বঙ্গবন্ধুর নতুন করে ফিরে আসা
আমার মনে একটি গোপন গর্ববোধ আছে। বঙ্গবন্ধুর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সেই গর্বটি বিনয়ের সঙ্গে প্রকাশ করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের হত্যাকাণ্ডের পর আমিই প্রথম বিদেশে এসে এই জাতীয় ট্র্যাজেডি সম্পর্কে কলম ধরেছিলাম। এ জন্য কম হুমকি-ধমকির সম্মুখীন হইনি। আর দেশে বসে বঙ্গবন্ধুর নামে সম্ভবত প্রথম কবিতা লিখেছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। সে জন্য তাঁকে থানায় ডেকে নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা কড়া ধমক দিয়েছিলেন।
বিদেশে বসেও বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া তখন ছিল কঠিন বিপদ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা তখন সর্বত্র সক্রিয় এবং মারমুখো। জনমত বিভ্রান্ত। সময়টা ১৯৭৭ সাল। আমি, সুলতান শরিফ (বর্তমানে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি), আরেক বন্ধু মুহিবুর রহমান, থাকতেন লন্ডনের কাছের শহর লুন্টনে এবং ছিলেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের একজন কর্মকর্তা, একদিন যাচ্ছিলাম বার্মিংহামে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীর এক সভায়।
আমাদের কাছে খবর এসেছিল, এই সভা ভাঙার জন্য ঢাকার সামরিকচক্রের অনুচররা সংঘবদ্ধ হয়েছে। তারা লিফলেট ছড়াচ্ছে। এমনকি সম্ভব হলে এই সভায় হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা খবর পেয়ে বার্মিংহামে যাচ্ছিলাম সভাটি যাতে হয় তার ব্যবস্থা করার জন্য। আমার মনে খুব দুঃখবোধ হচ্ছিল। যে মানুষটি (বঙ্গবন্ধু) তাঁর দেশের মানুষের জন্য সর্বমোট ১৭ বছর জেল খেটেছেন, ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলতে চলেছিলেন দুইবার। শেষ পর্যন্ত দেশটির স্বাধীনতা এনেছেন এবং সেই স্বাধীনতা রক্ষার্থেই ‘দারা-পুত্র-পরিবার’সহ আত্মদান করে গেছেন, সেই মানুষটির বিরুদ্ধেও তাঁর দেশেরই একদল লোক কথা বলতে পারে? তাঁর জন্ম অথবা মৃত্যুদিবসের অনুষ্ঠান ভাঙার চেষ্টা করতে পারে?
গাড়িতে বসে সুলতান শরিফকে বলছিলাম, সুলতান, আজ আমরা (বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা) বড় একা, বড় অসহায়। আমরা মাত্র কয়েকজন বিদেশে বসে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণে রেখেছি, স্মরণ করতে চাচ্ছি। তাতেও কত বাধা। যিশুকে যখন ক্রুশে তুলে তাঁর মানুষেরাই হত্যা করছিল, তখন তিনি হাত তুলে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘হে ঈশ্বর, এরা (ঘাতকেরা) কী করছে, তারা নিজেরাই জানে না, এদের তুমি ক্ষমা করো।’ আজ সেদিনের হত্যাকারীরা সর্বত্র নিন্দিত। সারা বিশ্বে যিশুর জয়জয়কার। সুলতান, এমন দিন কি আসবে, যেদিন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হবে এবং বঙ্গবন্ধুর জয়ধ্বনি শোনা যাবে সারা দুনিয়াতে? আমাদের মতো মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে বঙ্গবন্ধুর নামের পতাকা সন্তর্পণে বহন করতে হবে না?
