বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক ক্যারিশমা
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রসঙ্গ উঠলে তাঁর নেতৃত্বগুণের কথা চলে আসে সবার আগে। তাঁর ব্যক্তিত্ব, বাচনভঙ্গি, সম্মোহনী শক্তি নিয়েও বহু লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু জাতির পিতার কূটনৈতিক ক্যারিশমার বিষয়টি খুব কমই আলোচনায় এসেছে। অনেকেই জানেন না যে, তুখোড় রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন ক্যারিশমাটিক ডিপ্লোম্যাটও। দেশে কিংবা বিদেশে, যখনই কোনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন, দেশের স্বার্থের বিষয়ে কীভাবে তাদের সমর্থন আদায় করে নেওয়া যায় সেটা তিনি ভেবেছেন সবসময়। বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক কৌশলের কারণে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এমন অনেকেরই সমর্থন ও সহযোগীতা আদায় করা সম্ভব হয়েছিল যারা ছিলেন বাংলাদেশ বিরোধী।
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ অধিবেশনের পর ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ১ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সেসময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী। জেরাল্ড ফোর্ডের স্ত্রী তখন অসুস্থ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নেন। কুশলবিনিময় করেন। এরপরই চলে যান মূল বিষয়ের আলোচনায়। দেশে খাদ্যের চরম সংকট। অনতিবিলম্বে খাদ্য সহায়তা দরকার। যুক্তরাষ্ট্র সেসময় ঘোর বাংলাদেশ বিরোধী ছিল সেটা কারওই অজানা নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক কৌশলের কারণে সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার প্রতিশ্রুতি আদায়ে সক্ষম হয়েছিল বাংলাদেশ।
সেদিনের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুকে আড়াই লাখ টন গম দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আসছে, এ খবরটি তখন বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি ছিল। খাদ্য ঘাটতিকে পুঁজি করে অনেকেই তখন চাল–গমের মজুদ গড়ে তুলেছিল। খাদ্যশস্য বাজারে স্থিতিশীলতার জন্য গম আসার খবরটি জরুরী হয়ে পড়েছিল।
স্বাধীনতাযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল সেটা সবারই জানা। তবুও বঙ্গবন্ধু নিঃসংকোচে প্রেসিডেন্ট ফোর্ডকে বলেছিলেন, পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পদ ভাগাভাগির কথা, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসনের কথা, এসব প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর নির্বিকারত্বের কথা।
যুদ্ধশেষে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দিহান ছিল সবাই। কিন্তু জাতির পিতার কূটনৈতিক ক্যারিশমার কারণেই স্বল্প সময়ে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিল ভারত। মুক্তিযুদ্ধে বন্ধু দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) সফরে গিয়ে তিনি বিধ্বস্ত চট্টগ্রাম বন্দর সচল করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে এসেছিলেন।
১৯৭৩ সালে অটোয়ায় কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে মূল বৈঠকের আগেই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পদ ভাগাভাগি ও আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে একটি রেজুলেশন গ্রহণ করার ব্যাপারে কানাডা ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি আদায় করেছিলেন জাতির পিতা। সেসময় বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী। সেই সফরের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘বৈঠকে বঙ্গবন্ধু রেজুলেশনের প্রস্তাব দিলে কানাডা ও যুক্তরাজ্য সমর্থন করে। তবে তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নায়ারে আপত্তি তুললেন। বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে তার যুক্তি খণ্ডন করে বললেন,‘কমনওয়েলথের সম্মেলনে যোগ দিতে পৃথিবীর অর্ধেক পথ উড়ে এসেছি। এই সংস্থার সদস্য হিসেবে একটি রেজুলেশনও যদি না পাই, তাহলে কী লাভ? পরে রেজুলেশন গৃহীত হলো।’
মাত্র ৪৪ মাস দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই স্বল্প সময়েই বাংলাদেশ যে ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলে দাড়িয়েছিল তাঁর অন্যতম কারণ ছিল জাতির পিতার এই কূটনৈতিক ক্যারিশমা।