বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন ও জাতীয় পুনর্গঠন
“কোনো ‘ভুঁড়িওয়ালা’ এ দেশে সম্পদ লুটতে পারবে না। গরিব হবে এই রাষ্ট্র ও সম্পদের মালিক, শোষকরা হবে না। এই রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ থাকবে না। এই রাষ্ট্রের মানুষ হবে বাঙালি। তাদের মূলমন্ত্র ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।”
নূহ-উল-আলম লেনিন: স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উন্নয়ন-দর্শন নিয়ে সাম্প্রতিককালে তেমন একটা আলোচনা হয় না। গত শতাব্দীর ন’য়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতন্ত্রের পতন এবং বিশ্বায়িত ধনতন্ত্রের নতুন উত্থান এক অভিনব পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। মার্কসবাদী বা কমিউনিস্ট আদর্শের সমাজতন্ত্রী না হলেও বঙ্গবন্ধু তার নিজস্ব বীক্ষায় একটি শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি যে ‘সমাজতন্ত্র’ তা কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার ছিল না। বঙ্গবন্ধু মানুষে মানুষে ভেদ-বৈষম্যহীন সমাজ এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্য থেকেই সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সদ্য স্বাধীন প্রায় সব দেশই, এক ধরনের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। এর মূলে কাজ করেছে তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্রের তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বের মিথে বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধুও তার ব্যতিক্রম নন। প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলংকা, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশ সমাজতন্ত্রকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় নীতি বা লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
এটা কোনো অন্যায় বা হুজুগী ব্যাপার ছিল না। ঔপনিবেশিক পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বের হয়ে আসা পশ্চাৎপদ প্রতিটি দেশই দ্রুত উন্নয়ন এবং সমাজের হতদরিদ্র, শোষিত-বঞ্চিত মেহনতি মানুষের জীবনে সমৃদ্ধির স্বপ্ন রূপায়নের জন্য সমাজতন্ত্রকেই সর্বোত্তম পথ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের তথা সমাজতন্ত্রের পতন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উন্নয়নের গতিপথ পরিবর্তনে বাধ্য করে। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগও এতদিনের অনুসৃত অর্থনৈতিক নীতিমালা এবং উন্নয়ন-কৌশল বদলাতে বাধ্য হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সেই পরিবর্তিত পথেই দেশের উন্নয়ন রথ এগিয়ে নিচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব-ব্যবস্থার পতন এবং বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের একেশ্বর হয়ে ওঠার পর বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন কতটা প্রাসঙ্গিক? বঙ্গবন্ধু কী স্বপ্নাচারী এবং ইউটোপীয়ার পেছনে ছুটেছেন? তার সোনার বাংলার স্বপ্ন অথবা ভেদ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শ কী অবাস্তবÑ অচল হয়ে পড়েছে?
