বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব : লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও পরিপ্রেক্ষিত
ড. হারুন-অর-রশিদ: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৬-দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টোর যোগসাজশে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তার বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ, ’৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দুদিন পূর্বে ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক স্থগিত ঘোষণা, প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ২-২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশে কার্যত পূর্ব বাংলার প্রশাসন পরিচালনা, রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ এবং তাতে সমগ্র বাঙালির উদ্দেশে শত্রুর বিরুদ্ধে ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা’র আহ্বান ও ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রামÑ স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’ ঘোষণা, পূর্বে ২ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বটতলায় (কলাভবন প্রাঙ্গণ) ছাত্র-জনতার বিপুল সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা প্রদর্শন, ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পল্টনের সভায় স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ লাখো বাঙালির কণ্ঠে রাজপথে উচ্চারিত ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ স্লোগান, ১৯ মার্চ ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র জনতার প্রতিরোধ, ২৩ মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় ‘পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে’ পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ২৫ মার্চ রাত থেকে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে নির্বিচার গণহত্যা শুরু, পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা, ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ছয় সদস্য বিশিষ্ট ‘মুজিবনগর সরকার’ নামে পরিচিত প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন ও আওয়ামী লীগ থেকে ’৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃক ‘স্বাধীনতার সাংবিধানিক ঘোষণা’, ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় সরকারের প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ, ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়, বিশে^র মানচিত্রে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণÑ এসবই ছিল বাংলাদেশ সৃষ্টির বিপ্লবের প্রধান ঘটনা।
বাংলাদেশ বিপ্লব ’৭১-এর তিন বছর পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু নতুন যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে উদ্যোগী হন, একে তিনি ‘This is our second revolution’ বা ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলে আখ্যাত করেন।
দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি
দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মধ্যে দুটি দিক ছিল সরকার ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কর্মসূচি এবং আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি। প্রথমত ছিল সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন, একটি জাতীয় দল গঠন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করা, জেলা প্রশাসনের দায়িত্বে জনগণের প্রতিনিধি বা গভর্নর, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার এবং দ্বিতীয়ত সমবায়ভিত্তিক কৃষি উৎপাদন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, গ্রামে মাল্টিপারপাস বা বহুমুখী কো-অপারেটিভস, পল্লী অঞ্চলে ‘হেলথ কমপ্লেক্স’ প্রতিষ্ঠা, পরিকল্পিত পরিবার এবং শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। বঙ্গবন্ধু হলেন রাষ্ট্রপতি আর ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী হন সরকারের প্রধানমন্ত্রী। পরিবর্তিত সংবিধানের আওতায় ৬ জুন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল দল, সরকারি-বেসরকারি এবং সামরিক অন্যান্য বাহিনীর কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সদস্য নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিবিশেষকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ নামে একটি জাতীয় দল গঠন করা হয়। ২১ জুন সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে পূর্বের ১৯টি জেলার স্থলে ৬১টি জেলা সৃষ্টি করা হয়। ১৬ জুলাই বঙ্গবন্ধু ৬১ জেলার প্রতিটির জন্য একজন করে গভর্নর নিয়োগদান করেন।
দ্বিতীয় বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিত
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ দেশে প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিজের ওপর নেন। স্বল্প সময়ের পরিসরে বঙ্গবন্ধু সরকার যুগান্তকারী সাফল্য অর্জনে সক্ষম হন। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যদের দেশে ফেরত পাঠানো, মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে আশ্রয় নেওয়া ১ কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে-বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা, কয়েক লক্ষ নির্যাতিতা মা-বোনদের পুনর্বাসন, পাকিস্তানে আটকেপড়া কয়েক লক্ষ বাঙালিকে দেশে ফেরত আনা, ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতু মেরামত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন, চট্টগ্রাম ও চালনা সমুদ্র বন্দর থেকে মাইন অপসারণ, নতুন রাষ্ট্রের জন্য সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীসহ প্রতিরক্ষা বাহিনী পুনর্গঠন, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ১০ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বিশে^র অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন, মুক্তিযুদ্ধকালীন রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থার স্থলে বহুদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল গঠন সংবিধানে নিষিদ্ধ ঘোষণা, ১৫ মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান (১৯৭৩), শিক্ষাব্যবস্থাকে বিজ্ঞানভিত্তিক, গণমুখী ও যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন, বিশ^বিদ্যালয়ের কালাকানুন বাতিল করে ১৯৭৩-এর গণতান্ত্রিক আদেশের আওতায় স্বায়ত্তশাসন প্রদান, ৪০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ ও কয়েক লক্ষ শিক্ষককে সরকারি মর্যাদা দান, ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ব্যবস্থা, বাংলাদেশের জন্য শতাধিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যারা হত্যা, খুন, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন ইত্যাদির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছে, তাদের বিচারের উদ্দেশে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ (বিচার) ট্রাইব্যুনাল আইন পাস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, সম্পদের ওপর অবাধ ব্যক্তি মালিকানার অবসান এবং দ্রুত আত্মনির্ভরশীল জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালেই দেশের সকল ব্যাংক-বীমা, পাট ও বস্ত্রকলসহ বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করেন। পুঁজির ঊর্ধ্বতম সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ এবং জমির ঊর্ধ্বসীমা পরিবার পিছু ১০০ বিঘা নির্ধারণসহ ভূমি সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তবে বঙ্গবন্ধু সরকারকে এক চরম বৈরী অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিলেও মুক্তিযুদ্ধকালে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র এরপরও অনেকের কাছে থেকে যায়। সশস্ত্র ডাকাতি, লুটতরাজ, ছিনতাই, পরিত্যক্ত বাড়িঘর দখলের মতো সমাজবিরোধী কর্ম চলতে থাকে। উপর্যুপরি বন্যা, খরা ইত্যাদি কারণে দেশে খাদ্য সংকট সৃষ্টি, বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করে তা মোকাবেলায় গৃহীত প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচের মধ্যে পড়ে বিপন্ন হওয়া ও পরিশেষে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষে বহু লোকের প্রাণহানি, আরব-ইসরাইল যুদ্ধের (১৯৭৩) কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব, কালোবাজারি-মজুদদারি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি পরিস্থিতি মোকাবেলা স্বাভাবিক অবস্থায়ও যে কোনো সরকারের জন্য খুবই কঠিন। এসবের ওপরে ছিল রাজনৈতিক সংকট এবং তা-ই ছিল সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
স্বাধীনতার পর বাম নামধারী চীনপন্থি কিছু গোপন সংগঠন, যেমন সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টি, আবদুল হকের (যশোর) পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট), মোহাম্মদ তোয়াহা, আলাউদ্দিন, সুখেন্দু দস্তিদার, আবদুল মতিন, টিপু বিশ্বাস, অহিদুর রহমান প্রমুখের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন তথাকথিত কমিউনিস্ট গ্রুপ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘অসমাপ্ত বিপ্লব’ এবং বঙ্গবন্ধু সরকারকে রুশ-ভারত কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া ‘অবৈধ সরকার’ বলে গোপনে প্রচারণা চালাতে থাকে। এদের কেউ কেউ দেশ যে স্বাধীন হয়েছে, তা-ই স্বীকার করতে চায় নি। এরা সংসদীয় রাজনীতিতে আদৌ বিশ্বাসী ছিল না। এরা সে সময়ে ভারতের পশ্চিম বাংলাজুড়ে চারু মজুমদারের নকশালবাড়ী আন্দোলন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তাঞ্চল সৃষ্টির চেষ্টাসহ সশস্ত্র পন্থায় ক্ষমতা দখলের উগ্র হঠকারী রাজনৈতিক লাইন অনুসরণ করে গোপন সশস্ত্র তৎপরতা চালাতে