানতেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।
ক্স ১৪ দল কর্তৃক উপস্থাপিত প্রস্তাবগুলো ছিল অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও যুক্তিযুক্ত, যাকে প্রধান ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়Ñ
(১) নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামোগত বিষয়
(২) নির্বাচনের পদ্ধতিগত ও বিধিবিধানের বিষয় এবং
(৩) নির্বাচনকালীন অন্যান্য বিষয়াবলী। কিন্তু, জনরোষের মুখে ২০০৬ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারে বিএনপি-জামাত জোটের এই অনীহা অব্যাহত থাকে।
অবশেষে, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে প্রবল জনমতের চাপে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে ১৪ দল উপস্থাপিত দাবিসমূহকে সক্রিয় বিবেচনায় নেয়া হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল কর্তৃক পূর্বে প্রদত্ত ৩০ দফাকে আরও পরিশীলিত করে সর্বমোট ২৩ দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়।
ক্স বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২৩ দফার ওপর ভিত্তি করেই ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের প্রচলন নির্বাচনে পেশিশক্তি ও অর্থের ব্যবহার বন্ধ; নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছুক প্রার্থীর সম্পদের বিবরণী প্রকাশ, চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরপরই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ বন্ধ করা, তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে সম্ভাব্য জনপ্রতিনিধির তালিকা প্রণয়ন এবং সেখান থেকে মনোনয়ন প্রদান, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্য থেকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার নিয়োগসহ যে যে প্রক্রিয়ায় একটি নির্বাচন কলুষিত হতে পারে তার বিভিন্ন সংস্কার সাধন করা হয়। বিএনপি-জামাত জোটের নির্দেশনায় প্রণীত ভৌতিক ভোটার তালিকা হতে ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার বাদ দেয়া হয়।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে জয়যুক্ত হয়ে পুনরায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। শুরু হয় নতুন দিনের পথ চলা। ১৯৭১-৭৫ এবং ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে যে সকল জনমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল তা পুনরায় প্রাণ ফিরে পায়। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানকে’ স্বরূপে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, আইন সভা ও নির্বাহী বিভাগসহ সকল স্তরে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতি সাধনে ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা গৃহীত ও বাস্তবায়িত হতে শুরু করে।
ক্স ইতোমধ্যে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন কমিশনের জন্য স্থায়ী সচিবালয় এবং নির্বাচন কমিশনের জন্য আর্থিক স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা হয়েছে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও আধুনিকায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে এবং সময়ে সময়ে প্রয়োজনমতো সকল ধরনের সংস্কার সাধন করা হচ্ছে। অর্থাৎ, এক কথায় একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার জন্য যা যা করা দরকার তার প্রায় সকল কিছুই পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এমন কী সার্চ কমিটির মাধ্যমে সর্বজন গ্রাহ্য ব্যক্তিদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংবিধান অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগদানের প্রক্রিয়া গৃহীত হয়েছে। একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের সংস্কার এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার উন্নয়নে যে সকল গুণগত পরিবর্তন এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই সম্পন্ন হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক দেশ পরিচালনার সময়ে।
১৯৭২ সালের ঞযব জবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ ড়ভ ঃযব চবড়ঢ়ষব ঙৎফবৎ (নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত) প্রণীত হওয়ার পর দীর্ঘ সময়ে নির্বাচন সংক্রান্ত ২-৩টি অধ্যাদেশ/আইন প্রণয়ন করা হলেও প্রয়োজনীয় সকল আইন বা অধ্যাদেশই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯-১৬ এই সময়ের মাঝে সম্পাদিত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন সংক্রান্ত প্রায় ৩২টি অধ্যাদেশ/আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আর এ সকল কিছুরই একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা; অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী মানুষের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করা।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনে আগ্রহী বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে যাতে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে লক্ষ্যে একদিকে যেমন পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যায় নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয় অপরদিকে নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য (তফসিল ঘোষণার সময় হতে) ব্যতিক্রমীভাবে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সকল দলের অংশগ্রহণে একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক বারবার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি-জামাত জোট উক্ত সরকারে বা নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