আমাদের বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক দর্শন এখনও প্রাসঙ্গিক। জাতীয় অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং একটি উন্নত-সমৃদ্ধ সমাজ নির্মাণের বর্তমান নীতি-কৌশল মূলত ঠিক থাকলেও, বঙ্গবন্ধুর দর্শন থেকে তার বিচ্যুত হওয়ার অবকাশ নেই।
আমাদের সংবিধানেই বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। ‘জনগণ’ বলতে স্বভাবতই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকেই বোঝায়। যতক্ষণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গরিব থাকবে, হতদরিদ্র থাকবে, ততক্ষণ তত্ত্বগতভাবে তারাই প্রজাতন্ত্রের মালিক। পক্ষান্তরে, জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থা তো অপরিবর্তনীয় থাকে না। দারিদ্র্যমুক্ত একটা সমাজ গড়ে উঠলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, দরিদ্র অবস্থা থেকে বেরিয়ে এলে, স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানার চরিত্র এবং রূপও বদলে যায়। বঙ্গবন্ধু একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ‘রাষ্ট্র ও সম্পদ’-এর মালিক হবে ‘গরিব জনগণ’ বলেছেন। গরিব তো চিরদিন গরিব থাকবে না। বঙ্গবন্ধু এই গরিবানা হটানোর জন্যই সম্পদের সুষম বণ্টন এবং সম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। বস্তুত, বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিধৃত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু বারবার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। দুঃখী মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন তথা তাদের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে না পারলে দুঃখী মানুষ তো দুঃখীই থেকে যাবে। জীবনের এই মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হলেই কেবল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটবে। এই যে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার প্রত্যয়টি কী অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে? নিঃসন্দেহে, এর জবাব হবে ‘না’। আমাদের সংবিধানে দ্বিতীয় ভাগের ১৪, ১৫, ১৬, ১৭ এবং ১৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের কর্তব্য এবং নাগরিকজনের অধিকারসমূহ যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, সেসব কার্যকর হলেই বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে। এ ছাড়া সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ হিসেবে যেসব অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, সেসব অধিকারই পরিবর্তনের জন্য মানুষের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নি¤œলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়Ñ
(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা;
(খ) কর্মের অধিকার…
(গ) যুক্তিসংগত বিশ্রাম…
(ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার…।”
অতীতের সামরিক শাসকরাও সংবিধানের অনেক কিছু কাটছাঁট এবং সংশোধন করলেও দ্বিতীয় ভাগের এই অনুচ্ছেদগুলোতে হাত দেয়নি। বস্তুত, এই অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গিই অভিব্যক্ত হয়েছে।
সংবিধানে প্রতিফলিত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন যাতে কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না থাকে, সে লক্ষ্যে ১৯৭২-৭৩ সালেই বঙ্গবন্ধু অনেকগুলো ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সারা বিশ্বব্যাপী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের তীব্র জোয়ার এবং কোথাও ‘সমাজতন্ত্রের’ উন্নয়ন মডেল, কোথাও ‘মিশ্র অর্থনীতি’ এবং কোথাও ‘অপুঁজিবাদী বিকাশের’ উন্নয়ন মডেল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সর্বোপরি গোটা ষাটের দশকের গণ-আন্দোলনের ধারাবাহিকতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে জনগণের অভিব্যক্ত আশাবাদ ছিল বঙ্গবন্ধুর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নীতি-পদক্ষেপের মূল প্রেরণা।
উল্লিখিত পটভূমিতে বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালেই বাংলাদেশে সকল ব্যাংক-বীমা এবং পাট ও বস্ত্র শিল্প জাতীয়করণ করেন। পাকিস্তানের মতো অবাধ পুঁজিবাদী বিকাশের পথ রুদ্ধ করার জন্য পুঁজির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেন। গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্গঠনের লক্ষ্যে জমির সিলিং ১০০ বিঘায় সীমিত করা হয় এবং ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা হয়। একই সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়।
একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন, ভারত প্রত্যাগত ১ কোটি উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় প্রভৃতি বহুমুখী কাজের চাপ, অন্যদিকে ১৯৭৩ সালে বিশ্বব্যাপী তৈল সংকটের অভিঘাতে বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে ‘মানব সৃষ্ট’ দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা প্রভৃতি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই বঙ্গবন্ধুকে দেশ এগিয়ে নিতে হচ্ছিল।
মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু যে বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত খাত সৃষ্টি করেছিলেন, তার লক্ষ্য ছিল দেশকে দ্রুত শিল্পায়ন এবং গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করা। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বহুদলীয় গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে থেকেই বঙ্গবন্ধু এসব অর্থনৈতিক সংস্কার সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। তবে এ কথাও সত্য তৎকালীন বাস্তবতায় এই বিশাল রাষ্ট্রায়ত্ত খাত, ব্যাংক-বীমা ও কল-কারখানা লাভজনকভাবে পরিচালনার মতো দক্ষ লোকবল আমাদের ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শের প্রতি আস্থা থাকলেও আওয়ামী লীগের নিজস্ব সৎ আদর্শবাদী দক্ষ দলীয় ক্যাডার ছিল না। এই বাস্তবতা বঙ্গবন্ধু জানতেন। ফলে বারবার ব্যক্তি মালিকানায় পুঁজির সর্বোচ্চ সীমা বাড়িয়ে ব্যক্তি খাতকে উৎসাহিত করতে হয়েছিল। এক পর্যায়ে পুঁজির সর্বোচ্চ সীমা বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করা হলেও, শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সীমার সিলিংও উঠিয়ে দিতে হয়।
বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত অর্থনৈতিক নীতি-পদক্ষেপগুলো বানচাল করার উদ্দেশে একদিকে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিগুলো, অন্যদিকে চীনের অনুসারী উগ্র বামপন্থি, মওলানা ভাসানীর ন্যাপ এবং জাসদ প্রভৃতি দল কল-কারখানায় অগ্নিসংযোগ, চুরি, ডাকাতি, হত্যা-খুন-সন্ত্রাস প্রভৃতির মাধ্যমে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করে। রাষ্ট্রায়ত্ত জুট মিলগুলোর পরিচালনায় সাবেক মালিক বা আমলাদের নিয়োগ করলে তারাও দুর্নীতি ও সাবোটাজের মাধ্যমে পুরো জাতীয়করণকৃত খাতকেই অলাভজনক ও স্থবির করে তোলে। স্বভাবতই এর সাথে যুক্ত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বহুমুখী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশ সফর করতে এসে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলার মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করতে দ্বিধা করে নি।
সে সময় বিশ্বব্যাংকের দুই কর্মকর্তা জাস্ট ফাল্যান্ড এবং জে আর পারকিনসন বাংলাদেশকে নিয়ে উপহাস করে বলেছিলেন, বাংলাদেশের যদি উন্নয়ন সম্ভব হয়, তা হলে পৃথিবীর যে কোনো দেশের উন্নয়ন সম্ভব। অর্থাৎ, তাদের কথার নিহিতার্থ হলো বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবিতাবস্থায়ই কিসিঞ্জার ও ফাল্যান্ড পারকিনসনদের কথা মিথ্য প্রমাণিত হয়। প্রচ- প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। এতসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল। যুদ্ধ, ধ্বংসযজ্ঞ ও বন্যাজনিত কারণে ধান উৎপাদন ১ কোটি ২০ লাখ টন থেকে কমে ৯৯ লাখ টনে নেমে এসেছিল। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরেই (বন্যা ও দুর্ভিক্ষাবস্থার মধ্যেই) ধানের উৎপাদন পূর্বের স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন প্রচলিত ব্যবস্থায় দেশকে দ্রুত কাক্সিক্ষত উন্নতি পথে এগিয়ে নেওয়া এবং দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো দুরূহ। সাবোটাজ, ধ্বংস, ষড়যন্ত্র, দুর্নীতির মূলোৎপাটন এবং উৎপাদন বৃদ্ধি, স্বয়ম্ভরতা অর্জন, সর্বোপরি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হলে গোটা ব্যবস্থারই পরিবর্তন দরকার। সে কারণেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। সমাজের কল্যাণকামী, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিকে এক প্লাটফরমে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় পুনর্গঠনের