থাকে। থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, বাজার ও ব্যাংক লুট, পাটের গুদামে আগুন, রেললাইনের স্লিপার উপড়ে ফেলা, শ্রেণি-শত্রু খতমের নামে মানুষ হত্যা, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সংসদ সদস্যদের হত্যা ইত্যাদির মাধ্যমে তারা কার্যত সরকারের বিরুদ্ধে একটি অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৭৩ সালে পাঁচ মাসেই এদের হাতে ৬০টি থানা আক্রান্ত ও সকল অস্ত্র লুট হয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তি ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঠেকাতে ব্যর্থ হয় বটে, তবে স্বাধীনতার পরেও তাদের বাংলাদেশ-বিরোধী অপতৎপরতা অব্যাহত থাকে। তারা নতুন এই রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
তবে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের সাড়ে ১০ মাসের মধ্যে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের সাবেক ও তখনকার নেতৃত্বের একটি অংশ কর্তৃক ‘শ্রেণি-সংগ্রাম’, ‘সামাজিক বিপ্লব’ ইত্যাদি রোমাঞ্চকর স্লোগান আর ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নামে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলÑ জাসদ-এর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের রাজনৈতিক ধারা এবং মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের কারণেই একমাত্র জাসদ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধিতায় নতুন এই দল গঠন সম্ভব হয়। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক দলসমূহ স্বাধীন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ থাকায় সেসব দলের কর্মী-সমর্থকদের অনেকে সরকারের বিরোধিতায় জাসদের ব্যানারে সমবেত হয়। ১৯৭৪ সালে জাসদ আওয়ামী লীগ সরকারকে সশস্ত্র পন্থায় উৎখাত করতে সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত হয়। বলা যায়, এরই অংশ হিসেবে ঐ বছর ১৭ মার্চ জাসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাওয়ের মতো আত্মঘাতী কর্মসূচি গ্রহণ করে। এভাবে জাসদের হঠকারী রাজনীতি ও চরম ভারত-বিরোধিতা একদিকে যেমন অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, অন্যদিকে রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। একই সময়ে পৃথকভাবে হলেও, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী)-এর মুখপত্র ‘হক কথা’ ভারত ও বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধিতায় চরম বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণায় লিপ্ত হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটতে থাকে। চারজন সংসদ সদস্যসহ কয়েক হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যাকা-ের শিকার হন। জাতীয় জীবনে উদ্ভূত সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের সংবিধানে জরুরি অবস্থার কোনো বিধানই ছিল না। অবনতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী আইন পাস করে তা এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এমনই রাজনৈতিক পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা করেন।
দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য
দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা, ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’ অর্থাৎ, যুগযুগ ধরে শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত, নির্যাতিত গণমানুষের কল্যাণ, ‘বাংলার দুঃখী মানুষকে পেট ভরে খাবার দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠন’, সকল নাগরিকের জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা পরিহার করে দেশের উন্নয়ন ও আত্মনির্ভরশীল হওয়া, এ লক্ষ্যে রাজনীতিক, সামরিক-বেসামরিক আমলা, সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে একযোগে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করা, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, ‘বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত’, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল আদর্শ (Core Values) জাতীয় চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা যে কোনো মূল্যে সমুন্নত রাখা, সাম্প্রদায়িকতার বীজ বাংলার মাটিতে আর কোনোদিন যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেটি নিশ্চিত করা, হত্যা, খুন, নাশকতামূলক কর্মকা- কঠোর হস্তে দমন করে জনজীবনে নিরাপত্তা বিধান, চোরাকারবার-মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ, জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো, উচ্চ পর্যায় থেকে নি¤œ পর্যায় পর্যন্ত অংশগ্রহণমূলক প্রশাসন, সমাজের জ্ঞানী-গুণীজনদের ‘পুল’ গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের সম্পৃক্ত করা ইত্যাদি।
