প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশ্ন : নির্ভীক সাংবাদিকতা কাকে বলে?
মাতৃভাষা দিবসে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, দুটি পত্রিকা শুধু আমার বিরুদ্ধে কুৎসাই রটনা করে গেছে, আমার বিরুদ্ধে লিখে গেছে। আওয়ামী লীগ যেন তাদের শত্রু।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ আয়োজিত মাতৃভাষা দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ২০০১ সালে ছয় বছরের রাজুফা ‘গ্যাংরেপে’র শিকার হয়েছিল। রাজুফা থেকে বয়োবৃদ্ধ কেউই রেহাই পায়নি। একাত্তরে যেভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, ওই সময় একইভাবে সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চলেছে। তখন দু-একটি পত্রিকা হয়তো এই ঘটনা তুলে ধরেছে। অনেক পত্রিকাই বিএনপি-জামাতের ওই সব অত্যাচারের কথা লেখেনি। তাদের কথা ছিল, সরকারকে নাকি সময় দিতে হবে। তিন মাস সরকারের বিরুদ্ধে কিছুই লিখবে নাÑ এমন বক্তব্য দুটি পত্রিকার, যাদের চরিত্র পরিবর্তন হয়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, ওই পত্রিকা দুটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে হয়তো প্রথম কয়েক বছর, আমি দেখেছি, নিরপেক্ষ পত্রিকা। তারপর গোটা ২০টা বছর আমার রাজনীতির জীবনে এই পত্রিকাগুলো শুধু আমার বিরুদ্ধে কুৎসাই রটনা করে গেছে, আমার বিরুদ্ধে লিখে গেছে। আওয়ামী লীগ যেন তাদের শত্রু। আর যদি কোনোদিন একটু না লিখে পারেনি; যখন একটু লিখেছে, লেখা শেষে একটু খোঁচা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার যাদের নির্বাচন দেওয়ার কথা, তারা বেশ গেড়েই বসে গেল। বিশ্বব্যাংকে চাকরি করতেন ফখরুদ্দীন, খালেদা জিয়া তাকে এনে গভর্নর বানালেন। ৯ জন সেনা কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে মইন উদ্দিনকে সেনাপ্রধান করলেন। ক্ষমতায় বসে তাদের ভিন্ন রূপ দেখা দিল। আর এই ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য দুটি পত্রিকা উঠেপড়ে লেগে গেল তাদের সাথে। একজন সম্পাদক ইতোমধ্যে স্বীকার করেছেন, ডিজিএফআই যা দিত, তিনি তা-ই লিখে দিতেন। ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিনের সরকারের আমলে ডিজিএফআই খুব শক্তিশালী হয়ে গিয়েছিল।
আওয়ামী লীগপ্রধান বলেন, ডিজিএফআইয়ের দুই ডিরেক্টর ব্রিগেডিয়ার আমিন আর ব্রিগেডিয়ার বারী হয়ে গিয়েছিল হিরো। তারাই মনে হতো যেন দেশ চালাত। কীভাবে তাদের হাতে ছাত্র-শিক্ষক, ঢাকা ইউনিভার্সিটিসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ সকলেই নির্যাতিত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের ধরে ধরে টাকা নেওয়া, অনেকে দেশছাড়া, অনেকে কারাগারে বন্দী। আর এর মদদটা দেওয়ার জন্য ওই ব্রিগেডিয়ার আমিন আর বারী যে কাগজ ধরিয়ে দিত, সেই কাগজই ওই সম্পাদক সাহেব লিখে দিতেন পত্রিকায়, এ কথা তিনি স্বীকার করে গেছেন। সত্য কখনও চাপা দেওয়া যায় না। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগে যে, উনি বললেন ডিজিএফআই যে কাগজ দিত সেই কাগজই ছাপাত। সেই পত্রিকার ওপরে তো লেখা থাকে নির্ভীক সাংবাদিকতা। তা হলে নির্ভীক সাংবাদিকতা কাকে বলে। এতই নির্ভীক যে ডিজিএফআইয়ের ওই আমিন-বারীর ধরানো কাগজ ছাপাচ্ছেন, একবারও তাকাচ্ছেন না! তার অর্থ কী দাঁড়ায়। আমার প্রশ্ন এখানে। প্রশ্নটা হচ্ছে এই ডিজিএফআইয়ের সাথে বা ব্রিগেডিয়ার আমিন আর ব্রিগেডিয়ার বারীর সাথে ওনার কী সখ্যতা ছিল। অথবা তিনি কি এদের হাতে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলেন যে যা দিত তা লিখত। অথবা যে মাইনাস টু ফর্মুলার একটা ষড়যন্ত্র চলছিল যে রাজনীতি থেকে আমাকে এবং খালেদা জিয়াকে চিরদিনের জন্য বিদায় দেবে, সেই ষড়যন্ত্রের সাথে ওই সম্পাদকদ্বয় জড়িত ছিল? কোনটা সত্য?