ক্স নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং ঐ সময়ের বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানান, এমনকি তাদের পছন্দনীয় নির্বাহী বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পণেরও প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু বিএনপি-জামাত জোট নেত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ও দেশের বিরাজমান সকল আইন-কানুনের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন।
বিএনপি-জামাতের এই অশুভ জোট নির্বাচন বা নির্বাচনকালীন সরকারে অংশগ্রহণের পরিবর্তে নির্বাচন প্রতিহত করার নামে সারাদেশে এক নজিরবিহীন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে মেতে ওঠে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ভূলুণ্ঠিত করার অভিপ্রায়ে তারা একদিকে যেমন নির্বাচনী কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ করে অপরদিকে গণপরিবহন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষের যানবাহন ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনায় পেট্রল বোমা মেরে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে সারাদেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এমনকি সরাসরি গণমানুষকে লক্ষ করে পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করে; যার ফলে বহু মানুষ নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করে ও অসংখ্য মানুষ মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছে। দেশি-বিদেশি নানা ধরনের অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে আক্রমণ চালায়।
বিএনপি-জামাত জোট এবং তাদের পূর্বসূরি স্বৈরশাসকদের শাসনকাল পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় সহজেই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে, এই অপশক্তি কখনোই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী নয়।
ক্স বিএনপি ও জামাতের সমর্থন ও প্ররোচনায় ২০১৩ সালে হেফাজতিদের তা-ব, নির্বাচিত সরকার পতনের নীল নকশা; ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভ-ুল করে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করার অপচেষ্টা এবং ২০১৫ সালের পেট্রল বোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে ও অর্থ-সম্পদ ধ্বংস করে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে থামিয়ে দেয়া, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজকে ভ-ুল করা, গণতন্ত্র ধ্বংস এবং জনগণের ম্যান্ডেটের পরিবর্তে অন্য কোনো অবৈধ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে জনগণের সহায় সম্পদ লুণ্ঠন করাই এই জোটের প্রধান লক্ষ্য।
জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে গণতন্ত্র ও জনমানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অঙ্গীকারাবদ্ধ। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিবেশী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যায় বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও আইনের মাধ্যমে একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশনে পরিণত করা হয়েছে। সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধান করা হয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও যদি কোনো গোষ্ঠী বা সংস্থা দেশের সংবিধান বা বিরাজমান আইন-কানুনের বাইরে গিয়ে অন্য কোনো পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে তা দেশের শান্তিকামী জনগণ কখনই মেনে নিবে না।
সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন
স্বাধীনতার পর হতে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেগম খালেদা জিয়া ও তার পূর্বসূরি স্বৈরশাসক এরশাদ ও জিয়াউর রহমানের শাসনকালে নানাভাবে সমগ্র নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বারবার কলুষিত করা হয়েছে। এমনকি অবৈধভাবে ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া বিএনপি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বঘোষিত খুনিদের দিয়ে রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করে সেই রাজনৈতিক দলকে নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে তাকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের আসনে বসায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াত-ই-ইসলামী এবং বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিদের রাজনৈতিক দল ফ্রিডম পার্টির হাতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে, শুধু যে নির্বাচন ব্যবস্থারই ধ্বংস সাধন করা হয়েছিল তাই নয়, এই অপশক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকেই নস্যাৎ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে সকল বিষয়গুলি অতীব গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ
১. একটি স্বাধীন ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন।
২. নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাহী বিভাগের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/সংস্থার দায়িত্বশীলতা।
৩. নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও এর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের দায়িত্বশীল ও নিরপেক্ষ আচরণ।
৪. ছবিযুক্ত একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা এবং ভোট গ্রহণের দিন নির্বাচন কেন্দ্রের সার্বিক নিরাপত্তা।
৫. নির্বাচন পরিচালনায় বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের পরিবর্তে কেবলমাত্র প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা/কর্মচারীদের প্রিজাইডিং অফিসার/সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার/পোলিং অফিসার পদে নিয়োগ করা।
