পাকিস্তানের ঔদ্ধত্য ও নির্লজ্জ মিথ্যাচার
আবারও চরম ঔদ্ধত্য দেখাল পাকিস্তান। এবার ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নির্লজ্জ মিথ্যাচার করল বিশ্বে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত দেশটি। একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যার অসংখ্য দলিল দেশে-বিদেশে রয়েছে। এমনকি পাকিস্তান সরকার গঠিত হামদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টেও একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকেই দায়ী করে তাদের বিচারের সুপারিশ করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও পাকিস্তান সব ধরনের শিষ্টাচার ও মানবিক বোধের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়ে ইতিহাসের ভয়ঙ্কর সেই গণহত্যায় তাদের দায়ের কথা অস্বীকার করল। গত ৩০ নভেম্বর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসলামাবাদে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার মৌসুমী রহমানকে ডেকে বলেছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বা নৃশংসতার কোনো ঘটনা ঘটেনি কিংবা এ ধরনের ঘটনার জন্য পাকিস্তানের কোনো দায় ছিল না। গত ২২ নভেম্বর দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামাতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদ-ের রায় কার্যকর করার পর থেকেই পাকিস্তান ও দেশটির বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ করে আসছে। তাদের পক্ষে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সাফাই ও উদ্বেগের কথা জানায়। পরে বাংলাদেশের দেওয়া প্রতিবাদপত্রটিও প্রত্যাখ্যান করার কথা জানায় পাকিস্তান। ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, পাকিস্তান পুরোপুরি অসত্য তথ্য দিয়েছে। কারণ শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, পুরো বিশ্ব জানে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে কী ধরনের নৃশংসতা চালিয়েছিল। এখন পাকিস্তান অস্বীকার করলেই ইতিহাসের সত্য মুছে যাবে না। তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালের চুক্তি নিয়েও পাকিস্তান ভুল তথ্য এবং বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়েছে, যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেছেন, পাকিস্তানের সরকার গঠিত হামদুর রহমান কমিশনই সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর গণহত্যা ও গণধর্ষণের দালিলিক প্রমাণ দিয়েছে। এখন এই সত্য অস্বীকার নির্লজ্জতারই শামিল।
একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান করেছে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটি। কমিটির প্রধান ডা. এমএ হাসান বলেছেন, একাত্তরে গণহত্যার সুস্পষ্ট দালিলিক প্রমাণ তার কাছেও রয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে অসভ্য বলেই তারা এ ধরনের মিথ্যাচার করছে।
পাকিস্তানের আপত্তিকর বিবৃতিতে যা আছে : পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, একাত্তরে বাংলাদেশে নৃশংসতার জন্য পাকিস্তানের কোনো দায় নেই, একাত্তরে নৃশংস ঘটনার ব্যাপারে বাংলাদেশের যে দাবি তার ভেতরেও সত্য নেই। এ কারণে গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ যে প্রতিবাদ নোট দিয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করছে পাকিস্তান।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পাকিস্তান বাংলাদেশের সাথে ভ্রাতৃত্বসুলভ সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। পাকিস্তান বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক শুধু রক্ষাই করতে চায় না, বরং সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ পাকিস্তানের এই মনোভাবকে শ্রদ্ধা করছে না।
পাকিস্তানের বিবৃতিতে দাবি করা হয়, ১৯৭৪ সালের চুক্তি দুদেশের সম্পর্কের মূল ভিত্তি তৈরি করেছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ একাত্তরের ঘটনার ব্যাপারে কোনো বিচার করবে না, বরং বিষয়টি ক্ষমার দৃষ্টিতেই দেখবে। একই সাথে পাকিস্তানের জনগণ বাংলাদেশের সাথে একাত্মতা অনুভব করে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় একটি মুসলিম দেশ প্রতিষ্ঠায় তাদের ঐক্যবদ্ধ ঐতিহাসিক প্রচেষ্টাও ভুলে যাওয়ার নয় বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
হামদুর রহমান কমিশনই গণহত্যার দালিলিক তথ্য দিয়েছে : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিরা যে গণহত্যা চালিয়েছে, গণধর্ষণ করেছে, আড়াইশ মিলিয়ন ডলার লুট করেছে তার দালিলিক প্রমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এবং সর্বোপরি লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে সংরক্ষিত আছে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং তাদের সহযোগী আলবদর, রাজাকার বাহিনীর কথাই ওই দলিলগুলোতে লেখা রয়েছে। এই দালিলিক প্রমাণ ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সেও আছে।
