বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্নের বাংলাদেশ – তোফায়েল আহমেদ
প্রতি বছর যখন আমাদের জীবনে আগস্ট মাস আসে, তখন জাতির জনকের স্মৃতি আমাকে আন্দোলিত করে। বঙ্গবন্ধু আমার জীবনে চলার পথের প্রেরণা। পরিচয় হওয়ার পর থেকেই পরমাদরে বঙ্গবন্ধু আমায় কাছে টেনে নিয়েছেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পরম মমতায় নিজের কাছেই রেখেছেন। বিশেষ করে ‘৬৯-এ গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা যখন বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্ত করে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংবর্ধনা দিয়ে কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম, সেই দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলাম।
‘৬৯-এর পর থেকে বঙ্গবন্ধু যত রাজনৈতিক সফর করেছেন আমি তাঁর সফরসঙ্গী হয়েছি। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আমাকে মাত্র ২৭ বছর বয়সে জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচিত করেন। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার আনাচে-কানাচে সফর করেছিলেন। বাসে-ট্রেনে-স্টিমারে এক সঙ্গে গিয়েছি, একই কামরায় থেকেছি। একদিনে ৮-১০টি করে জনসভা, পথসভা। দিন শেষে সন্ধ্যা নামলে চারদিক অন্ধকার; এর মধ্যে লোকজন লণ্ঠন হাতে দঁাঁড়িয়ে থাকত শুধু বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখবে বলে। এমনকি বহু জায়গায় পায়ে চলার পথও নেই। ক্ষেতের আইল দিয়ে হাঁটা পথ। কোথাও পায়ে হেঁটে, কোথাওবা গরুর গাড়িতে। নাগেশ্বরী, রৌমারী, চিলমারী, ভুরুঙ্গমারী, বুড়িমারীসহ কুড়িগ্রামের প্রতিটি থানায় তিনি জনসভা করেছেন। আমরা হেঁটে আর বঙ্গবন্ধু গরুর গাড়িতে। স্বচক্ষে দেখেছি লক্ষ মানুষের জনস্রোত। ময়মনসিংহের নান্দাইলে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলাম। বিশাল জনসভা। মানুষের মনোভাব তিনি হৃদয়ের গভীরতা দিয়ে উপলব্ধি করতেন। সেদিন বক্তৃতা শেষে গাড়িতে উঠেই বলেছিলেন, ‘এই আসন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। লোকজন এসেছে শুধু আমাকে দেখতে।’ বঙ্গবন্ধু যখন আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে গিয়েছিলেন, তখন নূরুল আমীন তাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। গোলটেবিল বৈঠক থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন, ‘দু’জন আমাকে সমর্থন করেছিল। একজন প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমেদ এবং অপরজন নূরুল আমীন।’
অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী নেতা। ‘৭১-এ অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে যখন ঢাকায় ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হয়, তখন তিনি ভুট্টোকে বলেছিলেন, ‘মিস্টার ভুট্টো, পাকিস্তান আর্মি ষড়যন্ত্র করছে ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে। তুমি পাকিস্তান আর্মিকে বিশ্বাস করো না। ওরা প্রথমে আমাকে হত্যা করবে, পরে তোমাকে।’ ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ১৪ জানুয়ারি আমাকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তাঁর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম বিদেশ সফর ছিল ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। কলকাতায় স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সেই জনসভায় ২০ লক্ষাধিক মানুষের উদ্দেশে বক্তৃতার শেষে কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই।’ রাজভবনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠকের পর স্বাক্ষরিত হয়েছিল পঁচিশ বছর মেয়াদি ঐতিহাসিক ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি’। আলোচনা বৈঠক শেষে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার জন্মদিনে আপনাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’ বঙ্গবন্ধু পুনরায় অনুরোধ করে বললেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার সফরের আগেই আমি চাই ভারতের সেনাবাহিনী আপনি ফিরিয়ে আনুন।’ ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘আপনি যা চাইবেন আমি তাই-ই করব।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কথা রেখেছিলেন। তিনি ‘৭২-এর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে স্বাধীন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি মোতাবেক একই বছরের ১২ মার্চ বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।তাঁর সমগ্র চিন্তাজুড়েই ছিল দেশ ও দেশের মানুষ। তিনি আমাদের স্বাধীন দেশ, জাতীয় পতাকা, গণতান্ত্রিক সংবিধান ও নির্বাচিত সার্বভৌম সংসদ দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশ গঠনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। অর্থনৈতিক মুক্তির কাজ শুরু করেছিলেন। স্বাধীনতার পর গোলাঘরে চাল ছিল না। ব্যাংকে টাকা ছিল না। বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। রাস্তাঘাট ধ্বংস করে দিয়েছিল পাকবাহিনী। ব্রিজ-কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছিল বোমা মেরে। ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। একটা প্লেন ছিল না, রেল ছিল না, বাস ছিল না, ট্রাক ছিল না, স্টিমার ছিল না। পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা তছনছ করে দিয়েছিল। অর্থনীতি ছিল ধ্বংসপ্রায়। মাত্র ৩ বছর ৭ মাস উদয়াস্ত পরিশ্রম করে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশটাকে আমরা স্বাভাবিক করেছিলাম। ‘৭৪-এ বাংলাদেশে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল সেটা ছিল মানুষের তৈরি। খাদ্যশস্য থাকা সত্ত্বেও বন্যার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত থাকায় আমরা মানুষের কাছে খাদ্যদ্রব্য সঠিক সময়ে পেঁৗছাতে পারিনি। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি মোতাবেক দুই লাখ টন খাদ্যসামগ্রী মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। এত সব কিছুর পরেও বঙ্গবন্ধু দেশটাকে স্বাভাবিক করেছিলেন। যেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, সেদিন গোলাঘরে চাল, ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা আছে এবং দেশে স্বাভাবিকতা বিরাজ করছে।নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইস্পাত-কঠিন। সুদৃঢ় সংকল্পবোধ নিয়েই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠনে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে খুনিচক্র তাঁকে দেশের অভ্যন্তরে সপরিবারে হত্যা করেছিল। জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করেই খুনিচক্র ক্ষান্ত হয়নি। একই বছরের ৩ নভেম্বর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা নেতৃত্ব দিতেন বা বারংবার নেতৃত্ব দিয়েছেন দলের এবং সরকারের_ ঐতিহাসিক মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, কামারুজ্জামান সাহেব_ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য তাঁদেরকে কারাভ্যন্তরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের আসল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব শূন্যতা তৈরি করা। কিন্তু ঘাতকচক্রের ধ্বংসাত্মক ষাড়যন্ত্রিক প্রয়াসকে আমরা সফল হতে দেইনি। বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধারণ করেই ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছি। চরম প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সাংগঠনিক তৎপরতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করে মূল দলসহ সহযোগী সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করে নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে কেবল দলকেই ধ্যান-জ্ঞান করে, দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে আওয়ামী লীগের পতাকা তুলে দিয়েছি। সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সাফল্যের সঙ্গে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আজ তিনি জাতিকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত নীতি অনুযায়ী দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। অতীতে ৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে মানুষের খাদ্যাভাব ছিল, আজ ১৬ কোটি মানুষের দেশে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এক সময় দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না, আজ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রেমিট্যান্স ছিল না, আজকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমাদের রেমিট্যান্স। এক্সপোর্ট ছিল মাত্র ৩০০ মিলিয়ন ডলার, আজ তা ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। শুরুতে বাজেট ছিল মাত্র ৭৮৭ কোটি টাকা। আজ তা দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এখন আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশ সম্পর্কে বলে, ‘বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের’। মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস্ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ‘পরবর্তীকালে যে ১১টি দেশ অর্থনৈতিকভাবে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ তার অন্যতম।’ আরেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জেপি মরগ্যান, ‘বাংলাদেশ উদীয়মান দ্রুতগতির অর্থনীতি’ বলে অভিহিত করেছে। ইতিমধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষপূর্তিতে আমরা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে সক্ষম হবো। বঙ্গবন্ধুর যেমন দুটি লক্ষ্য ছিল_ এক. দেশ স্বাধীন করা এবং দুই. অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তর করা। তিনি গর্ব করে বলতেন, ‘আমার বাংলা রূপসী বাংলা, আমার বাংলা সোনার বাংলা।’ তিনি বলতেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলবো আমি বাঙালী, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ।’ একইভাবে ২০০৮-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুকন্যাও বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুটি লক্ষ্য স্থির করেছেন_ এক. ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং দুই. বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করা। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়। ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে মোবাইল ও তথ্যপ্রযুক্তির সেবায় দেশের মানুষ ইতিমধ্যে তার সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মতে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে এবং ২০২১-এ আমরা পরিপূর্ণভাবে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছি। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, আজ তাঁর কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেই পথেই এগিয়ে চলেছে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তব রূপলাভ করতে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পরিচালিত হয়ে বাংলাদেশ আগামীতে উন্নত দেশে রূপান্তরিত হবে এবং সমগ্র বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
আওয়ামী লীগ নেতা, বাণিজ্যমন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।।