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যদি বুকের পাটা থাকে, সাহস থাকে জাতির কাছে স্বীকার করেন। হয় ভয়ে লিখেছেন, তা হলে আর নির্ভীক সাংবাদিকতা থাকে না। আর যদি তাদের কাছে বিক্রি হয়ে থাকেন বা তাদের সাথে সখ্যতা থাকে, সেখানে আমার কিছু বলার নেই। আর যদি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন, তা হলে ষড়যন্ত্রকারীদের, যারা এদেশের গণতন্ত্র হত্যা করে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টা করেছিল, এদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, এদেশের মানুষকে এভাবে নির্যাতনের শিকার করেছিলÑ যুদ্ধাপরাধীদের যেমন বিচার হচ্ছে, ঠিক সেভাবেই একদিন এদের এই সংবিধান ধ্বংস করার বিচার হবে।
ডেইলি স্টার সম্পাদকের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাকে দুর্নীতিবাজ বানাবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। আমি সেই সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামকে একটা কথাই বলব। আমাকে যে দুর্নীতিবাজ বানাতে বহু চেষ্টা করেছেন। … আপনার পিতৃতুল্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, তারাও তো দুর্নীতিবাজ বানাতে চেষ্টা করে পারে নাই। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে যখন কথা উঠেছিল তখনও তো অনেক বড় বড় কথা। ভাবখানা এমন, এত দিন পাই নাই। এইবার ধরে ফেলেছি। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় মামলা হয়েছে বলে নাকি খুব হা-হুতাশ দুঃখ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাকে গ্রেফতারের প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ছিল না। আমার বাসা সার্চ করা হয় দুই দুই বার। আমার অসুস্থ স্বামীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর টেনেহিঁচড়ে যেভাবে আমাকে কারাগারে নিয়ে একটা ড্যাম পড়া ঘর, ইন্দুরে কাটা চাদর, ভাঙা খাটÑ ওর মধ্যে রেখে দেওয়া হয়েছিল। খাবার আসত জেলখানা থেকে, কোনো কোনোদিন হয়তো ৩টা বেজে যেত, ৪টা বেজে যেত, তারপর সেখান থেকে খাবার আসত। বাইরে থেকে কিছু দিতে দিত না। অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত খালেদা জিয়া গ্রেফতার না হয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো খাবার কোনো কিছু আসত না। এটা হলো বাস্তবতা।
শেখ হাসিনা বলেন, যারা মামলা দেওয়ার জন্য এত দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, এগার মাস যদি আপনাদের সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখা হয়, আর যদি আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়, আর যদি মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয় এবং আমার ছেলে-মেয়ে, বোন তাদের ওপর পর্যন্ত যে অত্যাচার মানসিক চাপ… তাদের পরিবারের ওপর যদি এ রকম করা হয়, তা হলে কি তারা বিবৃতি দেবেন, সহানুভূতি দেখাবেন? তিনি বলেন, ব্রিটিশ কোনো মন্ত্রী বা এমপির বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করেছিল বিবিসি। যখন প্রমাণ হলো এটা মিথ্যা, তখন তারা শুধু ক্ষমাই চাইল না। বিবিসির মহাপরিচালক থেকে শুরু করে যারা যারা এই সংবাদ পরিবেশনের সাথে জড়িত ছিলেন, সবাই পদত্যাগ করেছেন। তাদের সৎ সাহস ছিল তারা পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু এই সম্পাদক সাহেব উনি ডিজিএফআইয়ের লেখা ছাপিয়ে ভুল করেছেন বললেন কিন্তু সেই ভুলের খেসারত বাংলাদেশের মানুষ দিল, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দিল, এদেশের ব্যবসায়ীমহল দিল, ছাত্রসমাজ দিল, সকলেই দিল। আর যেহেতু আমার বিরুদ্ধে লিখেছে, সে জন্য আমি ও আমার পরিবার তো দিয়েছি। কই তিনি ভুল স্বীকার করে পদত্যাগ করার সাহস দেখাতে পারলেন না? এতটুকু আত্মমর্যাদা থাকলে