বঙ্গবন্ধুর জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের জন্ম
ঢাকা: ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান জন্মেছিলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়াতে। যে কারণে আজ টুঙ্গিপাড়ার নাম পৃথিবীর বুকে অম্লান। ধন্য এ দেশের মানচিত্র।
কিশোর বয়সেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন শেখ মুজিব। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার মুজিব কিশোর বয়স থেকেই জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করতে গিয়ে কারাবরণ করেছেন। কারাগারে থেকেই তিনি কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। এভাবেই তিনি ইন্টারমিডিয়েট ও গ্রাজুয়েশন কম্পিলিট করেন। হাজার কষ্টেও তিনি আপোস করেননি অন্যায়ের সঙ্গে।

একসময় শেখ মুজিব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে ঢাকায় আসেন এবং অল্প বয়সেই জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আপোসহীন চরিত্রই শেখ মুজিবকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করে। তিনি অবিভক্ত পাকিস্তানের নির্বাচিত এমপি হয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন একাধিকবার। তবে মন্ত্রিত্ব কিংবা অর্থকড়ির লোভ তাকে বিন্দুমাত্রও স্পর্শ করেনি। দেশের মানুষকে ভালোবেসে মানুষের দুঃখ দুর্দশা নিরাময় করতে সোচ্চার শেখ মুজিব বারবার কারাবরণ করেছেন। তবু তিনি কখনোই আপোস করেননি অন্যায়ের সাথে।
শেখ মুজিব শুধু রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন দার্শনিক। তাই তো তিনি রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা না করে তার রাজনৈতিক সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে গঠন করেছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। তার পরে দূরদর্শী এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অসাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকেই গঠন করেছিলেন আওয়ামী লীগ। সে সময় ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে এমন একটি সিদ্ধান্ত ছিল শেখ মুজিবের দৃঢ় দেশ প্রেমের জাজ্বল্য উদাহরণ। তখন এই ভূখণ্ডের বেশিরভাগ মানুষ ছিল অশিক্ষিত ও ধর্মপ্রাণ। তবু শেখ মুজিব তার রাজনৈতিক আদর্শে কতটা কনফিডেন্ট ছিলেন বলেই, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঝাণ্ডা উড়িয়েছিলেন- তা ভেবে দেখুন। এখনকার এই আধুনিক বাংলাদেশের রাজনীতিতেও যা করতে সন্দিহান হন অনেক রাজনীতিক।
শুধু অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ গঠন করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি এই ভূখণ্ডের সাধারণ জনগণের মাঝে অসাম্প্রদায়িকতার বীজ ভালোভাবে বপন করতে সক্ষম হন। যে কারণে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে। সেই থেকেই এই ভূখণ্ডের বাঙালিদের পূর্ণ আস্থা ব্যক্ত হয় শেখ মুজিব তথা আওয়ামী লীগের ওপর। ততদিনে শেখ মুজিব হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু। আর অসাধ্যকে সাধন করে দেখিয়েছেন আমাদের প্রাণপ্রিয় বঙ্গবন্ধু।
৭০-এ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানি বদমাশ রাজনীতিকরা সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিতে দেয়নি। এরপর থেকেই এই অঞ্চলের বাঙালিরা স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। সবাই বুঝে গিয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানিরা আসলেই গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন নয়। বরং তারা নির্লজ্জ হয়ে আমাদের শোষণ করতে চাইছে। তাই তো ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দেন। তাই তো সেদিন বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
সেই বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু দেশের জনগণকে আরো অনেক দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি আরো বলে দিয়েছিলেন- যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা বুঝে গিয়েছিল, অন্যায়ের পর অন্যায় করে আর রেহাই পাবে না তারা। তাই তো তারা ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি নিধনে। ওই রাতে তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল। গ্রেফতার হওয়ার মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণাপত্র।