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণের পর দ্রুত দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পায়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এক কথায় দেশের সামগ্রিক অবস্থার লক্ষণীয় উন্নতি ঘটতে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির পেছনে দেশের উদ্ভূত সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন আশু লক্ষ্য ছিল বটে, তবে তা কিছুতেই একমাত্র বিবেচ্য ছিল না। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল আরও সুদূরপ্রসারী। বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক মুক্তি উভয়ই ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল রাজনৈতিক লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ’৭১-এ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার সংগ্রাম সফল হলে এবার জনগণের সার্বিক মুক্তির সংগ্রাম নতুন করে শুরু হয় এবং যা এখনও চলমান। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো।’ এ জন্য তিনি বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা আর অনেক নির্যাতন সহ্য করেছেন। তাই তার দ্বিতীয় লক্ষ্য অর্জনে এ পর্যায়ে তিনি আত্মনিবেদন করেন। এ জন্য আবশ্যক ছিল সার্বিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধুর কথায়, ‘উই হ্যাভ টু মেইক এ কমপ্লিট চেইঞ্জ’ অর্থাৎ, সিস্টেম পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধু তার অভিজ্ঞতায় এও উপলব্ধি করেন, ‘কলোনিয়াল পাওয়ার এবং রুল নিয়ে দেশ চলতে পারে না। নতুন স্বাধীন দেশ স্বাধীন মতবাদ, স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করতে হবে।’ অতএব, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ছিল ‘সিস্টেম চেইঞ্জ’। নিজ হাতে অগাধ ক্ষমতা লাভ কোনো অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল না। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন এবং প্রদত্ত ভোটের ৭৩.১৭ শতাংশ পেয়ে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনায় তিনি বিপুল গণম্যান্ডেট লাভ করেছিলেন। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতির পিতা। তার প্রতি জনগণের সমর্থন, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল সীমাহীন। তাই নতুন করে তার হাতে ক্ষমতার কোনো আবশ্যকতা ছিল না। দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ছিল তার জীবনের দ্বিতীয় লক্ষ্য অর্থাৎ, জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক মুক্তি অর্জনের সোপান।
ঘটনাক্রমে বা দৈবাৎ বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ করেন নি। তিনি বাংলাদেশ সৃষ্টিরও অনেক পূর্ব থেকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। সেই পাকিস্তান আমলেই গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা আওয়ামী লীগের অন্যতম লক্ষ্য বা কর্মসূচি ছিল। জেলা পর্যায়ের শাসনব্যবস্থা নির্বাচিত পরিষদের ওপর ন্যস্ত করা এবং মহকুমাসমূহকে জেলায় রূপান্তরিত করা ১৯৭০ সালেই আওয়ামী লীগের গৃহীত কর্মসূচি। অতএব, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির অনেক কিছুই তার রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ও বিশ্বাস থেকে গ্রথিত।
১৯৭২-৭৪ এই সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের আচরণ আদৌ গণতন্ত্রসম্মত ছিল নাÑ তা ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এক কথায়, গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করাই যেন ছিল তাদের কর্মকা-ের একমাত্র উদ্দেশ্য। উদ্ভূত অবস্থায় অনেক চিন্তা-ভাবনা শেষে বঙ্গবন্ধুকে একটি জাতীয় দল গঠনে অগ্রবর্তী হতে হয়। এরপরও বঙ্গবন্ধু একটি জাতীয় দলের ব্যবস্থাধীনে নির্বাচনে একাধিক প্রার্থীর বিধানসহ প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যবস্থা রাখেন। বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবকেও একটি পরীক্ষা হিসেবে দেখেন। তার ভাষায়, ‘এটা একটা নতুন এক্সপেরিমেন্ট। এখন দেখা দরকার, এর ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের জনগণের কতটা মঙ্গল করতে পারব। এবং যে আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করেছি, এর মাধ্যমে তার বাস্তবায়নে কতটা কৃতকার্য হব।’ বঙ্গবন্ধু দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করেন, ‘এই সিস্টেম ইনট্রোডিউস করে যদি দেখা যায় যে, খারাপ হচ্ছে, অলরাইট, রেকটিফাই ইট। কেননা, আমার মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমার বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ গড়তে হবে।’
তাই, ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত আত্মনির্ভর উন্নত-সমৃদ্ধ আত্মমর্যাদাবান দেশ ও জাতি গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করাই যে ছিল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের মূল লক্ষ্য, তা স্পষ্ট।
লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ভাইস চ্যান্সেলর, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়