মহাকর্মযজ্ঞের সূচনা করেছিলেন। অনেকেই বিষয়টিকে আক্ষরিক অর্থে ‘একদলীয় শাসন’ হিসেবে ব্যাখ্যার চেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু ‘বাকশাল’ নামে যে জাতীয় ঐক্যের প্লাটফরম করেন, সেখানে সর্বস্তরের জনসাধারণ, বেসামরিক প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, অতীতের ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক নিয়ম-রীতি ভেঙে দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর সদস্য, শিক্ষক, উকিল, ডাক্তার, শ্রমিক, কৃষক, নারী-পুরুষÑ সবাই যেন জাতি গঠনের কাজে অভিন্ন রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং সকলের মেধা-শ্রম যেন জাতীয় উন্নয়নে কাজে লাগে, সে জন্যই এই নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। সিভিল প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা সচিবগণ এবং সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ ও উপ-প্রধান জেনারেল জিয়াসহ অনেকেই জাতীয় দল বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। সমগ্র দেশে একটা অভিনব উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।
বঙ্গবন্ধুর জবানীতেই শোনা যাক কেন এই পরিবর্তন? বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “কেন সিস্টেম পরিবর্তন করলাম? সিস্টেম পরিবর্তন করেছি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। সিস্টেম পরিবর্তন করেছি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার জন্য।…
আমি কেন ডাক (দ্বিতীয় বিপ্লবের) দিয়েছি? এই ঘুণে ধরা ইংরেজ আমলের, পাকিস্তানী আমলের যে শাসনব্যবস্থা, তা চলতে পারে না। একে নতুন করে ঢেলে সেজে গড়তে হবে। তা হলে দেশের মঙ্গল আসতে পারে, না হলে আসতে পারে না। আমি তিন বছর দেখেছি। দেখেশুনে আমি স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছি এবং তাই জনগণকে বুঝিয়ে দিতে হবে শাসনতন্ত্রের মর্মকথা।”
কেবল কাঠামোগত পরিবর্তন নয়, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বাস যে গ্রামে, সেই গ্রামীণ অর্থনীতির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য ‘বাধ্যতামূলক গ্রাম সমবায়’ চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি, তাতে গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না।… পাঁচ বৎসরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটি করে কো-অপারেটিভ হবে।… জমির মালিকের জমি থাকবে। কিন্তু তার ফসলের অংশ সবাই পাবে। প্রত্যেকটি বেকার প্রত্যেকটি মানুষÑ যে মানুষ কাজ করতে পারে, তাকে এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলি বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে।” বঙ্গবন্ধুর গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং বাধ্যতামূলক গ্রাম সমবায়ের ধারণা (ঈড়হপবঢ়ঃ)-এর ওপর জাতিসংঘের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট বামপন্থি অর্থনীতিবিদ ড. নজরুল ইসলাম তার গবেষণায় বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে এবং পর্যায়ক্রমে গ্রাম সমবায় গঠিত হলে, আমরা যা অনুমান করি, তার চেয়েও অনেক সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হতো। তার মতে, বঙ্গবন্ধুর এই উদ্যোগ সফল হলে কেবল গ্রামজীবনের পুনর্গঠনই নয়, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থারই মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হতো। রাষ্ট্রের মালিক হবে ‘গরিব মানুষ’ বা সংবিধানের ভাষায় ‘জনগণ’, তা কার্যকর হতো। হয়তো এটা বিশ্বে একটা ‘নতুন মডেল’ হিসেবে পরিগণিত হতো।
আমাদের এসব অনুমান নিছক তত্ত্বকথা নয়। “মোট জাতীয় আয় ও মাথাপিছু জাতীয় আয়ের বিবেচনায় ১৯৭২ সালে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের অবস্থান বাংলাদেশের সমতুল্যই ছিল। ৬ গুণ বেশি জনসংখ্যার কারণে মালয়েশিয়ায় মাথাপিছু জাতীয় আয় বাংলাদেশের ২৮০ ডলারের বিপরীতে যদিও ৫০০ ডলার ছিল; কিন্তু উভয় দেশের মোট জাতীয় আয় ছিল প্রায় সমান, ১০৩৩ ডলার। বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত উন্নয়ন নীতি-কৌশলের কারণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৭ শতাংশে পৌঁছেছিল। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ উন্নয়ন-দৌড়ে নিঃসন্দেহে আজকের মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের সমকক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে অনেক আগেই একটি মধ্যমানের উন্নত দেশে পরিণত হতো।”