পরে তা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ পাঠ করেছিলেন চট্টগ্রামের তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ। ২৭ মার্চ বাঙালি যেসব পাকিস্তানি আর্মিতে চাকরিরত ছিলেন, তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করানোর জন্যে বঙ্গবন্ধুর লেখা স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান।
১৯৭১-এ দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জাতির পিতা। তার আপোষহীন রাজনীতি ও দার্শনিক চিন্তা চেতনার বাস্তব কার্যকারিতায় আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। বিশ্বের দরবারে আজ উন্নত মম শির- এই আমাদের বাংলাদেশ।
যে পাকিস্তানিরা তাদের জাতীয় ক্রিকেট দলে কোনো বাঙালিকে খেলতে দিত না, সেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আজ বিশ্ব ক্রিকেটে গৌরবের স্থান দখল করে আছে। ফুটবল কিংবা হকিতেও আমরা আজ বর্তমান পাকিস্তানের থেকে অনেক এগিয়ে। বিশ্বনন্দিত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের মতো এখনো কেউ নেই তাদের দেশে। চিত্রশিল্পে জয়নুল আবেদিন কিংবা শাহাবুদ্দিনকে ছাপিয়ে যাওয়ার মতো কেউ নেই ওই দেশে। মূকাভিনয়ে পার্থ প্রতীম মজুমদারের মতো বিশ্বজয় করতে পারেনি এই দক্ষিণ এশিয়ার কেউ। গলফ খেলায় সিদ্দিকুর- এর বিশ্বজয় মানে তো বাংলাদেশেরই গৌরব। শুটার আসিফ বাংলাদেশেরই অহংকার। বাংলাদেশের লোকগানের শিল্পী মমতাজ বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন। যেভাবেই হোক, এই দেশের কেউ নোবেল পুরষ্কার নিয়ে এসেছেন। এ রকম আরো অনেকের কথাই বলতে পারি। সর্বশেষ বলতে হয়, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার মতো বিশ্বনন্দিত রাজনৈতিক নেতা ও রাষ্ট্রনেতা শুধু পাকিস্তান কেন- এই উপমহাদেশে বিরল। তিনি আমাদের গর্ব। এই উপমহাদেশের অহংকার। একমাত্র শেখ হাসিনাই পারেন, আমেরিকাসহ পৃথিবীর তথাকথিত প্রভাবশালী রাষ্ট্রের অন্যায়গুলো নিয়ে স্পষ্ট করে বলতে। তাই শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করতে হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অকাল প্রয়াণের স্মৃতি।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পাকিস্তানি দোসরদের অন্যায় আবদার মেনে না নেয়ায় প্রাণ দিতে হয়েছিল আমাদের জাতির পিতা, তার পরিবারকে ও জাতির পিতার ঘনিষ্ঠজনদের। শুধুমাত্র বিদেশে অবস্থানের কারণে বেঁচে গিয়েছিলেন জাতির পিতার ২ কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। নইলে হয়ত এই বাংলাদেশের জনগণ কখনো পেতেন না বিশ্ব বরেণ্য রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে। তাই জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারছেন শেখ হাসিনা। আমরা তার দীর্ঘায়ু কামনা করি। সেই সাথে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবার ও ৭১-এর ১৫ আগস্ট শাহাদৎ বরণকারী সবার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। সেই সাথে জাতির পিতার ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে খ্যাতিমান জাতীয় চার নেতার আত্মার শান্তি কামনা করি।
যারা ভেবেছিল, জাতির পিতাকে খুন করলেই বাংলাদেশ আবারও পাকিস্তান হয়ে যাবে- তা হতে দেয়নি বিশ্বের একমাত্র স্বাধীন বাঙালিরা। বর্তমানে পাকিস্তান তো বিশ্বের অঘোষিত অকার্যকর রাষ্ট্র। আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দৃষ্টিতে উন্নয়নের মডেল রাষ্ট্র। তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে শপথ হোক, শুধু উন্নয়নের মডেল রাষ্ট্র হিসেবে নয়- একদিন বিশ্বের সেরা উন্নত দেশ হিসেবে আমরা তাক লাগিয়ে দেবো দুনিয়াকে।
সব কথার শেষ কথা হলো, আজকের দিনে বঙ্গবন্ধু না জন্মালে আমরা পৃথিবীর বুকে স্বাধীন বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরতে পারতাম না। বঙ্গবন্ধু না জন্মালে আমরা আজ বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারতাম না। বঙ্গবন্ধু না জন্মালে আমরা আজ দুনিয়াতে উন্নত মানুষের পরিচয়ে বাঁচতে পারতাম না। হয়ত পাকিস্তানিরা আমাদের গোলাম বানিয়ে রাখতো তাদের- যেভাবে এখন মানুষ বেঁচে আছে সোমালিয়ায়।
আমরা আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া আদায় করি- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মেছিলেন বলেই আজকে আমরা পৃথিবীর বুকে উন্নত মম শির হয়ে বেঁচে আছি। তাই যতদিন এই বাংলাদেশের মানচিত্র থাকবে ততদিন বিশ্বজুড়ে বেঁচে রবে একটি নাম- হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।