সুলতান শরিফ দেখতে ছোটখাটো মানুষ। কিন্তু তাঁর বিশ্বাসের বহরটা খুব বড়। তিনি আমার কথা শুনে বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু তাঁর মহত্তম গরিমায় আবার দেশে-বিদেশে ফিরে আসবেন। এই বিশ্বাস না থাকলে এত কষ্ট স্বীকার করছি কেন? তবে আমার দুঃখ কী জানেন, একদিন বঙ্গবন্ধু আবার তাঁর মহত্তম গরিমায় দেশে প্রতিষ্ঠা পাবেন, তাঁর দল ক্ষমতায় যাবে। কিন্তু দেখা যাবে, যাঁরা এই চরম দুর্দিনে নানা দুঃখ-কষ্ট-নির্যাতন সহ্য করে আশায় নিভু নিভু বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন, তাঁরা কোথায় হারিয়ে গেছেন। আজ যারা বঙ্গবন্ধু দিবস পালন করতে দিচ্ছে না, বঙ্গবন্ধুর নামে নানা অপবাদ ছড়াচ্ছে, তারাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সবচেয়ে বড় অনুসারী সেজে সব কাজে বাহাদুরি ফলাচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে যা-ই হোক, আজ আমাদের বঙ্গবন্ধুর জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতেই হবে। নইলে আমরা থাকব না, বাংলাদেশও থাকবে না।’
সেই সত্তরের দশকের শেষ দিকে আমরা যখন লন্ডনের রাজপথে বাংলাদেশে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করছি, তখন সুলতান শরিফ একটি স্লোগান তৈরি করেছিলেন রাজপথের মিছিলের জন্য—‘হত্যাকারী, যেখানেই থাকো, শাস্তি তোমায় পেতেই হবে।’ এই স্লোগান শুনে সংখ্যায় তখন গরিষ্ঠ জিয়াচক্রের সমর্থকরা হাসত, বলত, এরা পাগলের প্রলাপ বকছে। আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে, শেখ মুজিবের হত্যাকারীরা শাস্তি পাবে, এটা পাগলের প্রলাপ। এই হত্যাকারীদের খোন্দকার মোশতাক বলেছেন, ‘এঁরা সূর্যসন্তান। ইতিহাসে এঁরা সূর্যসন্তানই থাকবেন।’
আজ বঙ্গবন্ধুর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের দিনটিতে দূর অতীতের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, সুলতান শরিফের কথাই সত্য হয়েছে। শুধু বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের হত্যাকারীরাই নয়, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ঘাতক ও দালালদেরও বিচার ও যথাযোগ্য শাস্তি হয়েছে। আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চার দফা ক্ষমতায় রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বাংলাদেশের ঋড়ঁহফরহম ঋধঃযবৎ বা স্থপতি পিতা হিসেবে স্বীকৃত। বাংলার ইতিহাসে জাতির পিতা, স্বাধীনতার স্থপতি, সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে তিনি ফিরে এসেছেন।
আজ আমার টেবিলে গুনে গুনে দেখছি, বঙ্গবন্ধুর ৪৪তম মৃত্যুদিবস পালনের অনুষ্ঠানের ২৫টি কার্ড। কার্ড আরো আসছে। ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর থেকে, এমনকি সুদূর আমেরিকায় নিউ ইয়র্ক এবং আটলান্টা শহর থেকেও দেশে এ বছর থেকেই জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী (২০২০) পালনের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। যেসব ডান ও বামপন্থী তরুণ বুদ্ধিজীবী বঙ্গবন্ধুর অনুরাগী ছিলেন না, ছিলেন ভ্রান্ত সমালোচক; তাঁরাও এখন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের বিভিন্ন আয়োজনে জড়িত।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের ওপর লেখার জন্য এত বেশি অনুরোধ পেয়েছি যে সব লেখা লিখে উঠতে পারা অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথের কথাই সত্য হয়েছে, ‘দানবের মূঢ় অপব্যয়, গ্রন্থিতে পারে না কভু ইতিহাসে শাশ্বত অধ্যায়।’ বঙ্গবন্ধু স্বীয় মহিমাতেই ইতিহাসের অনন্য পুরুষ হিসেবে তাঁর স্থান করে নিয়েছেন। খলনায়করা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত। অতীতের সেই দুঃখময় ও যাতনাময় দিনগুলোর কথা মনে পড়ে আজ চোখ আনন্দের অশ্রুতে ভরে যায়। আমরা জয়ী হয়েছি। অন্ধকারের অপদেবতারা পরাজিত হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতিষ্ঠা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের প্রতিজ্ঞা হোক—বঙ্গবন্ধুর সামাজিক ও অর্থনৈতিক দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করা। তাহলেই এই জন্মশতবার্ষিকী পালন সফল ও সার্থক হবে।