কিন্তু বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধু সে সুযোগ পান নি। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা সে সুযোগ দেয় নি। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার ভেতর দিয়ে পাকিস্তান ও পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের অনুসারী শক্তিগুলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে। তারা এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণ করে। খুনি মোশতাক-জিয়া চক্র এবং পরবর্তী সামরিক স্বৈরশাসক, খালেদা-নিজামীর বিএনপি-জামাত জোট পৈশাচিক আক্রোশে বঙ্গবন্ধুর নাম নিশানা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশকে কার্যত পাকিস্তানের মতোই একটি ধর্ম-সাম্প্রদায়িক অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করেছে। এদের সম্মিলিত চক্রান্ত, লুটপাট, দুর্নীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যর্থতার কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন রূপায়ণ পিছিয়ে গেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী আদর্শের বিজয় অনিবার্য। যতদিন সমাজে দারিদ্র্য থাকবে, ধনী-দরিদ্রে, শোষক-শোষিত সমাজ বিভক্ত থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও উন্নয়ন দর্শন প্রাসঙ্গিক থাকবে। পরিবর্তিত বিশ্ব বাস্তবতায়, বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মধ্যেই বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণ এবং ‘দুঃখী মানুষের মুখে’ হাসি ফোটাতে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। দারিদ্র্য হার ২২ শতাংশে নামিয়ে এনেছেন। জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো বহুলাংশে পূরণ করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘ভিক্ষুকের জাতির কোনো সম্মান থাকে না।’ জননেত্রী শেখ হাসিনা বাঙালি জাতির ‘ভিক্ষুক’ অভিধাই নয়, পরনির্ভরশীলতার অভিশাপ থেকেও জাতিকে মুক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধু বারবার ‘আত্মনির্ভরশীল’ অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা বলেছেন। বিশেষত খাদ্যে স্বয়ম্ভরতার কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর সময়ের জনসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি হওয়া সত্ত্বেও খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। বিদেশ-নির্ভরতার ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আজ বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করছে। বঙ্গবন্ধু সম্পদ সৃষ্টি ও সম্পদের সুষম বণ্টনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ এখন সম্পদশালী দেশে পরিণত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের সোপানে পা দিয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার দৃঢ় পদক্ষেপে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
অর্থনীতিতে ব্যক্তি মালিকানার অবাধ বিকাশের সুযোগ, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লেষণ এবং দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন যত প্রকট ও অসহনীয় হয়ে উঠুক না কেন, সংবিধানের এসব মৌলিক নীতিমালা ও অঙ্গীকারের কোনো পরিবর্তনের প্রশ্নই ওঠে না। সময়ের এবং বাস্তবতার কারণে উন্নয়ন কৌশল পরিবর্তন স্বাভাবিক বটে। তবে আমাদের মতে, উন্নয়ন কৌশল ও মালিকানার ধরনে পরিবর্তন সত্ত্বেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৌলিক চিন্তাধারা, আদর্শ এবং উন্নয়ন-দর্শন কেবল প্রাসঙ্গিকই নয়, আজও বাঙালি জাতির এগিয়ে যাওয়ার দিগদর্শন হিসেবে চির অম্লান হয়ে আছে। জাতির পিতার জীবনের দুটি ব্রত ছিল। একটি বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, অন্যটি স্বাধীনতার সুফল যাতে মানুষ পায় সে লক্ষ্যে অর্থনৈতিক মুক্তি তথা একটি উন্নত-সমৃদ্ধ এবং ভেদ-বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণ। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য দেশকে সম্পদশালী করা এবং সেই সম্পদের মালিক যাতে গরিব-দুঃখী মানুষ হতে পারে, তা নিশ্চিত করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবন-দর্শনের মোদ্দা কথা। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেই কর্তব্যভার পালন করাই হচ্ছে বর্তমান সরকারের ব্রত।