৬. আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যদের নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল আচরণ।
৭. দেশি/বিদেশি পর্যবেক্ষক থেকে শুরু করে মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটির সদস্যদের নির্মোহ তৎপরতা।
৮. নির্বাচনে পেশিশক্তি ও অর্থের প্রয়োগ বন্ধ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ সকল পর্যায়ের ভোটারের অবাধ ভোটদানের সুযোগ নিশ্চিত করা।
৯. নির্বাচনের পূর্বে ও পরে এবং নির্বাচনের দিন ভোটারসহ সর্বসাধারণের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
১০. নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার জন্য আবশ্যকীয় সকল সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে ন্যস্ত করা। এবং
১১. নির্বাচনকালীন সরকারের কর্মপরিধি কেবলমাত্র আবশ্যকীয় দৈনন্দিন (রুটিন) কার্যাবলীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা।
ওপরে বর্ণিত বিষয়সমূহ তখনই সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পাদিত হতে পারে যখন প্রতিটি সংস্থা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করবে।
সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকর ভূমিকার পাশাপাশি নির্বাচন প্রত্যাশী সম্ভাব্য জনপ্রতিনিধি নির্বাচন (ঝবষবপঃরড়হ) করার ক্ষেত্রেও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের গণতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীল আচরণও খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দৃষ্টান্ত অনুসরণযোগ্য।
ক্স বাংলাদেশ আওয়ামী লীগই সর্বপ্রথম ২০০৮-এর নির্বাচনে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ভোটের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী প্রার্থীদের বাছাই করে পরবর্তীতে নির্বাচন পরিচালনার জন্য সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় নির্বাচনী বোর্ডের মাধ্যমে প্রার্থী চূড়ান্ত করে। প্রায় ১০ (দশ) লক্ষ নেতাকর্মী এই প্রক্রিয়ায় শামিল হয়ে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেন।
২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবং বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও প্রার্থী বাছাইয়ের এই ধারা অব্যাহত থাকে। ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রার্থী বাছাইয়ের এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বদ্ধ পরিকর।
নির্বাচন প্রক্রিয়ার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কর্তৃক নিয়োজিত পোলিং এজেন্টদের ভূমিকা। নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে পোলিং এজেন্টদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকলে এবং সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কেন্দ্রের ভোটারদের মধ্য থেকে পোলিং এজেন্ট নিয়োগ করা হলে নির্বাচনে জাল ভোট প্রয়োগের প্রবণতা প্রায় বন্ধ করা সম্ভব। বিভিন্ন সময়ে লক্ষ্য করা গেছে প্রধান দুই/একটি রাজনৈতিক দল ব্যতীত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পোলিং এজেন্টগণ হয় নির্বাচন কেন্দ্রে যান না অথবা নির্বাচন শুরু হওয়ার ২/১ ঘণ্টার মধ্যেই নির্বাচন কেন্দ্রের বাইরে এসে মনগড়া বিভিন্ন গুজব ছড়াতে থাকে। এ লক্ষ্যে যদিও নির্বাচন আচরণ বিধিমালা প্রণীত হয়েছে, তথাপি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দল কর্তৃক নিয়োজিত পোলিং এজেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বাধিক সর্তক হওয়া আবশ্যক।
সুষ্ঠু, অবাধ ও সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা। এই দুটি বিষয়কে পরিপূর্ণতা দেওয়ার জন্যই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছেন, যার সুফল আজকের নির্বাচন কমিশন।
ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও ই-ভোটিং এর প্রবর্তন, নির্বাচনে অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যবহার রোধে নানাবিধ আইন ও বিধি প্রণয়ন, নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা তৈরি, তৃণমূলের ভোটের মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই, দেয়াল লিখন ও রঙিন পোস্টারের পরিবর্তে সাদা-কালো পোস্টারের প্রবর্তন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় স্থাপন এবং নির্বাচন কমিশনকেই তাদের নিজস্ব জনবল নিয়োগের ক্ষমতা অর্পণ, প্রয়োজনীয় আর্থিক তহবিল প্রদান, সাধারণ প্রশাসনের ওপর নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধান, নির্বাচনী অপরাধ প্রতিরোধে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ও জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পর্যাপ্ত সংখ্যক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, এবং যানবাহনের নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামগ্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যে দৃশ্যমান উন্নতি সাধিত হয়েছে তার সকল কিছুর মূলে রয়েছে আওয়ামী লীগ কর্তৃক উপস্থাপিত ২৩ দফা। এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাংবিধানিক পদের অধিকারীদের সমন্বয়ে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইলেকশন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
‘বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন’ পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে সর্বাধিক সক্ষমতা ও দক্ষতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম হচ্ছে। নির্বাচনে জনমানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিতকল্পে দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।