নিশ্চয় তিনি পদত্যাগ করতেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডেইলি স্টারের মতো একটি পত্রিকা, ডিজিএফআইয়ের একজন অফিসার যা লিখে দেবে তা ছাপাবে, এটা কোন পাগল বিশ্বাস করে? কারণ, ডেইলি স্টার তার ভাষা সম্পর্কে খুবই সচেতন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দল গঠনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিংস পার্টি গঠন করতে গিয়ে সেখানেও ব্যর্থ। তারপর একজন বিশ্ব খ্যাত ব্যক্তি, তারও পার্টি করার শখ হলো। সে দায়িত্ব সম্পাদক সাহেবই নিয়েছিলেন। ৭০ জনের তালিকা হয়েছিল। ফোন করে কেউ সাড়া দেয় না। আর দলও হয় না।
ডেইলি স্টার সম্পাদকের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যিনি আজকে বিশেষ করে ডিজিএফআইয়ের কথা লিখেছেন, তার ইতিহাস যদি বলি, মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ছিলাম। আমাদের পড়াশোনা তো নষ্ট হয়েছে। কিন্তু ওই সম্পাদক সাহেব করাচিতে চলে গিয়েছিলেন, যাতে তার পড়াশোনা নষ্ট না হয়। যে কোনো কারণে হোক সেখানে না থেকে পরবর্তীতে চলে যায় কলকাতায়। একটু ইংরেজি জানত বলে তার ওপর দায়িত্ব ইংরেজি লেখার। এই হলো মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযোদ্ধা তিনি। কাজেই তার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কী আদায় করব। যে উচ্চ শিক্ষার্থে পাকিস্তান ফেরতা হয়ে তারপরে মুক্তিযুদ্ধ মাঠে গিয়ে শুধু ইংরেজি বলা আর লেখার কাজটা করেছিল। কাজেই ডিজিএফআইয়ের দালালি করা আর আমিন-বারীর দালালি করা যাদের চরিত্র, তারা এদেশ বা দেশের মানুষকে কী দেবে?
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, আমার দুঃখ হয়, আমাদের পার্টিতে কয়েকজন এ বিষয়ে মুখ খুলেছে। অনেকে দেখি মুখও খুলতে কেন যেন তাদের দ্বিধা। সত্য কথা বলতে তাদের কেন এত ভয়। ২০টা বছর তো আমার বিরুদ্ধেই লিখেছে। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অনেক বন্ধুর পথ পার হয়ে তারপর আজকে এখানে এসেছি। এবং আজকে সাতটা বছরে বাংলাদেশে সরকার পরিচালনা করে এদেশকে আজকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছি। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি করেছি। সারাবিশ্বে বাংলাদেশ আজকে উন্নয়নের রোল মডেল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সত্য বেরোবে, ধামাচাপা দিয়ে রাখা যাবে না। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আর এ সমস্ত দালালগুলো, বাংলাদেশের জনগণের হাতে তার বিচারের ভার আমি দিয়ে গেলাম।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, চার জাতীয় নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ এবং ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
বক্তৃতার শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন-স্বাধিকার তথা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য তুলে ধরেন। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণায় তার সরকারের পদক্ষেপ এবং কানাডাপ্রবাসী রফিক ও সালামের কৃতিত্বপূর্ণ অবদান এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সৃষ্টির আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগ সভাপতিম-লীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এমপি, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি, জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এমপি, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ এমপি ও জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ মাহমুদ আল স্বপন এমপি প্রমুখ।
আলোচনা সভা পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ এমপি এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।