তিনি বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল তা তদন্ত করেছে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর গঠন করা হামদুর রহমান কমিশন। কমিশন ৩০০ প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে এবং অসংখ্য মিলিটারি তারবার্তা পর্যবেক্ষণ করে।
‘ওয়ার ইনকয়ারি কমিশন’ নামের এই কমিশনের রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, মেজর থেকে লে. জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তারাই সবচেয়ে বেশি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। তারা হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে, অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করেছে এবং কোটি কোটি টাকা লুট ও চুরি করেছে। তাদের অপরাধের কারণে পাকিস্তান ১৯৭১ সালে হেরেছে উল্লেখ করে পাকিস্তানের সম্মান রক্ষার্থে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করে কমিশন।
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির প্রধান ডা. এমএ হাসান বলেন, পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা তোজাম্মেল হোসেন মালিক একটি নিবন্ধে একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন। দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ কাজ করতে গিয়ে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটি অসংখ্য দলিল সংগ্রহ করেছে। পাকিস্তানের যারা আজ ইতিহাসকে অস্বীকার করছে তারাও সব জানে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তাদের ৩৫৯ জনের তালিকা কমিটির কাছে আছে এবং তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দলিলও কমিটির কাছে রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার সহযোগী একাত্তরের রাজাকার, আলবদরদের পাশাপাশি সেই সব সেনা কর্মকর্তার বিচার বিলম্বে হলেও করা। তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার হতে পারে। এই বিচার হলে পাকিস্তান গণহত্যার সত্যকে অস্বীকার করার স্পর্ধা দেখানোর সাহস পাবে না। তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালের চুক্তিও পাকিস্তান মানেনি। কারণ তারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে আটক ১৯৫ জনকে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের বিচার করেনি।
পাকিস্তানের সীমাহীন ঔদ্ধত্যের কড়া প্রতিবাদ
দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ-ের রায় কার্যকর করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের আপত্তিকর মন্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। এক প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, পাকিস্তান বিবৃতি দিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিষ্ঠুর অপরাধের সাথে জড়িতদের সরাসরি পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বিবৃতি এখনই প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ। গত ২৩ নভেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনার সুজা আলমকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে বাংলাদেশের কঠোর প্রতিবাদের কথা জানিয়ে দেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব মিজানুর রহমান। তার হাতে তুলে দেওয়া হয় আড়াই পৃষ্ঠার প্রতিবাদপত্র। পরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের জানান, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে শুধু পাকিস্তান নয়, কোনো দেশেরই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া মেনে নেবে না বাংলাদেশ। পাকিস্তানকে তাদের বিবৃতির জন্য কঠোর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
২২ নভেম্বর পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র এবং পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পৃথক বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদ- পাকিস্তানের জন্য উদ্বেগের ও যন্ত্রণার বলে উল্লেখ করে। এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পাকিস্তানি পত্রপত্রিকাও বাংলাদেশের কঠোর সমালোচনা করে।
প্রতিবাদপত্রে যা আছে : চিঠির শুরুতে বলা হয়, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদ- কার্যকর করার বিষয়ে পাকিস্তানের আপত্তিকর বিবৃতির বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বড় পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইন মেনে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত বিচার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে এবং একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিবৃতি দিয়ে পাকিস্তান আবারও প্রমাণ করল, মৃত্যুদ-ে দ-িত দুই মানবতাবিরোধী অপরাধী ১৯৭১ সালে সরাসরি পাকিস্তানের সাথে যুক্ত ছিল। পাকিস্তান সেই ভয়ঙ্কর গণহত্যা চালিয়ে তা অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হয়নি, ৪৪ বছর পরও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একইভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ যখন গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতি মুছে দিচ্ছে, তখন পাকিস্তান সেই গণহত্যার পক্ষেই দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবাদপত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক নিয়ম, রীতি অনুসারে যথাযথ ও স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করেছে। পুরো বিচার প্রক্রিয়া উন্মুক্ত ছিল এবং অভিযুক্তরা সব ধরনের অধিকার ভোগ করেছে। এই বিচারে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না; বরং যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতেই প্রকৃত অপরাধীর সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত হয়েছে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতেই সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে আদালত রায় দিয়েছেন। এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার কিংবা সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পেয়েছেন। কম্বোডিয়া, যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে এই সুযোগ ছিল না।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতা বলে ইসলামাবাদের বিবৃতিতে যা বলা হয়েছে, তার জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়Ñ প্রকৃতপক্ষে একাত্তরে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী মানবতার বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অপরাধ সংঘটন করেন। তখন তিনি জাতীয়তাবাদী দলের নেতা ছিলেন না, তখন জাতীয়তাবাদী দলের অস্তিত্ব ছিল না। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের মানুষ জানে, মুজাহিদ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনী আলবদরের প্রধান এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন। তিনি বর্তমানে যে রাজনৈতিক দলের নেতা, সেই জামাতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দল নয়। বিবৃতিতে ওই দুজনের সত্যিকারের রাজনৈতিক পরিচয় এবং অপরাধ সংঘটনের ভয়াবহতার বিষয়টি গোপন করা হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো ধরনের আপত্তিকর মন্তব্য না করার জন্য পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
প্রতিবাদপত্রে আরও বলা হয়, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ নিজেরা ১৯৭১ সালে তাদের দ্বারা সংঘটিত সব অপরাধের দায়িত্ব স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন। এই আত্মস্বীকৃত অপরাধীদের পক্ষে পাকিস্তানের অবস্থান আন্তর্জাতিকভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পরিপন্থী। বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান চুক্তি অনুযায়ী এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের সাধারণ সমঝোতা অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের দায়ে চিহ্নিত তাদের সামরিক বাহিনীর ১৯৫ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। উপরন্তু পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিন্দনীয় বিবৃতি দিয়ে সেই গণহত্যার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। পাকিস্তান কোনো অবস্থাতেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার দায় এড়াতে পারে না। প্রতিবাদপত্রে পাকিস্তান ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে, গণহত্যার বিচারের বিরুদ্ধে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তা দুদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য কোনো অর্থেই মঙ্গলজনক নয়। প্রতিবাদপত্রে পাকিস্তানের আপত্তিকর বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, পাকিস্তানের বিবৃতি একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা শিষ্টাচারের চরম লঙ্ঘন।
পাকিস্তান প্রমাণ করেছে সাকা-মুজাহিদ
তাদের চর : আসমা জাহাঙ্গীর
পাকিস্তানের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীর বলেছেন, বাংলাদেশে দুই যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদ- কার্যকর করায় ইসলামাবাদের উদ্বেগ প্রমাণ করেছে, ওই দুজন রাজনৈতিক এজেন্ট (চর) ছিলেন এবং পাকিস্তানের জন্য কাজ করতেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ওই দুজন বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানে বসবাসকারী নাগরিকদের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তা হলে কেন এবং কিসের জন্য? সরকারের তা পরিষ্কার করা উচিত। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামাত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদ- কার্যকর করায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতর ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলি খান দুঃখ ও উদ্বেগ প্রকাশ করায় এর সমালোচনা করেছেন আসমা জাহাঙ্গীর। গত ২৪ নভেম্বর ইসলামাবাদ হাইকোর্টে এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের কাছে নিজের মতামত তুলে ধরেন তিনি। পাকিস্তানের দৈনিক ডনের অনলাইন সংস্করণে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এদিকে বাংলাদেশে মৃত্যুদ- কার্যকর করা নিয়ে পাকিস্তান সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করায় দৈনিকটির পাঠকরা অনলাইনে এর কড়া সমালোচনা করেছেন।
পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্ট বারের প্রথম নারী সভাপতি আসমা জাহাঙ্গীর নিজ দেশের সরকারের সমালোচনা করে বলেন, ইসলামাবাদের আচরণে এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, নিজেদের নাগরিকের চেয়ে বাংলাদেশের বিরোধী দলের সদস্যদের জন্য তাদের ভালোবাসা ও সহানুভূতি অনেক বেশি। পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বা সৌদি আরবে অন্যায্যভাবে কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো হলে সরকারকে এতটা উতলা হতে দেখা যায় না, যতটা বাংলাদেশের বিরোধী দলের দুই রাজনীতিবিদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে।
অভিযোগ প্রত্যাখ্যান : মানবাধিকার কমিশনের
বক্তব্য খ-ন করে চিঠি প্রেরণ
যুদ্ধাপরাধ বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মানদ- নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামাত নেতা আলী আহসান মুজাহিদের বিচারের ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের বক্তব্য খ-ন করে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। গত ২৬ নভেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামাতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির পর জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার রাভিনা শামদাসানি এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মানদ- বজায় রাখা হয়নি বলে মন্তব্য করেন। এ ছাড়া শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ- পুরোপুরি বাতিল করতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনারের বক্তব্য বাংলাদেশ সরকারের নজরে এসেছে। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে হাইকমিশনারের ভুল ধারণা রয়েছে।
এতে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী ও গণহত্যার বিচারে বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। অত্যন্ত নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার সাথে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। দীর্ঘদিন ধরে ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর এ দুজনের বিচার প্রক্রিয়া সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বেঞ্চে শুনানি হয়। সেখানে রিভিউ পিটিশনে এই দুই নেতার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে চলছে। এখানে প্রতিটি ব্যক্তির অপরাধের বিচার হচ্ছে পৃথকভাবে। কোনো রাজনৈতিক দলীয় পরিচয়ে তাদের বিচার হচ্ছে না। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। এ দুই নেতার বিরোধী রাজনৈতিক দলের পরিচয় থাকলেও তাদের বিচার প্রক্রিয়া কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ে হয়নি। এ দুই নেতার বিচার প্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল পলিটিক্যাল রাইটসের (আইসিসিপিআর) শর্তের প্রতি বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ। আইসিসিপিআরের শর্ত মেনেই ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিকমানের বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। আইসিসিপিআরের আর্টিকেল-১৪ যেন কোনোভাবেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, সে বিষয়ে লক্ষ্য রেখেই ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইন প্রণয়ন করে বাংলাদেশ।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির পরদিন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি এক বিবৃতিতে, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চারজনের ফাঁসি কার্যকর হলো। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই আদালত ১৭টি রায় দিয়েছে। এর মধ্যে ১৫টিতে জামাতে ইসলামী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে এই রায় দেওয়া হয়।
ওই বিবৃতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার আরও বলেন, বাংলাদেশের অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে আমরা সতর্ক করছি যে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে না কোন মৃত্যুদ- কার্যকর করা। বিভিন্ন সময় একই রকম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। তারা ফাঁসি বন্ধ রাখতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ, সুষ্ঠু বিচারের আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রাখা হয়নি। ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল পলিটিক্যাল রাইটসের (আইসিসিপিআর) শর্ত অনুযায়ী ওই বিচার করা হয়নি। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করা একটি দেশ বাংলাদেশ। যে কোনো পরিস্থিতিতে, এমনকি সবচেয়ে গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রেও মৃত্যুদ-ের বিরোধী জাতিসংঘ।